অহিংসা প্রত্যয়ের সাথে মহাত্মা গান্ধীর নাম আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকলেও এর স্রষ্টা তিনি নন বরং ঔপনিবেশিককালে অন্যান্য ভারতীয় বৌদ্ধিকদের মতো তিনিও অস্তিত্বের প্রশ্নে পশ্চিমা এবং ভারতীয় চিন্তার প্রশ্নবাণে নিক্ষিপ্ত ছিলেন। তাঁকে এদের মধ্যে থেকে আত্ম সত্ত্বার সন্ধানে নিমগ্ন হতে হয়েছিল এবং এক্ষেত্রে তিনি প্রাচীন ভারতীয় ধর্মীয় চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, যেখানে তাঁর আত্মিক সত্ত্বার বিকাশে জৈন ধর্ম সঙ্কট উত্তীর্ণের ভূমিকা পালন করেছিল(Copley, 1987, p. 2)।
তবে জৈন ধর্ম অহিংসার উৎসমূল হলেও বৌদ্ধ ধর্ম তথা গৌতম বুদ্ধের দার্শনিক প্রজ্ঞায় এই দর্শন সবিশেষ প্রসারতা পায় (Chakma, 2014)| কিন্তু চলমানতার উৎস প্রবাহে ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে মুক্তির সংগ্রামে প্রাচীন এই তত্ত্ব প্রয়োগের ক্ষেত্রে গান্ধী যে প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন তাতে তিনি এ তত্ত্বের মৌলিক অবিষ্কারক হিসেবেই আর্বিভূত হয়েছেন, যা জাতিসংঘ কর্তৃকও স্বীকৃত এবং জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২০০৭ সালের ১৫ জুন গান্ধীর জন্মদিন “২ অক্টোবর” কে আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ঐ সিদ্ধান্ত অনুসারে বলা হয় যে, “The International Day is an occasion to disseminate the message of non-violence, including through education and public awareness. The resolution reaffirms that the universal relevance of the principle of non-violence and the desire to secure a culture of peace, tolerance, understanding and non-violence” (UN, 2020).
আলোচ্য অংশে গান্ধীর অহিংসা তথা অহিংস আন্দোলনের উৎস সন্ধান এবং এর তাত্ত্বিক কাঠামো বির্নিমানের প্রয়াস অব্যাহত থাকবে।
অহিংসা সংস্কৃত শব্দ যার ইংরেজি প্রতিশব্দ Non-violence/Non-injury, শাব্দিক অর্থে জীবের প্রতি হিংসা না করার নীতিই অহিংসা(Stefon, 2015)। জৈন মতবাদ অনুসারে, তত্ত্ব দুই ধরনের হয়ে থাকে; জীব বা আত্মা এবং অজীব বা আত্মার বর্হিভূত জগৎ। এ মতানুসারে চেতনা হচ্ছে আত্মার মূল, যেখানে বস্তু হচ্ছে অজীব এবং উভয়ই স্রষ্টার সৃষ্টি।
পরম বা শ্রেষ্ঠ আত্মা বলে কিছু নেই এবং সকল আত্মাই সর্বগামী হওয়ার ক্ষমতা রাখে।
কিন্তু আত্মা দেহের বন্ধনে আবদ্ধ থাকার কারণে সে সর্বত্র বিরাজমান হতে অক্ষম; অন্যদিকে দেহ এবং আত্মার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম হচ্ছে কর্ম, যার মাধ্যমে দেহ থেকে আত্মার মুক্তি সম্ভব, আর এ ক্ষেত্রে ত্রিরত্নকে অনুসরণই হচ্ছে একমাত্র মার্গ। জ্ঞান, ধর্ম এবং বিশ্বাস হচ্ছে জৈন মতানুসারে ত্রিরত্ন। ত্রিরত্নের সর্বোৎকৃষ্ট রত্ন ধর্ম যার মূল মন্ত্র: প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকা; সদা মিথ্যা পরিহার করা; চৌর্যবৃত্তি সংবরণ করা; ইন্দ্রিয়গত ভোগ পরিহার করা এবং জ্ঞানের প্রশ্নে ইন্দ্রিয়কে অভ্রান্ত না মানা(করিম ২০০২, পৃ. ২৪৩)।
জৈন মতবাদের ধর্ম রত্নের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাতে এটা সহজেই বোধগম্য যে, প্রাণী হত্যা থেকে নিজেকে বিরত রাখাই হচ্ছে আত্মার মুক্তির অন্যতম মার্গ যা অহিংসা বা অহিংস নীতি হিসেবে স্বীকৃত। জৈন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মহাবীর অহিংসার নীতি ব্যাখ্যা করে বলেন, “অহিংসা হচ্ছে হিংস্রতা পরিত্যাগ এবং এটি শুধু মানুষ ও মানবেতর প্রাণীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, বরং তা পৃথিবী, পাথর, জল, আগুন, বাতাস ইত্যাদির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য”(Chakma, 2014)|
ধর্ম রত্নের প্রথম ব্রত অর্থাৎ অহিংসাকে কঠোরভাবে অনুসরণের নিমিত্তে জৈন অনুসারীরা রাস্তা ঝাড় দিয়ে চলতেন, যাতে কোন প্রাণীকূলের বিনাশ না ঘটে এমনকি কিছু কিছু অনুসারী মুখে মসলিন কাপড় জড়িয়ে চলতেন যাতে অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও যেন কোন প্রাণীর ক্ষতি না হয়। আবার কখনো এমনও লক্ষ্য করা গিয়েছে, জৈন অনুসারীরা মধুর মতো পানীয় দ্রব্য গ্রহণ থেকেও বিরত থাকতেন, কেননা তাদের ধারণা অনুসারে এতে ঐ দ্রব্যের মধ্যে বিদ্যমান আত্মার দেহনাশ হতে পারে। গান্ধী প্রাচীন এই অহিংস মতবাদ দ্বারা অনুপ্রানীত হয়েছিলেন। তবে কিছু তাত্ত্বিক এমন ব্যাখ্যাও দাড় করিয়েছেন যে, জৈন মতবাদের চেয়ে বুদ্ধ মতবাদ আধুনিক এবং এখানে অহিংস নীতিকে আরও উন্নত দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা এবং অনুসরণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে গান্ধী হৃদয়ে অহিংস নীতির সত্যোপলব্ধির নিমিত্তে প্রথমে জৈনমতবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং পরবর্তীতে অপেক্ষাকৃত আধুনিক গৌতম বুদ্ধের ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করেন।
বুদ্ধের দর্শন ঈশ্বরের অস্তিত্ব কিংবা ঈশ্বর সর্বময় ক্ষমতায় বিশ্বাসী নয় বরং তা নিরীশ্বরবাদী। এ ক্ষেত্রে গেথিন রুপার্ট বলেন, ”The Buddhist understanding of the world is not based upon the concept of a creator God-omnipotent or otherwise. Thus there is no need in Buddhist thought to explain the existence of suffering in the face of God’s omnipotence and boundfess love. The existence of suffering in the world is not to be related in some way to God’s purpose in creating the world. For Buddhist thought suffering is simply a fact of existence, and in its general approach to the problem, Buddhist thought suggests that it is beings themselves who must take ultimate responsibility for their suffering” (Gethin, 1998, pp. 68–69).
বুদ্ধ মতানুসারে, বাসনা হলো সকল দুঃখের মূল এবং এই দুঃখকে তিনি চতুরার্য (Four truth) সত্য বলে অভিহিত করেছে; দুঃখ আছে, দুঃখের কারণ আছে, তা নিরসনের উপায় আছে এবং সর্বোপরি দুঃখ নিরসনের মার্গ বা পথ রয়েছে (Siderits, 2019)| দুঃখ সম্পর্কে গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে বুদ্ধ তাঁর প্রথম হিতোপদেশ এ আরও বলেন, “Birth is suffering, aging is suffering, illness is suffering, death is suffering; union with what is displeasing is suffering; separation from what is pleasing is suffering; not to get what one wants is suffering; in brief, the five aggregates subject to clinging are suffering” (Quoted in Smith, 2016, p. 525).
