প্রথম পাতা » মতামত » জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গণধর্ষণ: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি বন্ধ এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও গবেষণামুখিকরণ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গণধর্ষণ: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি বন্ধ এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও গবেষণামুখিকরণ

Jahangirnagar University Rape

রাজনীতি শব্দটি ব্যাসবাক্য করলে আমরা যা পাই তাহলো- রাজার নীতি বা নীতির রাজা। প্রথম ব্যাসবাক্যটির বিশ্লেষণ করলে পাই রাজা যেমনই হোক তিনি যে নীতি গ্রহন করেন সেটি রাজনীতি আর দ্বিতীয়টির বিশ্লেষণ করলে পাই সর্বশ্রেষ্ঠ নীতিই হলো রাজনীতি। মানব কল্যানের জন্য দ্বিতীয় অর্থটিই অধিক গ্রহণযোগ্য।

একসময় শের-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানব কল্যানের জন্যই রাজনীতি করেছেন যেখানে ব্যক্তিগত কল্যানের উপস্থিতি লক্ষনীয় নয়। ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ বা কল্যানের কথা চিন্তা করলে উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গ রাজনীতি না করে এবং জেল-জুলুম বরণ না করে বরং আরাম-আয়েশ বা অর্থনৈতিক ভাবে স্বাচ্ছন্দময় জীবন-যাপন করতে পারতেন।

কিন্তু আজ যারা রাজনীতি করেন বলে দাবী করেন তারা বেশির ভাগ ব্যক্তিগত কল্যাণ বা স্বার্থকে নিশ্চিত করতেই প্রচলিত রাজনীতিতে যুক্ত হন। যদি আমরা প্রচলিত রাজনীতিতে শিক্ষিত ব্যক্তিদের হাতেখড়ি থেকে একটু পর্যবেক্ষণ করি তাহলে আমাদের নিকট চিত্রটি আরো পরিষ্কার হয়ে দেখা দেয়। যারা প্রচলিত রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছেন তারা মানব কল্যানে নয় বরং ব্যক্তিগত কল্যাণ নিশ্চিত করতেই যুক্ত হচ্ছেন রাজনীতিতে ফলে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অনৈতিকভাবে সুযোগ সুবিধা গ্রহন করতে করতে হয়ে ওঠেন বেপরোয়া এবং দুর্নীতিবাজ।

ফলশ্রতিতে জাতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগামি দিনের রাষ্ট্র, গবেষণা বা জাতিকে পরিচলনার দিশারী নয় বরং আবরার ফাহাদ, সোনি, যুবায়ের, মুরাদ, ফারুক, আবু বকর ইত্যাদি এবং নাম না জানা আরো অনেকের লাশ এবং খুনী ও ধর্ষক উপহার পায়।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় সাধারণত এদেশের মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রচলিত রাজনীতি থেকে দূরে থাকা এবং সবচেয়ে ভাল ফলাফল করা শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হওয়ার পর থেকে চিত্র পরিবর্তন হতে থাকে। প্রথমে দূর-দূরন্ত থেকে আসা শিক্ষার্থীর দরকার হয় একটি থাকার জায়গার এবং সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হলও থাকে কিন্তু হলে একটি সিট নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন হয় শাসক দলের সংগঠনের আজ্ঞাবহ হওয়া। যাদের হলে একটি আসন পাওয়া জরুরী এবং বিকল্প ব্যবস্থা অনুপস্থিত তখন তাদের উক্ত ছাত্র সংগঠনের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচীতে অংশগ্রহন করেই হলে একটি আসন নিশ্চিত করতে হয়। কেবল বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি এবং মেধাবী হলেই হলের আবাসন নিশ্চিত হয়না।

আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নয় এমন কাউকেও দেখা যায় রাজনীতিবীদদের ছত্রছায়ায় হলে থাকতে যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের জন্যই সেটি বরাদ্দ।

মেধাবীদের মধ্য থেকে অনেককে দেখা যায় কর্মজীবনে একটি সরকারি চাকরি নিশ্চিত করার জন্য দলীয় রাজনীতির বিভিন্ন কর্মসূচীতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে নিজেকে দলের আজ্ঞাবহ হিসাবে পরিচিত করে তুলেন। শিক্ষাজীবন শেষে হয়ে উঠেন কেউ খন্ডকালীন রাজনৈতিক কর্মী এবং খন্ডকালীন পেশাজীবি। ফলে ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে উক্ত ব্যক্তির রাজনৈতিক কর্মকান্ড বা পেশাদারিত্ব কোনটির মাধ্যমেই জনকল্যান সাধিত হয়না বরং কর্মজীবনেও ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করতে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকেন যা জাতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

অবসর জীবনে এদের মধ্য থেকেই আমাদের দেশের প্রচলিত মূল রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং সেখানেও পূর্বের প্রাক্টিস অব্যাহত থাকে। ফলে রাজনীতি বা নীতির রাজা জনকল্যাণের পরিবর্তে ব্যক্তিগত কল্যাণের হাতিয়ারে পরিণত হয়।

এমনও দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষার্থী শাসকদলের রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে সে মনে প্রাণে ভিন্ন কোন রাজনৈতিক আদর্শকে সমর্থন করে বা তার পরিবারের সদস্যও ভিন্ন কোন রাজনৈতিক আদর্শের নেতৃত্বস্থানে রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মদ-গাজা-ইয়াবা ইত্যাদির কারবার, চুরি, ছিন্তাই, মারামারি, হত্যা, যৌননিযার্তন, ধর্ষণ, টেন্ডারবাজি যাবতীয় যা কিছু নেতিবাচক ঘটে সবই রাজনীতির কারনে বা রাজনীতিবীদদের দ্ধারা বা তাদের ছত্রছায়ায় ঘটে সেটি সিলেটের এমসি কলেজ প্রাঙ্গনের গণধর্ষণ হোক বা সাম্প্রতিককালের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাস্পাসের গণধর্ষণ হোক। যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রী, শিক্ষয়িত্রী বা বহিরাগত দর্শনার্থীদের।

আশঙ্কা আরো বৃদ্ধি পায় যখন বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখে রাতে সংঘটিত গনধর্ষণের পর র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যের বিবরণীতে বলেন এধরনের ঘটনা ক্যাম্পাসে হরহামেশাই ঘটে কিন্তু ভুক্তভোগীরা তাদের সামাজিক মান-সম্মানের ভয়ে প্রকাশ করতে পারেন না। এটি এ্যালার্মিং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোন ভাবে এর দায় এড়াতে পারেন না। (তথ্যসূত্রঃ প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২৪)

শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারি রাজনীতির নামে এসব অনৈতিক কাজে ব্যস্ত বেশি ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আসল উদ্দেশ্য শিক্ষা ও গবেষণা তা ব্যহত হচ্ছে আর জাতির উপকার না হয়ে ক্ষতির আশঙকা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ কি পারবেন ভবিষ্যতে দায়মুক্ত থাকতে ক্যাম্পাসে সকল ধরনের রাজনীতি আইন করে নিষিদ্ধ করতে? এ যাত্রায় রাজনীতি বন্ধ করা দূরুহ ব্যাপার তবে অসম্ভব নয়। কারণ যখনই কোন নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তখনই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই দেখা যায় বিভিন্ন সময় বক্তব্য আসে অভিযুক্তের পক্ষ থেকে যে তার বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ সহজ নয় কারন তাদের এই প্রশাসনিক পদ পেতে তার অবদান আছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আবরার ফাহাদ হত্যার পর ক্যাম্পাসে সকল ধরনের রাজনীতি বন্ধ করে দেখিয়েছে এবং প্রশংসিত হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক, ছাত্র, কর্মকর্তা, কর্মচারি সব ধরনের রাজনীতি বন্ধ করতে সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে জাতির কল্যানে। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যদি লাশ, খুন, খুনী, ধর্ষিতা বা ধর্ষক, দুর্নীতিবাজ উপহার পাওয়া যায় বা সেখানে কারো জীবন বা নারীদের সম্ভ্রমের নিরাপত্তা না পাওয়া যায় রাজনীতির কারনে তাহলে সেই রাজনীতি বন্ধ করা ছাড়া জাতির নিকট অন্য কোন উপায় থাকে না।

বিপরীত দিক থেকে মন্তব্য আসতে পারে মাথায় পঁচন ধরলে মাথার চিকিৎসা না করে কেটে ফেলা কোন সমাধান নয়। এটা সঠিক তবে যদি ঐ মাথায় এমন পঁচন ধরে যে পঁচন অন্য মাথাকে পচঁন ধরাতে পারে এমন আশংকা থাকে তখন ঐ মাথা কেটে ফেলাই সমাধান।

আবার মন্তব্য আসতে পারে বিপরীত দিক থেকে ভবিষ্যতে রাষ্ট্র পরিচালনা বা রাজনৈতিক নেতৃত্বে সংকট সৃষ্টি হবে। এই মন্তব্য একবারেই ভুল কারণ আমরা যদি সাম্প্রতিক বিশ্ব নেতৃত্বের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাই বারাক হুসাইন ওবামা, জিমি কার্টার, বিল ক্লিনটন, ডোনাল্ড ট্রাম্প, জো বাইডেন, আহমেদি নেজাদ, রইছি, মুহাম্মদ বিন সালমান, ইমরান খান বা এপিজে আবুল কালাম থেকে এরশাদ, জিয়া, বেগম জিয়া কারোরই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতির সাথে তেমন কোন সম্পৃক্ততা ছিলনা।

সুতরাং জাতির কল্যাণে অনতিবিলম্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সকল ধরনের রাজনীতি বন্ধ এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও গবেষণামুখি করতে হবে।

মুহাম্মদ আল্-হেলাল
এমফিল গবেষক (এবিডি)
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
+৮৮০ ১৯১১ ৯৮১১৪৪
alhelaljudu@gmail.com

মতামত থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

মুহাম্মদ আল্-হেলাল
মুহাম্মদ আল্-হেলাল
এমফিল গবেষক (এবিডি), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *