প্রথম পাতা » মতামত » বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ

বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ

Foundation Training

… আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি কর্মক্ষেত্রের দৈনন্দিন কাজে। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রাত:রাশ করে বসে থাকি গাড়ির অপেক্ষায়। গাড়ি আসে। আমার উদ্বর্তনেরা দৌড়ে যেয়ে ড্রাইভারের পাশের সিট দখল করতে। বিজয়ী অফিসার ড্রাইভারের পাশে যুত করে বসে জানালা দিয়ে কনুই বেড় করে চেহারাতে একটা আভিজাত্য নিয়ে বসে থাকেন, আর আমরা গাড়ির পেছনের সিটে বসে দুলতে দুলতে পৌঁছে যাই অফিসে। অফিসের কর্মচারীরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে কুর্নিস জানাতে। দু’একটা ফাইলে সাইন করে, মন্তব্য লিখে পাঠিয়ে দেই। তারপর অখণ্ড অবসর। DC, ADC, ADM সাহেবের কামরায় উঁকি দেই, কখনো বসি, কখনো কুর্নিস করে চলে আসি। ADC স্যারের কামরায় বসতে তেমন মন চায় না। স্যারের মুখ কখনো থেমে থাকে না। তিনি পান চিবুন আর ক্ষণে ক্ষণে পায়ের কাছে সরকারী বরাদ্যকৃত এক পাত্রে পিক ফেলেন কোন রকম শিষ্টাচারের পরোয়া না করে। তবে সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ বোধ করি এও সাহেবের কামরায় বসে। ভদ্রলোক একটু ভাবুক টাইপের। চোখ দুটো তার ভাটার মতো। শুনেছি উনি নাকি নারায়ণগঞ্জের এক ডিসি সাহেবকে চেয়ার তুলে মারতে গিয়েছিলেন। তবে মানুষ হিসেবে খুব নীতি পরায়ণ। তার কামরায় পা রাখলেই তিনি তার পিয়নকে ডেকে দু’কাপ চায়ের অর্ডার দিতেন আর তার সাথে অতিরিক্ত নির্দেশ দিতেন যেন চাতে একটু দুধ বেশী দেওয়া হয়, কারণ সারাদিনে ঐ টুকুই পুষ্টি।

তবে কাজ কর্ম যে করিনা তা কিন্তু নয়। স্থানীয় স্কুল কলেজের পরীক্ষা ঘনিয়ে আসলেই আমার ডাক পড়ে। একদিন এক মহিলা কলেজে পরীক্ষা পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে দেখা মেলে একজন অধ্যাপিকার। তিনি আমায় বলে যান তার ম্যাজিস্ট্রেট স্বামীর ম্যাজিস্ট্রেসির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে কলেজের অধ্যাপক হবার ইতিহাস। তিনি এটাই বলতে চান উৎকোচ ছাড়া ম্যাজিস্ট্রেসী জবের নেই কোন জৌলুস। তার স্বামী সৎ উপায়ে ছাত্র পড়িয়ে যা আয় করে তা ম্যাজিস্ট্রেসিতে কখনো সম্ভব নয়। আমি উনার কথাকে অগ্রাহ্য করতে চেষ্টা করে যাই। কিন্তু ঘুরে ফিরে একই বৃত্তের মাঝে বাধা পড়ি। ১৬৫০ টাকা। মাস গেলে তেমন কিছুই বাঁচে না। বাড়ী ফিরতে ভয় হয়। ছেলে এতো বড় চাকুরী করে, কিন্তু পরিবারকে কিছুই দেয় না। এই বিড়ম্বনার হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে আমি জোরে-সোরে লেগে পড়ি পালানোর পথ খুঁজতে। জাপানে একটার পর একটা আবেদন পত্র পাঠাতে থাকি। উত্তর আসতে শুরু করে। এরই মাঝে চিঠি আসে আমায় যেতে হবে বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ নিতে।

কাপড় চোপড় গুছিয়ে একদিন এক অপরাহ্ণে পৌঁছে যাই সাভারের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে – যেখানে দেখা মেলে দেশের ভবিষ্যতের সচিব, উপ-সচিব, ডাক্তার, তথ্য ক্যাডার, ডাকবিভাগ, খাদ্য বিভাগ সহ অসংখ্য সহযোদ্ধাদের সাথে। খুব তাড়াতাড়ি আমরা বেঁছে বেঁছে একে অপরের বন্ধু হয়ে পড়ি। ক্লাসে যাই। পরিসংখ্যান, বিশ্ব রাজনীতি, লাইব্রেরী সায়েন্স, নিজ দেশের সংস্কৃতি সহ কতো কিছুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রায় প্রায়ই হয় পরীক্ষা। আমরা দল বেঁধে আলোচনা করি, নিজেদের প্রস্তুত করি পরীক্ষার জন্য। বিকেলে অনেকে জমা হয় খেলার মাঠে। আমরা ম্যাজিস্ট্রেট। আমাদের হাতে প্রশাসন, আমরা গাড়িতে চলাফেরা করি, ইচ্ছে হলেই অন্য দপ্তরের গাড়ী requisition করতে পারি। এহেন ক্ষমতার গর্বে আমরা অন্য ক্যাডারের সহকর্মীদের প্রায়ই এড়িয়ে চলি।

ছোটবেলায় ঘরের কিনারে ঝুলে থাকতে দেখতাম আনাড়ি শিল্পীর হাতে আঁকা এক পোস্টার। ক্ষুদিরাম ফাঁসির মঞ্চে; আর তার ফাঁসি কার্যকর করতে দুদিকে হাফপ্যান্ট পড়া দন্ডায়মান দুই জল্লাদ। আমরা বাঙ্গালী। হাফ প্যান্ট বা সর্ট পড়লে কেন জানি আমার ঐ ছবির কথা মনে হয়। তবুও আমরা বিলাতী সাহেবদের মতো হাফ প্যান্ট পড়ে ব্যাডমিন্টন খেলি।

বন্ধু বান্ধবের উপস্থিতিতে সাভারের জীবন বড় আনন্দময় হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে স্বনামধন্য ব্যক্তিরা আসেন বক্তব্য দিতে। আসে প্রশ্ন পর্ব। কেন যেন প্রশ্ন করার জন্য হাত তুলতে বড় ভয় হয়। ষ্টেজে দাড়িয়ে দুটো কথা বলতে হিমসিম খেয়ে যাই। এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এসেই প্রথম বুঝতে পারি আমরা অনেকেই পড়ালেখা করে ভাল রেজাল্ট করেছি, কিন্তু শিখিনী দশ জনের মাঝে দাড়িয়ে দুটো গুছিয়ে কথা বলতে। পশ্চিমা দুনিয়ায় যাকে বলে leadership, যা দিয়ে সামান্য কলেজের ডিপ্লোমাধারী একজন অফিস কর্মকর্তা প্রমোশন পেতে পেতে কর্তাব্যক্তি হয়ে ওঠেন ।

বুনিয়াদী শিক্ষার শেষ প্রান্তে এসে আমি হিসেব কষি এখান থেকে কোন শিক্ষা বহন করে নিয়ে যাবো আমার কর্মস্থলে? এখানে পরিসংখ্যান শিক্ষা দেওয়া হল- যেন হিসেব পাতি ঠিক ভাবে করতে পারি, সাহিত্য সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করে দেয়া হলো- যেন আমরা দুই একটা জ্ঞান-গর্মির কথা মানুষের কাছে বলে বুঝিয়ে দিতে পারি আমরা ম্যাজিস্ট্রেট কতো জ্ঞানী! অথচ এখানে দেওয়া হল না কোন মানবিক শিক্ষা। প্রজাতন্ত্রের এই যে বড় বড় কর্মকর্তা যারা নিযুক্ত হয়েছেন জনগণের সেবক হিসেবে, এই তিন মাসের প্রশিক্ষণে কেউ ভুল করেও সে কথা স্মরণ করিয়ে দেয়নি। অথচ একজন মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তার কাছে মানুষের কতো প্রত্যাশা। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেটের আভিজাত্যের সামনে ওরা ওদের আকাঙ্ক্ষার কথা বলতে পারেনা ভয়ে। একজন ডাক্তার আস্তে আস্তে কসাই হয়ে ওঠে। তারা অপরের ব্যবস্থাপত্র ছুড়ে ফেলে দিয়ে খসখস করে লিখে দেয় নিজের ব্যবস্থাপত্র, তার সাথে কোথায় কি টেস্ট করতে হবে তার নির্দেশ। পরক্ষনেই ভাবি – এখানে যারা এই প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা করেছেন তারা হয়তো ইচ্ছে করেই এই মানবিক শিক্ষা আমাদের প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্ত করেননি। কারণ মানবিক গুণাবলীর বিকাশ তো দু একদিনের প্রশিক্ষণে অর্জন করা সম্ভব নয়- এঁর বুনিয়াদ তো গড়ে ওঠে শিক্ষাজীবনের সেই প্রাথমিক স্তরে। তবুও মন বলে যদি এমন কোন ব্যবস্থা থাকতো – সরকারী উচ্চ পদস্থদের বছরে অন্তত একবার পাঠানো হতো প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে খেটে খাওয়া মানুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে। তাহলে হয়তো তাদের আভিজাত্যের পালক কিছুটা হলেও পড়ত খসে, সাহেবদের মতো স্যার স্যার শুনার বাসনা হয়তো একটু হলেও স্থিমিত হতো!
….. সংগৃহীত।

মতামত থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Bikul
বিকুল
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন। ভালোবাসেন ব্লগিং করতে এবং অন্যের লেখা পড়তে। অবসর সময় কাটান ভালো মুভি দেখে। সারা বিশ্ব ঘুরে দেখতে চান।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *