প্রথম পাতা » মতামত » কর্ম হোক যথা তথা জন্ম হোক ভালো

কর্ম হোক যথা তথা জন্ম হোক ভালো

what

আমার পূর্বপুরুষ বলতে দাদাকেই চিনি। দাদার ভাই-বেরাদর আর কে কে ছিল আব্বাকে জিজ্ঞেস করলে আমতা আমতা করে। আব্বার পিতৃপুরুষের কয়েকটি নাম অবশ্য কয় কিন্তু আমার তেমন বিশ্বাস হয় না। ওপারে তাঁর ফুফু, বোন আরো কে কে আছে বলে মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে। গত সপ্তাহে আব্বা বললেন, তাঁকে একটা পাসপোর্ট করে দিতে। জীবনের শেষ পর্যায়ে তাঁর ফুফুদের দেখে মরতে চান। আমি ‘পাসপোর্ট করে দিব’ বলে চুপচাপ আছি। আমি চাইনা তিনি সেদেশে যান।

দেশবিভাগের গ্যাঁরাকলে পড়ে আমার দাদা আসাম ছেড়ে আসেন ১৯৫০ সালের দিকে। সাথে এসেছিল শুধু আমার দাদি। আমার বাবা, চাচা, ফুফুদের জন্ম হয় এদেশে আসার পরে। ছাপ্পান্ন সালের সেটেলমেন্টে দাদা প্রচুর জমিজমার মালিক হোন। তাঁর আপনজন তেমন কেউ ছিল না বলে অনেক জমি বেহাতও হয়। তারপরও যা ছিল সেগুলোর পরিমাণ অনেক। প্রকাণ্ড আম কাঁঠালের বাগান, বসতভিটা, ধানিজমিসহ বিরাট অবস্থা ছিল তাঁর। এলাকায় লোক খাওয়ানোর ব্যাপারে এখনো লোকজন তাঁকে নিয়ে নানা গল্পসল্প করে।

দাদার প্রচুর সম্পত্তি তিনি ব্যয় করেন নানারকম ভক্করচক্কর কাজে। তাঁর সন্তানরা সব ছোট ছোট। দেখা গেলো, এক রাতে তিনি রূপবান পালাগানের ড্রেস কিনে আনলেন উত্তরের বন্দের দশ কাঠা জমি বিক্রি করে। আরেক রাতে আনলেন হারমোনিয়াম কিনে পুবের বন্দের এক বিঘা জমি পানির দামে বিক্রি দিয়ে। এভাবে প্রায় পনের বিশ বছরের মধ্যে তিনি সব খোয়ালেন। শেষে, বসতভিটার জমিটা বিক্রি করে তিনি বার্মা যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। আমার বাপ চাচারা দুই ভাই, তিন ফুফু। পাঁচ সন্তানকে ‘বিশ্বনিখিল’ লিখে দিয়ে তিনি শেষসম্বল জমিটুকু বিক্রি করে দিলেন। আমার বাবা চাচা দুই ভাই উঠলেন তাঁদের শ্বশুরবাড়িতে। দাদা পড়ে থাকলেন দিনভিখারির বেশে। দাদার বাড়িভিটা যখন বিক্রি করলেন, এলাকার অনেকেই বুঝালেন- দুইটা ছেলের জন্য জমিটুকু রেখে যাও। ওরা কোথায় যাবে?

আমার মহান ফিলোসফার দাদা বার্টান্ড রাসেল বললেন- সব বিক্রি করেছি। এই অল্প জমিটুকু রেখে দুই ভাইয়ের সারাজীবনের বিরোধের ফয়সালা করে যাব না। ছেলেরা তাদের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে উঠবে! অল্পদিনের মধ্যে আমার ‘গানের ম্যানেজার’ দাদা মরণসঙ্গীত ধরলেন। তাঁর জীবনপ্রদীপ নিভে গেলো। আমার বাপ-চাচার শুরু হলো কঠোর জীবন সংগ্রাম।

এককালে প্রচণ্ড কষ্ট করেছি। আমার মতো দরিদ্র পরিবারে যাদের জন্ম তাদের কষ্টের গল্পগুলো একই। এগুলো আর বলতে চাই না। দারিদ্র্যকে বিক্রি করে সাহিত্য রচনা করার ইচ্ছা আমার নেই। আজকাল এসব গল্প কেউ শুনেও না। শুনলেও হাসে। এককালে এদেশের মানুষ যে তিন চারদিন পর্যন্ত না খেয়ে থেকেছে সেসব গল্প অনেকের কাছে আলিফ লায়লার মতো লাগে। এখন যা বলতে চাই তা হলো-

ছাত্রজীবনে খুব ভালো রেজাল্ট করেছি। বিসিএস দিয়ে এদেশের ফার্স্টক্লাস অফিসার হয়েছি। দেশে বদলি নীতিমালা কার্যকর নেই বলে উপজেলায় পড়ে আছি আটবছর। দিন আনি দিন খাই অবস্থা। প্রমোশন হওয়ার কথা আরো তিন বছর আগে। সব যোগ্যতা থাকার পরও কাঙ্ক্ষিত প্রমোশন হচ্ছে না। আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স, এম.ফিল. করলাম। অনার্সের পোলাপান চোখে দেখলাম না আট বছরেও! নিজের মেধা, শ্রম ব্যয় করলাম অপাত্রে। দিন দিন ভোঁতা হয়ে যাচ্ছি। এরই মধ্য সকালে হঠাৎ খবর পেলাম দেশের বড় দুই ব্যাংকের চেয়ারম্যান হলেন যে দুজন মানুষ তাঁরা বয়সে আমার ছোট। ইসলামি ব্যাংক ও ডাচবাংলা ব্যাংকের চেয়ারম্যান দুজনের কী এমন অভিজ্ঞতা বা মেধা আছে তা জানার আগ্রহে একটু পড়াশোনা করলাম। যাদের বয়স চল্লিশের নিচে তাদের অভিজ্ঞতার ঝুলি কতোই বা বিশাল হতে পারে একটি ব্যাংক চালানোর মতো!

এদেশে তাদের চেয়ে বহু মেধাবী আছে যারা ত্রিশ হাজার টাকার একটি চাকরির জন্য তীর্থের কাকের মতো হা করে আছে। শুধু তারাই না, তাদের পিতামাতার তাহাজ্জুদ নামাজ মিস হয় না সন্তানের একটি চাকরির জন্য। অথচ একই বয়সের রাতারাতি এদেশে কেউ ত্রিশ হাজার কোটি টাকার একটি ব্যাংকের মালিক হয়ে যায়! কী বৈষম্য এই জাতির! চাকরির পরীক্ষা দিয়ে এদের কেউ কেউ ক্যাশ অফিসারও হবে না আমার বিশ্বাস। অথচ….!

বয়সের একটা গুরুত্ব আছে। অভিজ্ঞতার একটি বিষয় আছে। হযরত মুহম্মদ যে নবি হবেন তা কি আল্লাহ জানতেন না? তারপরও তাঁকে অপেক্ষা করতে হলো চল্লিশ বছর! মনুষ্য বৃদ্ধ না হলে সুন্দর হয় না। ত্রিশ বছরের ছেলেছোকরারা যদি এতবড় দায়িত্ব নিতে পারে তবে অভিজ্ঞতার মূল্য কোথায়?

আমাদের আসলে ভুলভাল শেখানো হয়েছে- জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো! এসব একালে আর চলে না। কর্ম যেমনই হোক, জন্ম হতে হবে মার্সিডিজে, টরেন্টো টয়োটায় ! শুধু জন্মের কারণেই কেউ হুটহাটহিট অফিসার হচ্ছে আবার কেউ একই বয়সের হয়ে নগরের ময়লা ভাঁগারের একজন কেরানি হওয়ার জন্য গরমে পুড়ে চিঁড়াচ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে। সব দোষ তো জন্মের!

আমার দাদাজান যদি একটি ব্যাংকের শেয়ার কিনে যেত আমি কি এই কুন্তলের চাকরি করতাম! আরেকজন তো দারিদ্র্যকে মহান করে আমাদের তেইশ মেরে গেছেন- ‘হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান!’

কাজী নজরুল ইসলাম সাহেব আপনি এসে দেখে যান, দারিদ্র্য আমাদের কী হ্য@ডাটা করেছে?

মতামত থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *