প্রথম পাতা » মতামত » একটি নেকাবের গল্প

একটি নেকাবের গল্প

Niqab

আমি সেদিনই সন্দেহ করেছিলাম যেদিন নীলক্ষেত প্রান্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রবেশ পথে ‘গণতন্ত্র ও মুক্তির তোরণ’ উদ্বোধন করা হলো। কারণ, আমি জানি চেনা বামুনের পৈতা লাগে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিজেই গণতন্ত্র ও মুক্তপথের প্রতিচ্ছবি, আলোর দিশারী। অন্তত এখানকার হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুনীর চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, আবুল ফজল, গোবিন্দদেব, কাজী মোতাহের হোসেনরা মুক্তপথের আলো জ্বালিয়ে বাংলা ও বাঙালিকে নবজাগরণের একটা প্রদীপ উপহার দিতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশের প্রথম জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং নব্বইয়ের গণআন্দোলনে এ বিদ্যাপীঠের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাংলার নারী জাগরণে এ বিশ্ববিদ্যালয় পালন করেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বাংলার আনাচে কানাচে থেকে ওঠে আসা প্রান্তিক, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত নারীরা এ বিদ্যাপীঠে স্নাতকোত্তর হয়ে দেশগড়ার কাজে অংশ নিয়েছেন, এঁরাই ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। শিক্ষায়, প্রশাসনে, রাজনীতিতে অংশ নিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নারীরা জাতিগঠনে রেখেছেন অসামান্য অবদান। এসবই সম্ভব হয়েছে নারী তার প্রচলিত বন্ধনকে ছিন্ন করে, ধর্মান্ধকে উপেক্ষা করে আলোর পথের যাত্রী হয়েছে বলে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় বিভাগেই নারী শিক্ষার্থীরাই এগিয়ে থাকে একাডেমিক ফলাফলে। কর্মজীবনেও এখানকার নারীরা এগিয়ে চলেছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এগিয়ে থাকা নারীদের বিশাল একটি বহর তৈরি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তাঁরা বাংলাকে এগিয়ে নিচ্ছেন দুর্বার গতিতে। কিন্তু ঢাবির এ অগ্রযাত্রায় আলোর বিপরীতে অন্ধকার দেখতে পাই গত দশকের শুরু থেকেই। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখনো আমাদের বন্ধুরা অনেকেই বোরখা পড়তো ক্লাসে, পরীক্ষায়, ট্যুরে। কেউ কেউ হিজাব, নেকাবও পড়তো। তবে কখনো শুনিনি যে তাদের কেউ ভাইভা বোর্ডে পিতৃব্য শিক্ষককে মুখ দেখাবে না এমন কঠোর মনোভাব লালন করছে। ঢাবির বাংলা বিভাগে গত ১৪ সেপ্টেম্বর ঘটে যাওয়া ঘটনাটিতে মর্মাহত হয়েছি। এক শিক্ষার্থী ভাইভাতে কোনো পুরুষ শিক্ষককে মুখ দেখাবে না বলে কঠোর অবস্থান নেয়। পরীক্ষা কমিটি তাকে অনুপস্থিত দেখায়। এর আগের সেমিস্টারেও সে এমনটি করেছে। তখনো তাকে অনুপস্থিত দেখানো হয়েছে। মেয়েটি মিডিয়াকে তার লিখিত বক্তব্য অভিযোগ আকারে পেশ করেছে। আশা করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করলে এবং প্রচলিত আইনের সংশোধনী আনলে এ জাতির ধর্মরক্ষা হবে আর বাংলার আফগান জোয়ানরা বাংলা বিভাগের গুষ্ঠি উদ্ধারে বরাবরের মতোই জিহাদি জোশ পাবে। আমার আশাবাদ যদি সত্যি হয় তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাম পাল্টে ঢাকা বিশ্বমাদ্রাসা নাম দিয়ে তৎক্ষণাৎ বাংলা বিভাগে তালা লাগানোই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের উপদ্রব কয়েক বছর থেকেই শুরু হয়েছে। কিছুদিন আগেও দেখলাম এক নারী হিজাব পরে ছোট পোশাক নিয়ে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। তার ফেস্টুনে ছিল – ছোট পোশাক নারীকে বিজ্ঞানী বানায় না, পণ্য বানায়! কী আজব সন্ধি! পৃথিবীর কোনো বিজ্ঞান কি কখনো পোশাক পরেছে? পোশাকের সাথে বিজ্ঞানের বিতর্ক জুড়ে দিয়ে এ কেমন বিতর্ক! বিজ্ঞানকে সবসময় ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করে এক শ্রেণির মূর্খরা। এরা বুঝতে চায় না ধর্মকে বিজ্ঞানের কাতারে নেওয়া যায় না। বিজ্ঞান চলে যুক্তিতে, প্রমাণে আর ধর্ম চলে বিশ্বাসে। তবে ধর্মের বিধানে বৈজ্ঞানিক যুক্তি থাকতে পারে।

বাংলার আনাচে কানাচে এখন গড়ে উঠেছে কওমি মাদ্রাসা। বাড়ির কাছে হওয়ায় অধিকাংশ ছেলেমেয়ে এসব মাদ্রাসায় কয়েক বছর পড়ছে। কিন্তু এসব মাদ্রাসার শিক্ষকরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন, সিলেবাসে নেই সরকারি নজরদারি, দেশপ্রেমমূলক কোনো পাঠ এতে প্রায় নেই বললেই চলে। অধিকাংশ শিক্ষকই জেনারেল পড়ালেখা বিষয়ে বিষোদগার করেন, শিক্ষার্থীদের শেখান। নিজেরাও প্রায়ই বেপরোয়া হয়ে পড়েন সীমাহীন হতাশায় ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে। প্রায়ই শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হন তারা। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন। ফলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা উদারতা, সহনশীলতার পরিবর্তে হয়ে ওঠে কঠোর, প্রতিক্রিয়াশীল। এরাই আবার একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়া তাদের থেকে সরে না। জু্ম্মাবারের অনেক ইমামসাব, বহু ওয়ায়েজিনেকেরাম সর্বদা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে নেতিবাচক অপপ্রচার চালান। শিক্ষার্থীদের মগজে নেতিবাচক ধারণা গেঁথে থাকে বলে সহসা এখান থেকে এদের বের করা কঠিন।

যে মেয়ে তার পিতৃতুল্য শিক্ষকের সামনে (পরীক্ষায়, ক্লাসে কিন্তু নয়) নেকাব খুলতে চরম কঠোর তার কী দরকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার? দাওরায়ে হাদিসকে তো মাস্টার্সের সমমান ঘোষণা করা হয়েছে! সে এমন একটি বিষয়ে ভর্তি হয়েছে যার বেশিরভাগ লেখাই হিন্দুদের! শ্রীকৃষ্ণকীর্তন সে কীভাবে পড়বে? বৈষ্ণব পদাবলি পড়ে তো বেঁহুশ হয়ে যাওয়ার কথা! লাইলি-মজনু, পদ্মাবতী পড়ে সে কী বলবে? সে তো কয়দিন পর এসব বিষয়ের ওপর মামলা করবে! মুসলমান হয়ে এসব পড়ব কেন জানতে চেয়ে রুল চাইবে? কী বিপদ! কী বিপদ!

পরীক্ষায় কিছু নিয়ম থাকে। প্রতিটা প্রতিষ্ঠানেরই নিয়ম কানুন আছে। এসব নিয়ম মানাও ধর্মাচারণের অন্তর্ভুক্ত। পরীক্ষা কমিটির সভাপতি গিয়াস শামীম স্যার তাকে মা ডেকে বলেছিলেন তাঁরা তার পিতার সমতুল্য। নেকাব খুলে তার পরিচয় শনাক্ত করতে সহযোগিতা চেয়েছিলেন। কিন্তু সে ওঠে চলে যায় এবং মিডিয়াকে অভিযোগ করে। বিভাগের নিয়ম থাকলে এ অপরাধে তাকে বহিঃষ্কার করা যেতে পারে।

বোরখা পরে এদেশে কতজন প্রক্সি দেয়, বাপ-মায়ের আড়ালে প্রেম করে, এক প্রেমিককে আড়াল করতে আরেক প্রেমিকের কাছে যায়, ফেনসিডিল বহন করে, ডাকাতি করে, পালায়, টিকটক করে, এদেশে জোনাকিরাও বোরখা পরে, ৫০১ নম্বর রুমেও যায় কেউ কেউ! সবার বোরখা পর্দার না, কারোটা কৌশলেরও হয়। তাই এদেশে প্রয়োজনে নেকাব খোলার বিধান থাকাটাও জরুরি। চাকরির পরীক্ষায় নেকাব খুলতে হয়, শিক্ষকতা করলে নেকাব পরে ক্লাস নেওয়া যায় না, হজে গেলে ছবি তুলতে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় ছবি লাগে। পিতার সামনে তো নেকাব খোলা যায়! ঐদিন মেয়েটিকে আমার শ্রদ্ধেয় স্যার পিতার পরিচয় দিয়েছিলেন!

তারপরও এতো যার কঠোরতা সে কেন এসব বেশরিয়তি, বেদাতি পড়ালেখা করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছে? জান্নাতে যাওয়ার জন্য তো বাংলা পড়া জরুরি না! পরকালে বাংলার কোনো কারবার নাই।

মতামত থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *