প্রথম পাতা » মতামত » রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং বঙ্গবন্ধু

রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং বঙ্গবন্ধু

Nazrul, Rabindranath and Mujib

নজরুল বাংলা সাহিত্যের চারণ কবি, বাঙালির নতুন চণ্ডীদাস। মধ্যযুগের কবি চণ্ডীদাস বাংলা সাহিত্যে প্রথম মানবতাবাদী এক অমোঘ বাণী উচ্চারণ করেছিলেন- ‘শুনহ, মানুষ ভাই/ সবার ওপরে মানুষ সত্য/ তাহার ওপরে নাই’। এর কয়েক শতাব্দী পর নজরুল উচ্চারণ করলেন- ‘গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড়ো কিছু নাই / নহে কিছু মহীয়ান’।

দ্রোহ ও প্রেমের কবি নজরুল এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হাতে এনেছিলেন বিপ্লবের ভয়ঙ্কর অস্ত্র। নজরুলের সাহিত্য বুঝার জন্য এই একটি পঙক্তিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ- ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণতূর্য’। নজরুল সাহিত্যের সারমর্মও এই বাক্যটিতেই পাওয়া যায়। নজরুল যদি সাহিত্য রচনা না করে বিজ্ঞানী হতেন তবে তিনি হতেন এ গ্রহের একজন মহান বিজ্ঞানী, যদি হতেন অন্যকিছু তবু তিনি হতেন সবার সেরা। তাঁর মতো প্রতিভাবান, প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব বাঙালি মুসলমান তো বটেই সমগ্র বাংলা অঞ্চলেই বিরল। দুঃখ হয়, মাত্র চার দশকেই থেমে গিয়েছিল তাঁর ‘অগ্নি-বীণা’র ঝঙ্কার, ধূমকেতুর দুর্দান্ত প্রতাপ, বিষের বাঁশির বিরহ- সবই ঝরে গেলো অকালে। ফলে, কারো কারো কাছে নজরুল হয়ে রইলেন ‘প্রতিভাবান বালক’! তবে যা হতে পারতো তা নিয়ে বিলাপ না করে যা আছে তা নিয়ে আলোচনা করলেই বোধ করি নজরুলের প্রতি সুবিচার করা হবে।

কবিরা কার্যত বিজ্ঞানী, জোতির্বিদ। নজরুলের ‘সংকল্প’ কবিতায় কতো আগে তিনি বলেছিলেন- ‘আপন হাতের মুঠোয় পুড়ে দেখব আমি জগতটাকে!’ কী বিস্ময়কর উক্তি! এ কবিতা লেখার আরো তিন দশক পর এলো মোবাইল ফোন! এখন তো সকলের হাতের মুঠোয় চলে গিয়েছে নজরুলের সেই অদেখা ভূবন! নজরুল কতোবড় বৈজ্ঞানিক প্রকল্পপ্রণেতা একবার চিন্তা করুন!

নজরুলের কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটকজুড়ে আছে প্রান্তজনের কথা। অস্পৃশ্য বাঙালিকে নিয়ে তিনি লিখেছেন-‘সাম্যবাদী’ কাব্য। গেয়েছেন শেকল ভাঙার গান। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিবাদ-প্রতিরোধকে বাঙ্ময় করেছিলেন আশ্চর্য শিল্প কুশলতায়, কবিত্বের মাহাত্ম্যে। নজরুল নিজে দরিদ্র ছিলেন। তবে তিনি দারিদ্র্যকে পুঁজি করেননি। একে বিক্রি করে তিনি মানুষের সহানুভূতি খোঁজেননি। তাই তিনি দারিদ্র্যকে গ্রহণ করেছিলেন স্রষ্টার মহানুভব এক উপহার হিসেবে- ‘হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করিয়াছ মহান, দানিয়েছো খ্রিস্টের সম্মান’! একালে অবশ্য এমন কবিতা লেখা সম্ভব নয়। একালে দারিদ্র্য মহৎ করে না, চোর বানায়!

রবীন্দ্র বটবৃক্ষের তলে আরেকটি স্বতন্ত্র বটবৃক্ষ হয়ে উঠেছিলেন নজরুল। দুইজনের জীবন প্যাটার্ন, চিন্তার জগত, কাব্যের ভাব ও ভাষা ছিল আলাদা। তবে দুজনই চেয়েছিলেন বাঙালির বিভাজনের দেয়ালকে ভাঙতে। অথচ দুজনেই বাঙালি পাঠক, ভক্তকুলের কাছে হয়ে রইলেন বিভাজিত! একজন শ্রীরবীন্দ্রনাথ, আরেকজন কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলাদেশে যে কটি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে নজরুলের নামে সর্বত্রই দেখবেন নজরুলের পুরো নামটিই ব্যবহৃত হয়েছে! একটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে নজরুলের নামে। সেটি ‘নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়’ হলে ক্ষতি কী ছিল! এমনটা হবে না। কারণ, নামের পেছনে ‘ইসলাম’ না থাকলে বুঝা যাবে কীভাবে যে, তিনি মুসলমান কি না? রবীন্দ্র-নজরুলের আদর্শ, স্বাতন্ত্র্য নিয়ে যতটা তর্ক হয় ততটা তাঁদের সৃষ্টি নিয়ে হলে ভালো হতো। দুজনের কে বড়ো কবি এটি মূলত একটি অপালাপ, আজাইরা ক্যাঁচাল! রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের শান্ত সমুদ্র, নজরুল সেই সমুদ্রের উন্মাতাল ঢেউ। নজরুল কাউকে পরোয়া করতেন না। তিনি সুবিধাবাদী বিনয়ী ছিলেন না। সত্যের ঔদ্ধত্য ছিল, মিথ্যা বিনয় নয়, ছিল নিজেকে জানার সহজ স্বীকারোক্তি। নজরুলের প্রতি রবীন্দ্রনাথের ছিল অগাধ স্বেহ। নজরুলও তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন। দুজন দুজনকে নাট্য- কাব্যও উৎসর্গ করেছিলেন। (রবীন্দ্রনাথ উৎসর্গ করলেন- ‘বসন্ত’ নাটক, নজরুল উৎসর্গ করলেন তাঁর শ্রেষ্ঠ নির্বাচিত কবিতা সংকলন- ‘সঞ্চিতা’!) অথচ, আমরা কাড়াকাড়ি করে মরি!

বাঙালির একজন রাজনৈতিক কবি আছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। শাব্দিক কবি একটি জাতির স্বাধীনতা এনে দিতে পারে না। কিন্তু রাজনীতির কবি সেটি পারেন। বঙ্গবন্ধু সেই অসাধ্য সাধন করে পৃথিবীর বুকে অমরত্ব লাভ করেছেন। তাই তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। বঙ্গবন্ধুর ছিল দরাজ গলা, দয়ার দরজা ছিল খোলা। ছিল প্রেম, ছিল দ্রোহ। মানুষকে ভালোবেসেছেন সবচেয়ে বেশি। জীবন দিয়ে সেই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথকে খুব ভালোবাসতেন তিনি। তাঁর ইচ্ছাতেই ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পায়। এতে রবীন্দ্রনাথ বড়ো হননি। আমরাই সমৃদ্ধ হয়েছি। বাংলার জল জোছনার সুরের লহরি এ গান ছাড়া আর কোথায় আছে? বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছায় স্বাধীন বাংলাদেশে নজরুলকে আনা হয়। দেওয়া হয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাগরিক স্বীকৃতি। তিনি হয়ে গেলেন আমাদের জাতীয় কবি। অসুস্থ কবির চিকিৎসা চললো। কিন্তু সময় বহিয়া যায়…

নজরুলের অসুস্থতাকে অনেকে অভিশাপ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। ভয়ঙ্করভাবে তাঁকে এ কথায় খাটো করা হয়! এগুলো বিদ্বেষের বিষ ছাড়া কিছুই নয়। নজরুল ইসলামি অনেক সঙ্গীত যেমন লিখেছেন তেমনি লিখেছেন অজস্র শ্যামাসঙ্গীত। দুদলই তাঁকে ভুল বুঝেছিল। নজরুল বাংলায় রাজনীতিও করেছিলেন। ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়েছেন, পিরের দোয়া নিয়েছেন। কাজ হয়নি। জামানত হারিয়েছেন!

বাঙালিকে তিনি চেনেননি।

তাঁর প্রথম কাব্য ‘অগ্নি-বীণা’ প্রকাশিত হয় ১৯২২ খ্রি। ততদিনে তিনি বিদ্রোহীর তকমা পেয়ে গেছেন। শেখ মুজিবের বয়স তখন দুই বছর! নজরুলের প্রথম কাব্যটি উৎসর্গ করেন বিপ্লবী বারীন ঘোষকে। নজরুলের অমর সৃষ্টি ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি এ কাব্যের দ্বিতীয় কবিতা। একবসায় এ মহান কবিতাটি তিনি রচনা করেছেন!

আমার প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বরাবরই বিবৃতি প্রদানে সিদ্ধহস্ত। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তারা পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছে! হায়রে লজ্জা!! আজ এ বিদ্যাপীঠের সর্বোচ্চ ব্যক্তি বলেছেন : নজরুল সুস্থ, পরিণত থাকলে ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্য তিনি বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করতেন!

এ কথাটিতে তিনি দু ধরনের সংকট সৃষ্টি করেছেন:

  1. একজন বিপ্লবীকে তিনি ‘অপ্রয়োজনীয়’ হিসেবে অমর্যাদা করেছেন।
  2. বঙ্গবন্ধু একটি জাতির স্বাধীনতার দ্রষ্টা, মহানায়ক। তাঁর নামে ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্য উৎসর্গ জরুরি কোনো বিষয় না। এখানে কার্যত তিনি বঙ্গবন্ধুকেও খাটো করেছেন। মানুষকে ফেরেস্তা বললে তার ইজ্জত কমে বৈ বাড়ে না। নজরুল তাঁর কোনো কাব্য বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করে যেতে পারেননি বলে বঙ্গবন্ধুর অন্তরাত্মা কষ্ট পাচ্ছে বিষয়টি এমনও না।

একটি শোনা কথা লিখে শেষ করছি : বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো এক ছাত্রনেতা একটি পাণ্ডুলিপি নিয়ে বাংলা একাডেমিতে গেলেন বইমেলায় ছাপবেন বলে। নাম : ‘গ্রামবাংলার ভর্তাভাজি!’ এটি নাকি তার পিএইচডির থিসিস! একাডেমির কর্তা ঝিম মেরে বসে রইলেন। এটি কীভাবে ছাপবেন? কেন ছাপবেন? এসব ছাইপাস দিয়ে লোকে কী করবে? কিন্তু একাডেমিতো কারো বাপের টাকায় চলে না। সরকারি দল বলে একটা ব্যাপার আছে। তিনি রিস্কে গেলেন না। বই ছাপবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। তবে পরামর্শ দিলেন এই বলে যে, নামটাকে একটু বাড়াতে হবে। সাথে একটি নাম যুক্ত করতে পারলেই বইয়ের কাটতি হবে ব্যাপক। মানটান নিয়েও কেউ টানাটানি করবে না।

পরের মাসে, একুশের বইমেলায় বাংলা একাডেমির স্টলে শোভা পাচ্ছে রঙিন মলাটের ওপর জ্বলজ্বলে লেখা : ‘গ্রামবাংলার ভর্তাভাজি ও রবীন্দ্রনাথ’!

বর্তমান বাংলাদেশে অনেকে মনে করেন একটি নাম যখন তখন যেভাবে খুশি নিলেই বুঝি কার্যসিদ্ধি। এরা আসলে তাঁকে ভালোবাসেন না। নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য পরম হেলায় নামটি উচ্চারণ করেন কেবল।

মতামত থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *