১৮৯৯ সালে বাংলা সাহিত্যের দুজন শক্তিশালী কবি জন্মগ্রহণ করেছেন। এঁরা হলেন : জীবনানন্দ দাশ ও কাজী নজরুল ইসলাম। রবীন্দ্রযুগেই এঁরা আবির্ভূত হয়েছেন, নির্মাণ করেছেন স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত বৈশিষ্ট্য এবং দুজনেই মরার পরে বাঙালির কাছে হয়েছেন ‘সমাদৃত’! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে নজরুলের একটি কবর থাকায় নাগরিকরা বিশেষ দিনে তাঁর কবর জিয়ারত করে, ফুলটুল দিয়ে দোয়া দরুদ পড়ে। এতে অবশ্য কবির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের চেয়ে রাজনৈতিক পটভূমিই মুখ্য।
জীবনানন্দের কপালে অবশ্য সেই ভাগ্য জুটেনি। এমনিতেই ‘অপঘাতে’ মৃত্যু তারপরও কপালে কলেমা নসিব হয়নি তাই বরিশালের কতিপয় লোকজন জীবনানন্দের কবিতা মাঝে মধ্যে ফেসবুকে পোস্টায় আর আকাশে চাঁদ উঠলে বাংলা সাহিত্যে পড়া লোকজন মনে মনে আওড়ায় : ‘যখন গিয়াছে ডুবিয়া পঞ্চমীর চাঁদ…!’ আকাশে প্রকাণ্ড চাঁদ দেখে এই কবিতা পড়ার মোজেজা আমি আজো ধরতে পারিনি! আমজনতার কাছে বিশেষ করে মুমিনীয় মুসলমানের কাছে জীবনানন্দ গুরুত্বপূর্ণ নয়। এদেশের বিসিএস পরীক্ষার্থীরা জীবনানন্দ ঘাঁটে এবং এই কবির নামের বানানে যে তিনটি দন্ত্য ন আছে এই তথ্যটি মুখস্থ করে পাতা উল্টায় আর মনে মনে বলে : শালায় তো কঠিন!
বাংলা অঞ্চলে মরার পর লোকজন হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ১৯২৬ সালে নজরুল স্বরাজ দলের হয়ে নির্বাচন করলেন। নেতাদের দ্বারে দ্বারে গেলেন। ফরিদপুরের তৎকালীন বিখ্যাত, প্রভাবশালী পির বাদশা মিয়ার কাছ থেকে তাঁকে ভোট দেওয়ার আহ্বান সংবলিত ‘ফতোয়া’ও নিয়ে এলেন। ১০৬২ ভোট পেয়ে কবি বেচারা জামানত হারালেন। পাঁচজন প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে নজরুল হলেন চতুর্থ! এই ঘটনা ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশের চার বছর পরের। বাঙালি তখনো তাঁকে বিশ্বাস করতে পারেনি। কলমের বিদ্রোহী আর স্বরাজের বিদ্রোহীকে ভোটাররা এক করতে পারেননি। ‘বাঙালি ওপরে ওপরে সিংহের প্রশংসা করলেও সে মনে মনে চায় গাধাকে!’
নজরুল বাংলা সাহিত্যে নতুন চণ্ডীদাস রূপে এসেছিলেন। হয়েছিলেন বাঙালির চারণ কবি। বৃটিশ বিরোধী মনোভাব পোষণ করায় তাঁর পাঁচটি কাব্য বাজেয়াপ্ত হয়। জেলেও গিয়েছেন। বৃটিশদের তিনি দেখেছিলেন বাংলার ভগবানরূপে! তাই তিনি উচ্চারণ করেছিলেন : ‘আমি ভগবানের বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন!’ এই পঙক্তি বাংলার হিন্দুরা বুঝেনি। তাঁদের ভগবানকে অপমান করা হয়েছে ভেবে নজরুল সনাতনীদের কাছে হলেন অস্পৃশ্য। তিনি বৃটিশ উপনিবেশকে ‘খোদার আরশ’ চিন্তা করে লিখেছিলেন : ‘আমি ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া / খোদার আসন আরশ ছেদিয়া/ উঠিয়াছি চির বিস্ময় আমি বিশ্ব বিধাতৃর!’ ‘খোদার আরশ’ ছেদ করার কথা বলে নজরুল যে এ তল্লাটে আরো সাড়ে চার যুগ অখণ্ডিত মস্তকে কীভাবে বাস করেছেন তা আমার কাছে রীতিমতো বিস্ময়কর! এখনকার সময়ে হলে নজরুলের মাথার দাম উঠতো কমপক্ষে পাঁচকোটি! আড়াই কোটি টাকা ভাগ করে বাংলার হিন্দু-মুসলিম কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শেয়ারে কোনো এক শুক্রবারে শুভকাজটি সম্পন্ন করতো!
মুসলমানরা যখন নজরুলের গজল গায় তখন তারা বিশ্বাস করে না একজন সাবেক ইমাম কাম মুয়াজ্জিন শ্যামাসঙ্গীত লিখতে পারে! হিন্দুরা যখন নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত গায় তখন তারা মনে করে নজরুল মূলত তাঁদেরই! নজরুল যে বাংলার একজন তা কোনো ধর্মাবলম্বীই মানতে চায় না। ফলে বাংলার মানুষের কাছে নজরুলের দ্বৈত সত্তা হয় বিলীন। এতে তাঁর সব্যসাচী চরিত্রটি হয়ে পড়ে সুপ্ত। সাম্যবাদী কবি হয়ে যান খণ্ডিত কবি!
বৃটিশরা নজরুলকে ভয় পেতো। কোনো বিপ্লবীকেই তাঁরা পছন্দ করেনি। তাঁদের শিক্ষা ছিল গুডবয় হওয়ার শিক্ষা। এরপর এদেশ দুবার স্বাধীন হলো। কিন্তু চরিত্রটি তেমন পাল্টায়নি। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে নজরুলের যে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি পাঠ্য করা হয়েছে তাতে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত ও অবনত। অবশ্য এটা না করেও এদেশে উপায় নেই। সমাজস্থ মানুষ যখন বিজ্ঞানকে পোশাক পরায় তখন বিদ্রোহীর অবনত না হয়ে উপায় থাকে না।
নজরুল সারাজীবন যাঁদের নিয়ে লিখলেন সেই প্রান্তিক মানুষরা আজো নজরুল পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি।
এঁরা বড়জোর ‘ভোর হলো দোর খোল’ পর্যন্তই আসতে পারে। তারপর তাঁদের দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ! যারা দরজার কপাট পার হয় তারা আরেকটি পদ্য পড়তে পড়তে এগোয় : ‘নজরুল তুমি করিয়াছ ভুল/ দাড়ি না রেখে রাখিয়াছ চুল!’
যৌবনে কপি আতিকুল্লাহ নামে এক অকবির সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। তার বিস্তৃত ফুলকপির ক্ষেত ছিল তাই তাকে কবি না বলে আমরা বলতাম কপি! তিনি কবিতার (?) একটি বইও বের করেছিলেন। সেখানে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জবাবে তিনি লিখেছিলেন : “পাতাল ফেঁড়ে উঠবে তুমি / নামবে আবার কেমন করে… কাপড় আংগাইলে সব সমান!”
বাংলায় নজরুল এখনো অনেকের কাছে নরজুল হয়েই আছে! কপি আতিকুল্লাহর চিন্তার বাইরে আমজনতা এখনো পৌঁছতে পারেনি। তাই নজরুলের তত্ত্বতালাশের প্রয়োজন নেই। একটা মেসেজ দেই : নজরুল ছিলেন বিখ্যাত জ্যোতিষী! তিনি ‘সংকল্প’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেনন ত্রিশের দশকে। সেখানে তিনি ভবিষ্যৎবাণী করেন : ‘আপন হাতের মুঠোয় পুরে দেখব আমি জগৎটাকে!’
১৯৭১/৭২ সালে সম্ভবত মোবাইল ফোন আবিষ্কৃত হয়। চল্লিশ বছর পরের আবিষ্কারটি সম্পর্কে নজরুল এভাবেই ভবিষ্যৎবাণী করেন। আপনার হাতের স্মার্টফোনটি সেই বাণীর ফসল। কবিরা জ্যোতিষী হয়, বিজ্ঞানীও হয়। আমাদের কবিরা বিজ্ঞানী হলেও পোশাক বড়ই ছিল। পোশাকের কারণে কোনো কবি বেহেশতে গেলে সবার আগে যাবেন শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! তাঁর পোশাক বেশ লম্বা ছিল। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা।
নজরুলের সমস্ত সাহিত্যে একটা বড় ভুল আমি পেয়েছি। তিনি বলেছেন : হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান!’
কাজী নজরুল ইসলাম এদেশে আরেকবার এলে দেখতে পেতেন : দারিদ্র্য আমাদের কতটা মহান বানায়! দরিদ্ররা এদেশে মহানুভবতা পায় না, চোরেরা পায়।