“আমার ভিডিওটা নষ্ট করে ফেলল! মানুষের জ্বালায় ভালো করে ভিডিওটাও করতে পারি না!” বিলের পাশের রাস্তা দিয়ে হেটে আসার সময়ই কথাটা কানে আসে আমার৷ আমিই সেই ভিডিও নষ্টকারী জ্বালাতনটা৷
কলেজপড়ুয়া মেয়েটা বয়ফ্রেন্ড এর সাথে বসে আছে বাঁশ দিয়ে বানানো উঁচু একটা টং এর উপর৷ লোহার সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে হয়৷ এখানে বসে পাশেই বিশাল বিলটির ভিউ পাওয়া যায়৷ রাস্তার এপাড় ওপাড়৷ মেয়েটার বিরক্তি ভাব দেখে আমি প্রায় বলেই ফেলেছিলাম, বাপের টাকা দিয়ে রাস্তা আর বিলটা কিনে নিয়ে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে তারপর ছবি তুলেন আর ভিডিও করেন, কেউ আর জ্বালাবে না৷ কিন্তু ভদ্রতা করে এরকম মিন কথা বলা যায় না৷
তাছাড়া এত সুন্দর একটা জায়গা৷ এসব কথা বললে আমার নিজের মনের মধ্যেই তিক্ততা জমা হবে৷ সুন্দর সময়টা নষ্ট হবে৷ তখন হবে আরেক জ্বালা৷ আমার মনে একবার কোন খঁচখঁচানি ঢুকলে তা বের করতে অনেক সময় লাগে৷ রাতে এটা নিয়ে আবার দুঃস্বপ্নও দেখে ফেলতে পারি৷ মেয়েটির কথায় পাত্তা দিলাম না৷ একবার চোখাচোখি হল৷ মনে হল পারলে আমার কাছ থেকে জরিমানা আদায় করে নেয়৷ ভিডিও নষ্ট করার জন্য৷
এরকম সাধারণত আমার সাথে হয়না৷ আমার চেহারায় নেহায়েত একটা ভালো মানুষী ভাব আছে বলে আমার মনে হয়৷ বেচারা বলে যে টাইপের মানুষদের মাফ করে দেয়া যায়৷ আবার এক ধরনের ষন্ডাপান্ডামার্কা ভাবও আছে বলে আমার ধারণা৷ দাড়ির কারনে৷ পুষ্পা পুষ্পা ভাব আছে৷ এ আমার মনের কল্পনাও হতে পারে৷ কিন্তু আজকে গোবেচারা বা পুষ্পা কোন ভাব দিয়েই কাজ হল না৷ মেয়েটা আমাকে রীতিমতো ক্রিমিনাল ভাবতে শুরু করল আর ঐ ভাবটা অসংকোচে প্রকাশও করতে থাকল, ভাবে ভঙ্গিতে৷ আমি অতশত না ভেবে বিলের ডাহুক আর পানকৌড়ি দেখতে লাগলাম৷
মোহাম্মদপুর থেকে বসিলা ব্রিজ পাড় হয়ে ঘাটারচরের পরেই এই জায়গাটা৷ কেরানীগঞ্জের কলাতিয়াতে৷ নাওখোলা নদীর পাড়, নাজিরপুর৷ হাজার হাজার পাখিতে মুখরিত বিলটি৷ পাশ দিয়ে পাকা রাস্তা৷ রাস্তার দুই পাশে তালগাছের সারি৷ অনেকগুলো কফিশপ আছে৷ ভালো খাবার দাবারও পাওয়া যায়৷ আমরা গিয়ে বসলাম ক্যাম্পসাইট ক্যাফে নামে একটা কফিশপে৷ বাশঁ দিয়ে তাবুর মতো করে বসার জায়গা৷ এখান থেকে বিলের ভিউটা সবচেয়ে বেশি সুন্দর৷
কফি খেয়ে দুপুরের খাবার অর্ডার দিয়ে রাস্তা দিয়ে হাটাহাটি করলাম৷ হাটাহাটি করে ফেরত আসার সময়ই ওই অপরাধখানা আমি করে ফেলি গো! ভিডিও নষ্ট করার অপরাধ৷ মেয়েটাকে দোষ দেয়ার কিছু নাই৷ টিকটক করতে না দেয়ায় সংসার করবে না এরকম মেয়ে আছে৷ টিকটক করার জন্য হতদরিদ্র বাবার কাছ থেকে বাইক কেনার টাকা রীতিমতো ব্ল্যাকমেইল করে আদায় করে নিচ্ছে ছেলেটা৷ আর এই মহাবিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়েটা আমার কাছ থেকে ভিডিও নষ্ট করার জরিমানা নিলে কিংবা আমাকে দুই চার কথা শুনিয়ে দিলে আমি চুপ করেই থাকব৷ সেটাই শ্রেয়৷ এদের সাথে কথায় বা কাজে পারা যাবে না৷ এসব যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার৷ ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে কথা বলে অপরাধ যা করেই ফেলেছি সেটা আরও গুরুতর করতে চাই না৷
এরকম বয়সের ছেলেমেয়েরা হরমোনাল হয়ে থাকে৷ অতিমাত্রার আত্মসম্মানবোধ মাথায় চাউড় হয়েই থাকে৷ পান থেকে চুন খসার মতো কিছু বললেও টাচি হয়ে থাকা মনে বড় বেশি লেগে যায় এদের৷ নিজেদের একটা আলাদা জগতে থাকে এরা, অন্যদের জগতের হদিস এদের কাছে পাওয়া যাবে না৷ অন্য আরও অনেক জগত আছে এই ধারনাই নাই কারও কারও৷ নিজেদের দুনিয়াটাই বড় দুনিয়া ভাবে তারা৷ নিজেদের বুঝটাই শেষ বুঝ৷ বাকিরা সবাই কম বুঝে অথবা কিছুই বুঝে না৷ এদের সাথে বাবা মা আর শিক্ষকরাই যা একটু পেরে উঠে৷ অনেকের বেলায় তারাও ফেইল৷ সময় শুধু একমাত্র প্রতিষেধক৷ সময় যাওয়ার সাথে সাথে ঠিকঠাক হয়ে যায় সব৷ সেই সময় আসার আগ পর্যন্ত আমি বরং ধৈর্য ধরেই থাকি, চুপ করেই থাকি৷ বাবা মায়েদের জ্বালা বেশি৷ না পারে চুপ করে থাকতে না পারে কিছু করতে৷ কিছু বললেই আর করলেই এই বুঝি অভিমান করে ঘর ছেড়ে চলে গেল, কেউ কেউ তো গুরুতর ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে৷
এরকম টিনেজার ছেলেমেয়েদের সাথে বাকাঁ হতে হয় না, বেঁকিয়ে যেতে হয়৷ তাদের মতো করে ওদের বুঝতে হয়৷ ধৈর্য্য রক্ষে করাই আসল পরীক্ষা হয়ে দাঁড়ায়৷ রক্ষা করতে না পারলে লঘু পাপে গুরু দন্ড পাবেন, যেমন আমি পেয়েছি এবং মেনে নিয়েছি৷ আমি হার মানা টাইপের বেঁকিয়ে যাওয়া মানুষ৷
কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ পাকলে করে ঠাঁসঠাঁস৷ সময় পালটিয়েছে৷ পাকা বাশঁদের এখন নোয়াতে হয় কাঁচা কঞ্চি বাঁশের কাছে৷ কাঁচা বাঁশ নোয়ানোর বিদ্যা আমরা হারিয়েছি৷ তাই পাকা বাঁশকেই নোয়াতে হয়৷ কাদামাটি সহজেই কাদামাটি, ইটের ভাটায় না যাওয়া পর্যন্ত৷ আমাদের অনেক ইটভাটা দরকার৷ বর্তমান প্রজন্মের একটা অংশকে রক্ষা করতে হলে ইটভাটার বিকল্প নাই৷ পরিবার, শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর সামাজিক শিক্ষাই সবচেয়ে কার্যকরী ইটভাটা৷ ম্যুরাল আর সোশ্যাল পুলিশিং সংক্রান্ত লেখাটি শেষ হল৷ ◼️
লঘু অভিজ্ঞতার লঘু কথন
