নতুন বিয়াই বাড়িতে বেড়াতে গেছেন ছেলের বাবা। মেয়ের বাবা ঐ বছর মুলা চাষ করে ব্যাপক সফল হয়েছেন। বলা যায়, মুলার বাম্পার ফলন হয়েছে তাঁর। একদিন বিটিভির লোকজন এসে সচিত্র সাক্ষাতকারও নিয়ে গেলো। তিনি হাসিমুখে মুলা হাতে দাঁড়িয়ে থাকলেন। বহু কারসাজি করে ছবি তোলা হলো। যেকোনো শুক্রবারে জুমার নামাজের পর প্রচার হবে মুলাচাষীর বাম্পার ফলনের রহস্য। পুরো জাতি তাদের ছুটির দিনে সচিত্র মুলা-প্রতিবেদন দেখে নড়েচড়ে বসবে। মেয়ের বাবা অপেক্ষায় আছেন সেদিনটির জন্য। সেই খুশিতে ছেলের বাবাকে দাওয়াত করা হয়েছে। দুপুরের খাবারের মেন্যু :
১. মুলার ভাজি
২. মুলার চচ্চরি
৩. শিং মাছ দিয়ে মুলার ঝোল
৪. শুঁটকি দিয়ে মুলার তরকারি
৫. মুলার সালাদ (সাদা মুলা শশার মতো গোল করে কেটে সালাদ করা হয়েছে)
ছেলের বাবা খেলেন। কেমন খেলেন সেটা জানা গেলো না। মেয়ের বাবা লজ্জিত স্বরে অভিযোগ করে বললেন-
‘বেয়াই সাব, কিছু মনে করবেন না। মুলার ফুল সিজনে তো আসলেন না। মুলার আরো নতুন আইটেম দেওন যাইতো!’
মুলার পাঁচ প্রকার ‘আইটেম’ খাওয়ার পর আরো কী কী আইটেম থাকতে পারে তা নিয়ে ছেলের বাবা গভীর চিন্তায় পড়লেন। শেষে বলেই ফেললেন-
‘বেয়াই, ফুল সিজনে আসলে কি মুলা আমার গে@য়@ দিয়াও দিতেন?’
গল্পটি অনেক আগের। আমার বাবা নানা কারসাজি করে সংসার চালাতেন। তখনো আমরা ঢাকা যাইনি। আব্বা কখনো চায়ের দোকান দিতেন, কখনো ভাতের হোটেল, কখনো মুদির দোকান আবার কখনো কৃষিকাজ। একবার লাগালেন মুলা। সেবছর মুলার ব্যাপক ফলন হলো। আমার বয়স তখন ছয় কী সাত হবে। আব্বার সাথে সাথে আমিও সব জায়গায় যেতাম। একদিন হাটবারে মুলা নেওয়া হলো বাজারে। আমরা বাজারে গিয়ে দেখি মুলায় বাজার সয়লাব। গ্রামের সব লোকই প্রায় মুলা এনেছে। কিনবে কে? এক টাকায় পাঁচ আঁটি দেওয়া শুরু হলো। কতক্ষণ পর দশটা। আরো পরে কাস্টমার যে কয়টা নিতে পারে। কিন্তু কেউ আর মুলা নিতে চাইলো না। তখনো প্রায় বিশ ত্রিশ আঁটি রয়ে গেছে। বড় বড় সাদা মুলা। কাস্টমারদের বাপ ভাই ডেকেও কাছে আনা গেলো না। এখন উপায়? এই জিনিস বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়াও এক কেলেঙ্কারি। শেষে আব্বা একটা বুদ্ধি বের করলেন। এগুলো বাজারে রেখেই চলে যাওয়া হবে। আরো কয়েকজন এ কাজ করেছে। কেউ কেউ পাঁচ দশ আঁটি রেখেই পগারপার। আমরা চলে যাচ্ছি এমন সময় বাজারের মালি এসে বাঁধ সাধলো৷ সে আমাদের যেতে দিবে না। মুলা নিয়ে যাও, না হলে বেচে যাও। সে এতো ময়লা মাগনা পরিষ্কার করবে না। সে দুই টাকা চেয়ে বসলো। দুই টাকা দিলে সে ফেলে দেবে। আমরা মুলাই বেচলাম আট দশ টাকা! তাকে দুই টাকা দিলে থাকবে কী? আব্বা বললো, ঠিক আছে যাব না। বেচতে থাকি। আব্বা ফিসফিস করে বললেো, আমি আগে চলে যাই। সুযোগ বুঝে তুমিও সরে পড়বা। খবরদার, মুলা হাতে নিবা না। আব্বা কী একটা কেনার কথা বলে দ্রুত মুলার হাট ত্যাগ করলো।
আমি এক পা দুই পা করে পিছাইলাম। শেষে দিলাম দৌঁড়। ঐ বার মুলার বাম্পার ফলনের পর পরই আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে গ্রাম ছেড়েছিলাম। শুরুতে মুলার যে গল্পটা করেছি সেটি ঐ সময়ের গল্প।
ইদে মসলা, আদা, কাঁচা মরিচ কিনব। বাজারে গেলাম। দুই কেজি কাঁচা মরিচ সেদিন আটশ টাকা! আমি কিন্তু কাঁচা মরিচ কিনলাম না। আমাদের মরিচের দশ বারোটি গাছ ছিল। দেড় কেজি মরিচ উঠানো হলো। আদা কিনলাম। চারশ টাকায় এক কেজি। বাড়িতে কতো জায়গা পড়ে আছে। এসে বললাম, আদা কিনে গাধা। আদা এমন এক জিনিস যেখানে সেখানে পুঁতে রাখলেই হয়। আশা করি এরপর আর আদা কিনতে হবে না।
প্রচণ্ড রোদ, আকস্মিক বৃষ্টি, অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে মরিচ কিনতে হলো এক হাজার টাকা কেজি! ভাবা যায়? বাজার কারা নিয়ন্ত্রণ করছে? ভারতের মরিচ আসছে এমন সংবাদে এক দিনেই কোথাও কোথাও একশ টাকা কেজিতে মরিচ বিক্রি হলো। রমজান, ইদ এসব ধর্মীয় উৎসবে বাঙালির দশা যদি বারোটাই না বাজানো গেলো তবে আমরা কীসের মুসলমান? কীসের সিন্ডিকেট? কীসের রাজনীতি?
দেশের কোটি কোটি মানুষের শেকড় এখনো গ্রামেই গ্রোথিত। প্রতিটি বাড়িতে এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে অনায়াসে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের চাষ করা সম্ভব। আদা, মরিচ তো টবেও হয়। আমরা আসলে পরিশ্রম করতে চাই না। ট্রল ট্রল করতে করতে আমরা এখন ট্রলি বাঙালি। দাম বাড়লে ঐ জিনিসের প্রয়োজন আমাদের আরো বেশি হয়! এই কয়দিন বাঙালি মনে হয় শুধু গোস্ত দিয়ে মরিচ খেয়েছে! পঁচনশীল দ্রব্যগুলো একটু কম কিনলেও দুর্বৃত্তদের শায়েস্তা করা সম্ভব। সেই সাথে গ্রামের সাথে সংযোগ স্থাপনও আমাদের অনেক দিক থেকে মুক্তি দিতে পারে। ফেসবুকে শুধু সমালোচনায় আমাদের মুক্তি হবে না। মুক্তি হবে কর্মে, পরিশ্রমে। ‘লাকাদ খালাকনাল ইনসানা ফি কাবাদ’- আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন শ্রমনির্ভর করে। অথচ আমরা হয়ে আছি মুখাপেক্ষী। মুখে ভারতের যতো সমালোচনাই করি, ভারত থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস আমদানি শুরু করলে দ্রব্যমূল্য, গরুর মাংসের দাম অর্ধেকে নামবে৷ অনেকে বলবেন, এদেশের কৃষক বাঁচবে কীভাবে? আজ মধুপুরে এক কৃষক প্রতি পিস আনারস এক টাকা করেও বিক্রি করতে না পেরে গরুকে খাওয়াচ্ছে এমন প্রতিবেদন দেখলাম। অথচ, আমরা প্রতিটা আনারাস কিনি ৩০-৪০ টাকায়। কৃষক পায় কত?
আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক মার্তিনেজ এসেছিলেন। তিনি এসেছিলেন নাকি বাংলার মানুষের ফুটবল উন্মাদনা দেখতে! কিন্তু তিনি নাকি কিছুই দেখেননি। বাংলার কোনো ফুটবলাররাও তাঁর দেখা পাননি। মনে দুঃখ নিয়ে তারা ফিরে গেছেন চার ঘণ্টা অপেক্ষা করে।
দেশের রাজনীতিবিদরা যখন খেলেন তখন কারোরই আর কিছু করার থাকে না- মাঠেও না হাটেও না।