কবিরা বৈষয়িক নন- এই কথাটি বাংলা সাহিত্যে যে কজন কবির বেলায় প্রযোজ্য জীবনানন্দ দাশ তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তাঁর কবিতার বিষয় ছিল বহুমাত্রিক কিন্তু তিনি বিষয়ী লেখক হয়ে উঠতে পারেননি। অর্থের প্রয়োজন তাঁর ছিল কিন্তু অভাব তাঁকে বিনষ্ট করতে পারেনি। তিনি কোনো রাজসভার সভাকবি হননি, হয়েছেন স্ব-ভাব কবি। বাংলা কাব্যে জীবনানন্দ তাই অপার বিস্ময়, সীমাহীন দুর্বোধ্য হয়ে ধরা দেয় পাঠকমহলে। জীবনানন্দ পড়তে হয় লোক-লোকান্তরের ভিড় ঠেলে নির্জন প্রকোষ্ঠে, আম-জাম-কাঁঠাল- অশ্বত্থের ছায়াতলে, জীবনের গভীর সমুদ্রে, অন্ধকারে, সন্ধ্যাকালে। জীবনানন্দ পড়বেন নিঃস্ব, কপর্দকহীন অবস্থায় যখন আপনার কিছুই নেই, কেউ নেই। তাঁর কবিতা পড়বেন সহকর্মীর সাথে বৈষয়িক ও স্বার্থের দ্বন্দ্বের পরাজিত পরাকাষ্ঠে, তাঁকে পড়বেন পঞ্চমীর চাঁদ ডুবে গেলে, মরার সাধ্যহীন সাধে, হরিণের সতর্ক সহাবস্থানে, শিকারির অব্যর্থ টার্গেটে। প্রকৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়ার কালে তাঁকে পাঠ করবেন। তাঁকে পাঠ করবেন যখন আপনি না-মানুষ হয়ে উঠবেন দোয়েল, ফড়িং, কার্তিক বা নবান্নের প্রতীকে। প্রকৃতির আরো গভীরে আপনি ডুব দিবেন একখণ্ড জীবনানন্দ নিয়ে, বনলতার শান্ত চোখে চেয়ে, একটি আশ্রয়ের খোঁজে পরিব্যাপ্ত হয়ে। আপনি সেখানে জীবনের স্পন্দন পাবেন, আনন্দের পাবেন ভাইব্রেশন।
জীবনানন্দ বৈঠকি মানুষ ছিলেন না। গলাবাজি করেননি কখনো। এসব কারণে সককর্মীদের সাথে বনিবনা হয়নি কোনোদিন। এতেও কয়েকবার চাকরি চলে গেছে তাঁর। ৫০০ টাকা অগ্রিমের জন্য প্রকাশকের দ্বারস্থ হয়েছেন। সঙ্ঘচেতনায় তাঁকে পাবেন না। মানুষের ভিড়েতো নয়ই। তাঁকে দেখা গেছে পানের বরজে, অন্ধকারে পেঁচার বেশে, গোবরে পোকার রূপকে, ভোরের শিশিরে, ধানসিঁড়ির পাড়ে একা হেঁটে যেতে। সভ্যতার চূড়ান্ত বিপর্যয়ের পর তাঁকে পাওয়া গেছে কলাগাছের ভেলায়, বেহুলার ঘুঙুরে, জলাঙ্গীর ঢেউয়ে, বকেদের ভিড়ে আর গাঢ় অন্ধকারে।
দুপুরে চিতল মাছের ঝোলভাত কিংবা নদীর তেলতেলে পাঙ্গাস মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে বৌ এর হাতে একটা খিলিপান খাওয়ার মতো বৌভাগ্যাহতদের জীবন তাঁর ছিল না। সংসারের সুনিপুণ আদর্শ স্ত্রৈণ তিনি হতে পারেননি। তবে আকাশলীনা, সুচেতনা, সুরঞ্জনাদের কাছে তাঁর জিজ্ঞাসা ছিল অনেক। এতো নারীর ভিড়ে কেবল একজনই তাঁকে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল- নটি বনলতা সেন! সংসার জীবনে তাঁর বৈরাগ্য ছিল। এতে অনেকেই স্ত্রী লাবণ্য দাশের কড়া সমালোচনা করেছেন। দোষ কবিরও থাকতে পারে! ‘কাব্য পড়ে যেমন জানো, কবি তেমন নয়গো’!
জীবনানন্দ বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ করেছিলেন এক মহামহিম শক্তিধর রূপে। সমকালীন জীবন বাস্তবতায় লেখা তাঁর অসাধারণ কবিতাগুলির যথার্থ প্রয়োগ আজো আমাদের বিস্মিত করে। তাঁর মতো করে একটি পঙক্তি লেখা আজ আর কোনো বাঙালি কবির দ্বারা সম্ভব নয় বলেই মনে করি। যে বাজারে বেগুনের কেজি ১০০/ টাকা সেখানে ‘বাজারি’ লেখক না হয়েই বা উপায় কী? বর্তমান বাজারে এক কেজি বেগুনের মূল্যে কবি-লেখক পাবেন প্রায় এক ডজন! এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এইসব কবিদের রাজনৈতিক পরিচয় আছে! পদ-পদবিও আছে! এঁরা স্বভাকবি এবং সভানটিও বটে!
জীবনানন্দ বিদেশ ভ্রমণ করতে পারেননি। কোনো মেগাপ্রজেক্টের জন্য সাঁতার, যোগব্যায়াম বা হামাগুঁড়ি শিখতে বিশাল বহরের সাথে ভলগা, রাশিয়া বা ইউরোপ যেতে পারেননি। তাই তিনি বলতে পেরেছিলেন :
‘তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও, আমি এই বাংলার প’রে রয়ে যাবো!’
আহা! এমন করে যদি কোনো রাজনীতিক বলতেন তবে ভিসানীতি নিয়ে এতো চিৎকার করা লাগতো না, কোনো পদস্থ কর্তা যদি বলতেন তবে তাঁর সন্তান নিশ্চয়ই বিদেশে পড়তেন না আর আমাদের স্কুলগুলো পিকনিক স্পট হয়ে উঠতো না! আমরা অসাধারণ একটি শিক্ষানীতি পেতাম। আমাদের সন্তানরা সত্যিকারের মানুষ হতো। আজ তারা সেইসব ‘ঘাইহরিণীর’ মতো আর্তনাদ করছে যারা জীবনানন্দের কবিতায় বাঁচার জন্য খুঁজেছিল সভ্যতার বিবশ বিবেককে। কিন্তু শিকারিরা তাদের দেয়নি বাঁচতে।
জীবনের চরম দুঃসময়ে জীবনানন্দ লিখেছিলেন তাঁর অমর সৃষ্টি ‘রূপসী বাংলা’ কাব্য। কাউকে ভরসা করতে পারেননি বলেই দীর্ঘদিন তা ছিল বাক্সবন্দী। তাঁর মৃত্যুর তিনবছর পর প্রকাশিত হয় কাব্যটি। কী নিপুণ মুন্সীয়ানায় গড়েছেন বাংলার অপরূপ রূপ :
‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর!’
আত্মহত্যা কিংবা অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার মনোবাসনা ছিল অনেক। তাই চাঁদের আলোর বদৌলতে দেখেছিলেন নিকশ আঁধার :
‘যখন ডুবিয়া গিয়াছে পঞ্চমীর চাঁদ মরিবার হলো তার সাধ
…বধূটি শুয়ে ছিল, শিশুটিও পাশে
কতকাল হয়নি ঘুম তার
লাশ কাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার!’
পুরো পৃথিবী ঘুরে এসে নাটোরে পেয়েছিলেন কল্পনার বিদিশা নগরী, সুচেতনা কিংবা আকাশলীনার সাহচর্য। তাঁর মাঝেই জীবনকে করেছিলেন সমর্পণ। তাঁর কাছেই পেয়েছিলেন নিমন্ত্রণ জীবনের। তবু অন্ধকারই হয়ে থাকে চিরসত্য :
‘থাকে শুধু অন্ধকার
মুখোমুখি বসিবার
নাটোরের বনলতা সেন।’
অন্ধকার, নির্জনতা প্রিয় এই মহান কবি জীবনের কাছে হেরে গিয়েও উচ্চারণ করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ পঙক্তিমালা। কাব্যসাধনায় তিনি হেরে যাননি। জীবনে তো কতজনই জিতে যায়। শিল্প ও জীবনের সাথে আপস না করে টিকে থাকে কয়জনা? যে দু একজন শতাব্দীর এই যাত্রায় টিকে থাকে তাঁদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ অনন্য, স্বতন্ত্র।
‘হঠাৎ মৃত্যু’র প্রতি এক ধরনের মোহমায়া তাঁর ছিল। ১৮৫৩ সালে উপমহাদেশে ট্রেন চালুর পর বাংলার হারিয়ে যাওয়া ঠেলাগাড়ির চেয়ে ধীরে চলে যে বাহনটি তার নাম ট্রাম গাড়ি, এই গাড়িটি গত পোনে দুইশ বছরে একটিই দুর্ঘটনা ঘটায়। ১৮৫৪ সালের ২২ অক্টোবর সেই দুর্ঘটনায় মারা যান বাংলার সবচেয়ে জটিলকবি জীবনানন্দ দাশ।
তাঁর প্রয়াণদিবসে গভীর প্রণতি।