প্রথম পাতা » শিক্ষা » ‘শিক্ষক দিবস’ এবং…

‘শিক্ষক দিবস’ এবং…

দেশে কয়েকদিন আগে অনাড়ম্বরে ‘শিক্ষক দিবস’ পালিত হলো। জাতীয়ভাবেও দিবসটি পালন করা হয়েছে। অনেকের ভাষণ শুনলাম। তাঁদের বক্তব্যে শিক্ষকদের পুলকিত হওয়ার কোনো বিষয় ছিল না। বরং যাঁরা বেতনের টাকায় সংসার চালাতে হিমশিম খান তারা দু-চারটি পোলাপান পড়িয়ে, বাইরে একটা দুইটা ক্লাস নিয়ে অর্থের যোগান দেন তাদের জন্য দুঃসংবাদই বটে! তাঁরা কোচিং থেকে শিক্ষকদের দূরে থাকতে বলেছেন। এতে অবশ্য অনেকেই বিরক্ত হতে পারেন। তবে এই দেশের শিক্ষার একমাত্র সমস্যা কোচিং নয়। এই দেশের শিক্ষকদের একমাত্র সমস্যাও কোচিং নয়। এই দেশের সবচেয়ে রুগ্ন জনগোষ্ঠীর নাম শিক্ষক সম্প্রদায়। মাননীয়গণ বিচিত্র পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন। সঙ্গত কারণেই শিক্ষকদের সমস্যাসমূহ তাঁরা হয়তো বা আত্মস্থ করতে পারেননি। আশা করি তাঁদের গভীর প্রজ্ঞা দিয়ে দ্রুত বিষয়সমূহ আমলে নিবেন।

‘শিক্ষক দিবস’ নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। পৃথিবীতে দুর্বলদের জন্য অনেক কিছু সংরক্ষিত থাকে। সবলদের দিবস লাগে না। নারীর দিবস লাগে, শিশুর লাগে কিন্তু পুরুষ দিবস লাগে কি? যুবক দিবস? লাগে না। যাদের শক্তি আছে তাদের আরোপিত দিবসের প্রয়োজন নেই। বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকে। এদেশ থেকে প্রকৃত শিক্ষকরা অচিরেই বিলুপ্ত হবে। তাঁদের স্থান দখল করবে বেওয়ারিশ অ-শিক্ষকরা। ফলে, এদেশে শিক্ষক দিবসের বড়ো প্রয়োজন! এদেশে শিক্ষক দিবস আয়োজন তখনই সার্থক হবে যখন সরকারি চাকরিজীবী, রাজনীতিবিদদের সবার সন্তানেরা এ দেশে পড়ালেখা করবে।

ছোটবেলায় কলাগাছ, কচুপাতা এসব হাবিজাবি দিয়ে স্কুলঘর বানিয়ে শিক্ষক সাজতাম। কিন্তু বড়োবেলায় সত্য সত্যই যে এ পেশায় আসতে হবে তা বুঝিনি। তারপর একদিন মনে হলো এ পেশাটিই আমার জন্য বেস্ট। আমি আর কিছু হতেও চাইলাম না। একজন শিক্ষক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল ব্রত। হয়তো এখনো তা-ই আছে।

আমার শৈশবের, কৈশোরের কোনো শিক্ষকের জীবন যাপন আমাকে এ পেশায় আসতে আগ্রহ তৈরি করেনি। আমি দেখেছি এদেশের শিক্ষকরা কতোটা অসহায়, কপর্দকহীন জীবনযাপন করেন। তাঁদের যাপিত জীবনে তাঁরা ছিলেন ঋণগ্রস্ত, কন্যাদায়গ্রস্ত, বিভ্রান্তপথিক এবং ক্লান্ত মানুষ। রসায়নের এক স্যার শেষ জীবনে আধাপাগল হলেন, ইংরেজি স্যার হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতেন কোন অজানা গন্তব্যে তার ছিল না ঠিক। পথভোলা স্যারকে ছাত্ররা একসময় বাড়ি পৌঁছে দিতো। পরে তাঁর আর কোনো খোঁজ পাইনি। রাজনীতির পাতি নেতারা, নিরক্ষর, বর্বর সম্প্রদায় এদেশের অধিকাংশ বেসরকারি স্কুল, কলেজের পরিচালনা পর্ষদ। শিক্ষকদের মধ্যেও দলকানা, লোককানা দলাদলি আছে। আছে নানারকম অসঙ্গতি। এসব বিষয়ে লিখলে লেখাটা অনেক বড়ো হবে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানে নিপীড়িতের সংখ্যাই বেশি। এদেশে শিক্ষকদের কাছে পড়েই একটি শ্রেণি ‘বড় সাহেব’ হয়। তারপর তারাই তাদের শিক্ষকদের বাঁশ দেওয়ার জন্য বাঁশঝাড় তৈরি করে।

সাহিত্য পড়তে গিয়ে দেখলাম রবীন্দ্রনাথের মাস্টারমশাইরা আসেন ভাঙা ছাতা মাথায়, পুরনো বইগুলো বগলচাপা করে। হুমায়ূন আহমেদের মাস্টরেরাতো একেকটা সার্কাস। এরা ‘বেশি কথা বলা’ লোক, এরা ক্বচিৎ বাড়ির কাজের লোকের ‘দাবড়ানি’ খায়, কাগজ গিলে ফেলে, লজিং মাস্টার হলে ছাত্রীর সাথে ইটিশ পিটিশ করে। জীবনের ভারে এরা মস্তিষ্কবিকৃত ও কমিক। এরা সমাজের জন্য ‘দুধভাত’ টাইপ। গুরুত্ব দিলে খারাপ না, না দিলে তেমন ক্ষতি নাই।

এদেশের মানুষ শিক্ষকদের এভাবেই দেখতে পছন্দ করে। শিক্ষকরা জ্ঞানের ভারে নুয়ে পড়বেন। তাঁর পায়ে হাওয়াই চপ্পলই যথেষ্ট! তিনি অন্ধকারে গন্ধরাজ! শুধু বিলাবেন। বিনিময়ে চাইবেন না কিছু। শিক্ষক মানেই মলা-ঢেলা-পুটি-সেরেলাক! ‘শিক্ষকতা মহান পেশা’, ‘শিক্ষক আমি সবার সেরা’ এই উক্তি দুটি তৈরি হয়েছে মূলত শিক্ষকের প্রাপ্য সম্মানকে না দেওয়ার মানসিকতায়। কথার জাদুতে বোকার দলকে চিরজীবনের জন্য দমিয়ে রাখতেই এ থিওরির জন্ম। ‘সবার সেরা’ মুখে বলার জিনিস নয়। শিক্ষকের প্রাপ্ত অধিকারই তাঁকে অন্যদের থেকে সেরা করে তুলবে। একজন অধ্যাপক সহজ কোনো বিষয় নয়। অথচ এদেশে এই পদধারী ব্যক্তির বর্তমান দৈন্যদশা দেখলে আজকাল ভিক্ষুকও শরম পাবে। অনেক অধ্যাপকের ছাত্ররাও গ্রেড ১,২ এ আছে। অথচ তাঁদের দশা তথৈবচ!!

আমি ২০১৬ সালে শিক্ষা ক্যাডারে যোগদান করি। আট বছর চলছে। আমার আগের অনেকেই ১০/১২ বছর ধরে একই পদে কর্মরত। ভৌতিক কারণে কারো কোনো প্রমোশন নেই। আরো কতো বছর পড়ে থাকব কেউ জানেনা। সরকারি চাকরিতে বদলি একটি নিয়মিত ব্যাপার। আমি যদি নড়াচড়া না করি এভাবেই হয়তো একই কলেজে জীবন পার করে দেওয়া সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে ১০ বছরে ফুল প্রফেসর হওয়া যায় সেখানে সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যোগদান করে এ ক্যাডারে থেকে সহযোগী অধ্যাপক থেকেই (৫ম গ্রেড) বিদায় নিতে হয়! এসব লাঞ্ছনা-বঞ্চনা নিয়ে আপনি জাতিকে কী দিবেন?

স্মার্ট বাংলাদেশ মানে হাফ প্যান্ট পরে, হাতে চূড়ি বালা লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো নয়। যার জ্ঞান যত সমৃদ্ধ, যার চিন্তা যত বিশ্বায়নের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ তারাই এ বিশ্বে স্মার্ট। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে উঠবে শিক্ষকের প্রাপ্য মর্যাদাকে ফেরত দেওয়ার মাধ্যমে। বাংলাদেশ বৈশ্বিকচেতনায় স্মার্ট হবে শিক্ষার গুণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে। কোয়ালিটি এডুকেশন কে দিবে? নিশ্চয়ই কোয়ালিটি শিক্ষকরা দিবে। তাঁদেরকে সেই ডেলিভারি দেওয়ার মনস্তাত্ত্বিক ফ্লুয়েন্স দিতে হবে রাষ্ট্রকে। ক্যাডার বৈষম্য বিলোপের সাথে সাথে যার যার সম্মানটুকু ফিরিয়ে দিতে হবে। উপনিবেশিক দখলদারিত্বের প্রাকটিস নয়, বরং সেবার মানসিকতায় রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদকে অলঙ্কৃত করতে হবে। দাবি আদায়ে শিক্ষকদের রাস্তায় নামতে বাধ্য করা নয়, কর্মক্ষেত্রে থাকার মতো নিশ্চয়তা প্রদান করাই হবে দেশপ্রেমিক ব্যক্তিবর্গের প্রকৃত কাজ।

শিক্ষা ক্যাডার কারো দয়ার চাকরি নয়। আপনি যে শপথ নিয়ে দেশপ্রেমের ব্রতে কাজ করছেন, তেমনি এখানেও অনেক অনেক মেধাবী শিক্ষক-কর্মকর্তা এসেছেন দেশকে সেবার মানসিকতা নিয়েই। আপনার হাতে ছড়ি আছে বলেই সবসময় অকারণে ঘুরাবেন তা হবে না। আমি বিশ্বাস করি, ১৫ হাজার শিক্ষা ক্যাডার সদস্য ঘুরে দাঁড়ালে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবে। নতুন ছেলেমেয়েরা কলেজে আসছে একবুক স্বপ্ন নিয়ে। শুরুতেই তাদের ছন্দপতন ঘটাবেন না। আমরা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করছি। আপনাদের সময় দেওয়া হয়েছে। দ্রুত আলোচনায় বসুন, আমাদের যৌক্তিক দাবিগুলো মেনে নিন। আমরা কর্মক্ষেত্রে কর্মমুখর থাকতে চাই। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা থেকে বৈষম্য ঘুচিয়ে আসুন স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে জননেত্রী, দেশরত্নের হাতকে শক্তিশালী করি। আগামি ১০, ১১, ১২ তারিখের কর্মবিরতি শিক্ষার ক্ষেত্রে ভয়াবহ প্রভাব পড়বে।

যৌক্তিক এবং আশু পদক্ষেপের মাধ্যমে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কর্মমুখী হোক, এই আহ্বান রাখছি। বাংলাদেশে আর কোনো ক্যাডার সার্ভিসের লোকজন কি রাস্তায় অনশন করে তাদের কোনো সুযোগ বেহাত হওয়ায়? মনে রাখবেন- ‘যুগের ধর্ম এই, পীড়ন করিলে সে পীড়ান এসে পীড়া দিবে তোমাকেই’!

জয় বাংলা

বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

রাহুগ্রাস থেকে শিক্ষা ক্যাডার মুক্তি পাক।।

শিক্ষা থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *