চোয়াল মেলে জল পানের সময় অনেক বণ্য পশু যেমন নিজের চোখ পান করার কথা ভাবে অথবা পান করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। সেই সব এস্কেপিস্টদের নিয়ে কথা বলছি।
বার্ট্রান্ড রাসেল
আমরা কেন পড়ি? উত্তর খোঁজার আগেই বলে নেয়া দরকার, সমাজের বেশিরভাগ মানুষ বই পড়ে না, কাগজের দৃশ্যের উপর শুধু হুটোপুটি খাচ্ছে বড় একটা অংশ। যারা কিনা কাগজের সাজানো দৃশ্যের বাইরে যেতে পারে, তারাও জানে এসব বিবিধ অসমতার কথা। যদি সব ধরনের বইপত্তর একত্র করা যায়, দেখা যাবে সবই এখনো জনসমুদ্রের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ নিয়েই কথা বলছে।
বই পড়ুয়াদের একটা অংশ মেতে আছে তথ্য সংগ্রহের আগ্রহে, ওরাই এখনো নবীন। কেউ কেউ নিজের চিন্তার পূর্বাভাস পূর্ববর্তী চিন্তকদের মতামত সম্পর্কে খোঁজ করছে, নিশ্চিত হচ্ছে কখনো অনিশ্চিত হচ্ছে, আমি মনে করি তারাই প্রাপ্তবয়স্ক। এ বিষয়ে আরও ভিন্ন একটি অতিবাস্তবতা আছে—জ্ঞান অর্জন, চিন্তা বিশ্লেষণ ও কারণ ছাড়াই বই পড়ছে অনেকে। শুধু মাত্র দৃশ্যমান পৃথিবীর বাইরে নিজেকে দেখার জন্য। স্পষ্ট যে, পালিয়ে যাচ্ছে কোথাও।
চোয়াল মেলে জল পানের সময় অনেক বণ্য পশু যেমন নিজের চোখ পান করার কথা ভাবে অথবা পান করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। সেই সব এস্কেপিস্টদের নিয়ে কথা বলছি। চারপাশের জগতে ওরা ইতিমধ্যে নিজেদের কল্পনার সাম্রাজ্য বিস্তার করে বসে আছে। এই রকমের উড্ডয়নশীল আত্মা যে কোন রূপেই নিজেকে সাজাতে পারে। কেউ কেউ তখন এসব হার্ডকোর মেকাপ নেয়া এস্কেপিস্টদের বিক্ষত বলে দাবী করতে পারে। যার দরূন নানা রকমের বিভাজনের গুঞ্জন, প্রয়োজন মতোই সৃষ্টি হয়েছে। অনেক কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও সিনেমায় তাদের দেখা মেলে। দেখা যায় ক্যানভাসের এক কোনে অনেক নারী পুরুষ নিজের পছন্দ মতো আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তাই হয়তো কোন প্রিন্সেস কখনো একজন ভ্যাম্পায়ারের প্রেমিকা হিসেবে চুড়ান্ত হতে পারে না।
উড্ডয়নশীল এসব দূরবর্তী প্লাটফর্ম ভর্তি হতে পারে আনন্দের নতুন মাত্রায়, নতুনতর কোন ফিগারে। কল্পনার রাজ্যে পালিয়ে যাওয়ার প্রেরণা কে বা কারা যোগান দিচ্ছে এসব ভাবনা এস্কেপিস্টদের প্রজাতি সম্পর্কে আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে, দিতে পারে চতুর্থ অথবা পঞ্চম মাত্রার কোন উত্তর/অবস্থান। সমাজের মানুষেরা কেউ কেউ এসব জ্যোতিষশাস্ত্রের ও গ্রহবিজ্ঞানের অংশবিশেষ আলোচনার কথা বলে পার পেয়ে যেতে পারে। আকাশের শত কোটি ‘তারা’ সবাই করছে নীরব যাপন।খুবই শান্ত নিবিড় পরিচর্যা তাদের দখলে রয়েছে। মহাবিশ্বের কোন তারা নক্ষত্র ইত্যাদি, ট্যাক্স কালেক্টর, বাচ্ছাকাচ্ছা, ব্যাবসায়ী হতাশা, অসুস্থতা এসব বিষয়ে আক্রান্ত হচ্ছেনা। একটু দূর থেকেই ভাবি যদি, নিজেকে যদি একবার কল্পনার রাজ্যে কোথাও আবিস্কার করে নেয়া যায়, যদি ঘটে পরিচয় কোন শিশু নক্ষত্রের সাথে, তবুও নিজের জন্য একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা দেখতে পারে। যা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে পৃথিবীর সকলে।
বর্ণমালার কোন নতুন পরিধি আছে বলে আমার যে ধারণা, তাই এতক্ষণ বলছিলাম। আসলে দেখুন আমি যেটাই লেখিনা কেন, এর মধ্যে এস্কেপিস্ট সম্পর্কে আমার বলার কিছু না কিছু থাকে। জনগন উত্তেজিত হতে পছন্দ করে। নিজের খাতাটা সরিয়ে বলতে চাই, আমি কখনো আমার নিজের লেখা বই পড়তে পারি না। আমি আমার লেখা শব্দে আর বাক্যে খুব কমই স্থির হয়ে থাকতে পারি। আমার বহমানতা উড্ডয়নশীল আচরণ একান্তই আমার সম্পদ যা আমাকে খোলাখুলি সমাজের মধ্যে প্রাচুর্য দিবে বলে আমি মনে করিনা। অনেকের মতো আমারো আছে ব্যাটেলফিল্ড, আমি সেখানে রক্তাক্ত হতে পছন্দ করছি। অথচ সেই একই লেখা পড়ে একজন ডাক্তার হয়তো শুধুমাত্র ভালো আমিষভোজন সম্পর্কে কিছু জেনে নেয়ার মধ্যে ব্যাস্ত।
শিল্পীর ক্রিয়ায় ঘটে যাওয়া প্রতিক্রিয়ার চেয়েও আলাদা কিছু থাকে। যা অনুসন্ধানের জন্য। আমি যদি গোয়েন্দা গল্প লিখতে পারতাম, কোন সন্দেহ নেই মানুষের হাসিখুশি থাকার অনেক কথাই বলতে পারতাম। কবিতা, গল্প, গোয়েন্দা গল্প, সমুদ্র বিজ্ঞান, স্যাটানিক আর্ট প্রায় সবই বাস্তবতা থেকে পালিয়ে যাবার সম্মানজনক বোঝাপড়া। গভীর মনযোগ সব ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ। হেয়ালী করার পরিস্থিতি এই দুনিয়াতে নেই, বলা যায়। কর্মজীবী জীবনে এই ধরণের ডিলিউশনস, প্রতি পদক্ষেপে চোখে অসচ্ছ আয়না নিয়ে কাজ করে যাওয়া খুবই বিপ্রতীপ অবস্থা তৈরি করতে পারে। খুব সহজে বাজে কর্মী হিসেবে একজন কবি কোন কারখানায় স্বীকৃতি পেতে পারে। বস্তির কোন ফেরিওয়ালা নিজেকে প্রেসিডেন্ট ভেবে ছয় মাস কাটিয়ে দিয়েছে, এটাও এস্কেপিস্ট ধারণাকেই শান দিচ্ছে কিন্তু।
আত্ববিলাসবহুলতার কারণে মোজার্ট অনেক আজেবাজে পরিস্থিতি ও ঋনগ্রস্থতার মধ্যে পড়তো। তিনি মিউজিক কম্পোজ করে বুদ হয়ে থাকতেন চরিত্রের এমন অসহনীয় পরিচয় ভুলে থাকতে। যদি সম্ভব হতো মোজার্টের পিয়ানো খুলে দেখা তবে কি কেউ নতুন প্রজাতির পাখির সন্ধান পেতো না? তবে, মোজার্ট কাজ করেছেন, কেননা কাজ তাকে রসদ দিয়েছে পৃথিবীতে টিকে থাকার। আর তাই আমরা পেয়েছি সংগীত সম্পর্কে নতুন মাত্রা। মোজার্ট যদি তার বাস্তব জীবনের সাথে কল্পনার সমতা রক্ষা না করতো, তবে আমি পেতাম মোজার্টের ডেরায় বড়জোর কিছু ব্যালেন্স শিট আর গিল্টি করা পদবী। আর হারিয়ে ফেলতাম পৃথিবীর অন্যতম একজন মিউজিশিয়ান-কে।
আমি মনে করি জীবনের এই সমতার সাথে একাত্ম হতে না পারলে, শিল্পের ক্ষতির সম্ভাবনা উজ্জল হয়। সকল এস্কেপিষ্টকে এক সময় নিজেকে সব কিছুর সাথে ট্যোলারেবল করে নিতে হচ্ছে। পালিয়ে থাকার এই প্রয়োজনের কথা যদিও খুব কঠিন ভাবে বয়কট করে যাচ্ছে সভ্যাতার অগ্রসরমান সমাজপতি । নিজের প্রতিমূর্তি ভর্তি কোন গ্যালারিতে নিজেকে ঘুরে ফিরে দেখার প্রয়োজন অবশ্যই বড় এবং প্রশ্নবিদ্ধ। আমি বিশ্বাস করি এই এস্কেপিস্ট মোটিভ যদি বিলুপ্ত হতে শুরু করে তবে পৃথিবীর উৎপাদন ব্যবস্থা-ও সমান হারে বাধাগ্রস্থ হতে বাধ্য।
(বার্ট্রান্ড রাসেলের লেখা থেকে অনূদিত)