সুতরাং এটা সহজেই অনুমেয় জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানবাত্মা নানাবিদ দুঃখের মধ্যে দিনাতিপাত করে। তবে তা থেকে নিস্তারের লক্ষ্যে বুদ্ধ কতিপয় উপায়ের কথা বলেছেন। দুঃখ থেকে নির্বাণ লাভের নিমিত্তে বুদ্ধ পঞ্চশীল এবং অষ্টাঙ্গিক মার্গের কথা বলেছেন। বুদ্ধ মতে, নির্বাণই হচ্ছে সকল প্রকার দুঃখ থেকে মুক্তি এবং অভিষ্ঠ লক্ষ্য। বুদ্ধ বলেছেন, শীল গ্রহণ করাই মুক্তি পথের পাথেয় গ্রহণ করা এবং শীলই হচ্ছে চলার সম্বল। এ ক্ষেত্রে পঞ্চশীল হলো প্রথম সম্বল, যেগুলো হলো: প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকা (যাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় বিদ্যমান তাদের হত্যা থেকে বিরত থাকা) বা অহিংসা, চৌর্যবৃত্তি পরিহার করা, মিথ্যা পরিহার করা, কামের বশীভূত না হওয়া এবং সর্বোপরি সুরা বা মদের বশীভূত না হওয়া। বুদ্ধ এই পঞ্চশীলকে মঙ্গল বলেছেন এবং মঙ্গল লাভই প্রেম এবং মুক্তি লাভের সোপান হিসেবে চিহ্নিত করেছে (বড়ুয়া ১৯৮৬, পৃ. ৯০)।

চতুরার্য সত্য থেকে নির্বাণ লাভের ক্ষেত্রে পঞ্চশীল এর পরবর্তী সম্বল হিসেবে তিনি অষ্টাঙ্গিক মার্গের কথা বলেছেন, যার মধ্যে প্রথম দুটি প্রজ্ঞা, পরের তিনটি শীল এবং শেষ তিনটি সমাধি। অষ্টাঙ্গিক মার্গ হচ্ছে: সম্যক দৃষ্টিভঙ্গি (সম্মা দিষ্টি), সম্যক সংকল্প (সম্মা সংকপ্প), সম্যক বচন (সম্মা বাচা), সম্যক কর্ম (সম্মা কম্ম), সম্যক জীবন (সম্মা অজিব), সম্যক প্রচেষ্টা (সম্মা বয়ম), সম্যক মনন (সম্মা সতি) ও সম্যক সমাধি (সম্মা সমাধি)(Chakma, 2015)| নির্বাণ লাভের লক্ষ্যে অষ্টাঙ্গিক মার্গের সমন্বিত অনুসরণ এবং চর্চা অলঙ্গনীয়। বুদ্ধ দর্শন এবং জৈন দর্শনের অহিংস নীতির মধ্যে শুধু যে আধুনিকতায় পার্থক্য তা নয়, বরং বুদ্ধ দর্শনের সকল প্রাণীর কল্যাণের নিমিত্তে হিতোপদেশ প্রদান করা হয়েছে। এই হিতোপদেশ এ শুধু হিংসাত্মাক কার্যকলাপ শুধু পরিহার নয়, বরং এর সাথে শুভ কাজের অভ্যাস গড়ে তোলার উপরও সবিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
সকল প্রাণীর কল্যাণ তথা সকল প্রাণীর প্রতি দয়া বা ভালোবাসাকে বুদ্ধ মেত্তা বলেছেন (Siderits, 2016, p. 70)| অহিংসার অপর নামই মেত্তা, যার সার সংক্ষেপ হচ্ছে, “সবেবর সত্তা সুখীতা হন্তÍ” বা সকল প্রাণী সুখী হোক। মেত্তা একটি উপলক্ষ্য মাত্র, তবে নির্বাণই চরম এবং এই নির্বাণ লাভের জন্য দরকার মৈত্রীভাবনা এবং অনুশীলন। প্রথমত: মৈত্রীভবনার নিমিত্তে প্রত্যাহ যাপিত জীবনে ভাবতে হবে, সকল প্রাণী সুখী হোক, শত্রুহীন হোক, অহিংসিত হোক, সুখী হয়ে কাল হরণ করুক। সকল প্রাণী আপন যথালব্ধ সম্পত্তি হতে বঞ্চিত না হোক। এই মৈত্রীভাবনার দ্বারা নিজেকে সকলের মধ্যে নিজেকে সকলের মধ্যে প্রসারিত করা নির্বাণের পথ। দ্বিতীয়ত: নির্বাণের জন্য অনুশীলন প্রয়োজন। এমন ক্ষুদ্র অন্যায়ও আচরণ করা যাবে না যার জন্য অন্যে তাঁকে নিন্দা করতে পারে। তিনি কামনা করবেন সকল প্রাণী সুখী হোক, নিরাপদ হোক এবং সুস্থ হোক। সকল প্রাণী সেটা সবল কিংবা দুর্বল, দীর্ঘ কিংবা স্বল্প, মধ্যম কিংবা হ্রস্ব, সূক্ষ্ম কিংবা স্থূল, দৃষ্ট কিংবা অদৃষ্ট, নিকটবর্তী কিংবা দূরবর্তী, যারা জন্মেছে কিংবা যারা জন্মাবে সকলে সুখ বা মঙ্গল কামনা এবং সে অনুযায়ী অনুশীলন করাই বুদ্ধ মতে অহিংসা। সদা জাগ্রত মন দিয়ে পঞ্চইন্দ্রিয়ের সাহায্যে গান্ধীজি প্রথমে জৈন মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং এ ক্ষেত্রে তিনি তাঁর মায়ের চিন্তা এবং বিশ্বাস দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাববিত হয়েছিলেন। এ্যান্টোনি কোপলি তাই যথার্থই বলেছেন, ”Indian women are customarily the transmitters of the traditional Hindu religious culture and Putlibai’s most important legacy to her son was her own particular religius beliefs. She belonged to a sect especially opposed to idolatry, one which sought some bridge between Hinduism and Islam, and she had sympathy for Jainism, especially its emphases on the importance of vows (e.g. not to eat meat)” (Copley, 1987, p. 4).
কিন্তু আধুনিক সমাজের প্রেক্ষিতে যখন তিনি দেখলেন, যা গ্রহণ করতে চাচ্ছেন এবং অত্যাচারের হাত থেকে ভারতবাসীকে রক্ষা করার জন্য তা মোটেও যথেষ্ট নয় এবং এর মাধ্যমে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে পরিতৃপ্ত হওয়া সম্ভব নয় তখন তাকে শরণে নিতে হয়েছে বুদ্ধের অহিংস বানী। এর মাধ্যমেই গান্ধীজি সত্যের শুভ্রস্বরূপ ললায়িত জলের মত ভারতবাসীর চেতনার স্তরকে করেছে রঞ্জিত, কিন্তু তা আপন ভঙ্গিতে কিংবা এটা বলা আরও যৌক্তিক হবে যে, প্রাচীন দুটি মতবাদ বা দর্শনকে তিনি আপন হৃদয়ের প্রতিরূপ নির্ণয়ের জন্য নতুন রং, রেখা আর তুলির সাহায্যে বর্ণিল রূপ দিয়েছেন নব জগতে। তবে কতিপয় তাত্তি¡ক এ ধারণাও পোষণ করেন এবং যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, গান্ধীর চিন্তার অধিকাংশই গড়ে উঠেছে তাঁর প্রাথমিক সামাজিকীকরণের উপর ভিত্তি করে। প্রাচ্য (সুবীর কুমার) এবং পাশ্চাত্য (ইরিকসন) উভয় বলয়ের মনঃসমীক্ষণবিদরাই এমন ধারণা পোষণ করেছেন যে, গান্ধীর প্রাথমিক সামাজিকীকরণে তাঁর পরবর্তী সামাজিক এবং রাজনৈকি আন্দোলনের ভিত্তি রচিত হয়েছে। এক্ষেত্রে এন. কে. বোস নামে একজন লেখক যুক্তি দেখান যে, ”Gandhi’s desire to purify and civilize mankind lay with the depths of his personal relationship with his mother or to certain events of his boyhood days” (Bose, 1953, p.78).
তাত্ত্বিকরা গান্ধীকে নারীবাদ তথা নারী চরিত্রের বিশেষ গুণ সম্পন্ন বলেছেন এবং তা গান্ধী স্বীকার করে নিয়েছেন, কারণ তিনি নারীর সন্তান জন্মদানের ক্ষমতাকে কষ্ট সহিষ্ণু বা দুঃখ সহিষ্ণুতার সর্বোচ্চ মাত্রা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যা পরবর্তীতে তাঁর অহিংস নীতি প্রবর্তনে বিশেষ প্রেরণা যুগিয়েছে বলে অনেক ভারতীয় তাত্ত্বিক মত দিয়েছেন। অন্যদিকে গান্ধীর সাথে তাঁর পিতার সম্পর্কের ক্ষেত্রে ঈডিপাস কমপ্লেকস (Oedipus Complex) অল্পবিস্তর প্রভাবিত করলেও, তাঁর পিতা কর্তৃক মাত্র তের বছর বয়সে তাঁকে বিয়ের জন্য জোড় তদুপরি পিতার পেশা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রেষণা প্রদান গান্ধীর মধ্যে বিপ্লবী চেতনা জন্ম দিয়েছিল। যদিও পিতার প্রতি তাঁর আক্রশ ছিল কিন্তু গান্ধীর মধ্যে সেবা প্রদানের গুণাবলী যা তাঁর মায়ের কাছ থেকে প্রাপ্ত বরাবরই বিদ্যমান ছিল। ১৯৮৮ সালে গান্ধীর বিবাহ অনুষ্ঠান উৎযাপনের লক্ষ্যে রাজকোর্ট থেকে পোরবন্দর গমনকালে তাঁর পিতা হঠাৎ অসুস্থ্য হলে তিনি তাকে মাতৃতুল্য সেবা প্রদানে লিপ্ত ছিলেন। ইরিকসন যুক্তি প্রদান করেন যে, তাঁর এই মাতৃতুল্য সেবার গুণাবলীই অহিংস নীতির ভিত হিসেবে কাজ করেছে, এটা এমন কৌশল যার মাধ্যমে অতি সহজেই শোষক এবং ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষকে অতি সহজেই আক্রমন করে জয়ী হওয়া সম্ভব (Erikson, 1970, p. 129)| অন্যদিকে তাঁর লন্ডন গমন বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ক্ষেত্রে অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করেছে, বিশেষ করে London Vegitarian Society নামক প্রতিষ্টানে যোগদান, যেখানে তিনি ইউরোপিয় লেখদের সাথে বিশেষ করে স্তলেস্তয় (১৯২৮-১৯১০) এবং রাশিয়ার নীতিবিশারদ ও উপন্যাসিক রাসকিন (১৮১৯-১৯০০) এর সাথে পরিচিত হন, এ অন্তঃসলিলা ধারাস্রোতের সঙ্গে আরো নানা ধারার মিলনে তাঁর দর্শনে পেয়েছে নতুন বেগ। স্তলেস্তয়ের The Kingdom of God is Within You গ্রন্থখানি গান্ধীর অহিংস চিন্তার ক্ষেত্রে বীজগর্ভ বা বিকাশের ভিত্তিস্বরূপ হিসেবে কাজ করেছে।
গান্ধী তাঁর আত্মজীবনীতে নিজেই স্তলেস্তয়ের প্রভাব স্বীকার করে বলেন, “Tolstoy’s The Kingdom of God is Within You overwhelmed me. It left an abiding impression on me” (Gandhi, 1994, p. 72).
যদিও স্তলেস্তয়ের অহিংস মতাবাদের দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছেন কিন্তু উভয়ের চিন্তার মধ্যে ব্যাপক ফারাক বিদ্যমান। প্রথমত: গান্ধী স্তলেস্তয়ের চেয়ে বহুলাংশে বাস্তবিক এবং তিনি পরিবর্তনশীল বিশ্বের সাথে তাঁর কর্মের পরিগ্রহণে বিশ্বাসী ছিলেন, দ্বিতীয়ত স্তলেস্তয়ের অহিংসা সর্বত হিংসা তথা শক্তি এড়িয়ে চলায় বিশ্বাসী; অন্যদিকে গান্ধীর অহিংস নীতির অভিপ্রায় হচ্ছে সকল প্রাণীর সর্বপ্রকার অনিষ্ট বা পীড়া থেকে মুক্তির লক্ষ্যে হিংসা বা রোষাণল এড়িয়ে চলা। আবার জন রাসকিনস এর Unto This Last গ্রন্থটিও তাঁর চিন্তায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে।
তাঁর মতে, ”Unto This Last, book marked a turing point in my life; The teaching of Unto This Last I understood to be:
- That the good of the individual is contained in the good of all;
- That a lawyer’s work has the same value as the barber’s inasmuch as all have the same right of earning their livehood from their work;
- That a life of labour, i.e., the life of the tiller of the soil and the handicraftsman is the life worth living” (Gandhi, 1994, p. 157).
সুতরাং সার্বিক বিবেচনায় এটা সহজেই অনুমেয় যে, গান্ধীর অহিংসা নীতি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দর্শন এবং লেখকের চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নব্যরূপে আর্বিভূত হয়েছে, এমতাবস্থায় অধিকাংশ তাত্ত্বিক দাবী করেন যে গান্ধীর অহিংস চিন্তা এবং তার বাস্তাবিক প্রয়োগ অনেকাংশেই জৈন এবং এর সমসাময়িক কিন্তু জৈনমতবাদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত আধুনিক বুদ্ধ দর্শন দ্বারা প্রভাবিত এবং অনুপ্রানীত, তবে গান্ধী তাঁর অহিংস নীতিকে নিজেস্ব অবয়বে নব্য রূপে প্রতিষ্ঠা করেছেন যেটা ধর্মীয় গন্ডি ছাড়িয়ে আদর্শিক রূপ ধারন করেছে। গান্ধীর মতে,
“অহিংসা বলতে হত্যা না করাকে বুঝায়, কিন্তু আমার কাছে এর অর্থ ব্যাপক এবং বিস্তৃত। সত্যিকার অর্থে এর দ্বারা অন্য কাউকে আগাত না করাকে বুঝায় এবং অন্য কারো প্রতি কঠোর মনোভাব বা হিংসাত্মাক মনোভাব পোষণ করা থেকে বিরত হওয়াকে বুঝায়, এমনকি সে যদি শত্রু হিসেবেও পরিগনিত হয়” (Quoted in Gill, 2005, p. 77)|
তবে তাঁর অহিংস ধারণার ইতিবাক ব্যাখ্যাও বিদ্যমান, সে ক্ষেত্রে তিনি উল্লেখ করেন,
”Ahimsa is not the crude thing it has been made to appear. Not to hurt any livin thing is no doubt a part of Ahimsa… (Yet) it is not merely a negetive state of harmlessness but it is a positive state of love, of doing good even to the evil-doer” (Quoted in Bondurant, 1958, p. 24).
মূলতঃ তাঁর সমগ্র চিন্তার মূলই হচ্ছে অহিংসা এবং এই ধারণার উপর ভিত্তি করে সে সত্যাগ্রহ ধারণার অবতরণা করেন। তাঁর মতে, “অহিংসাই মানব জীবনের লক্ষ্য এবং সত্য অর্জনের সর্বোত্তম উপায়। সুতরাং অহিংসাই সর্বোচ্চ কর্তব্য, কিন্তু তাঁর কাছে, অহিংসা সর্বোচ্চ কল্যাণ নয়; এটা সত্যের প্রয়োজনীয় শর্ত। সত্যই সর্বোচ্চ মূল্যবোধ। হিংসা সত্যকে ধংস করে। চূড়ান্ত নিশ্চয়তাসহকারে সত্য জানার ব্যাপারে আমাদের অসামর্থ্যের কারণেই, আমাদের সঙ্গে যারা ভিন্ন মত পোষণ করেন, তাঁদের প্রতি সহনশীল হওয়া আমাদের প্রয়োজন।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, সত্যাগ্রহ হিংসার আশ্রয় অনুমোদন করে না কারণ মানুষ চূড়ান্ত সত্য জানতে পারে না, এবং এ জন্যই অন্যদের শাস্তি দেওয়ার যোগ্যতা কোন ব্যক্তির নেই। গান্ধী সর্বাত্মাক অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন, যেখানে অর্ধপথের আশ্রয়ের কোন স্থান নেই। একারণেই গান্ধী অহিংসাকে নৈতিক শক্তি হিসেবে বর্ণনা করছেন এবং আতাত বা আপোষ মীমাংসায় বিশ্বাসী ছিলেন না (Mclean, 2015, p. 373)| তবে গান্ধী এটাও স্বীকার করেন যে, তাঁর স্বরাজ রাষ্ট্রে স্বাধীনতা রক্ষার জন্য হিংসার পথ অবলম্বন করার প্রয়োজন হতে পারে। গান্ধীজি তিন ধরনের অহিংসার কথা বলেছেন; সংস্কারমুক্ত বা অজ্ঞতামুক্ত অহিংসা, গান্ধীর মতে, এমন অহিংসা নীতিতে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে তথা নৈতিক মানদন্ডে হিংসাকে পরিহার করা হয়। এটি শুধু রাজনৈতিক কৌশল নয়, বরং জীবনের সর্বস্তরে পরিব্যাপ্ত হয়; গান্ধী প্রবর্তিত দ্বিতীয় অহিংস নীতি হচ্ছে কৌশলগত অবস্থান কর্মসূচি, যেখানে নৈতিক মানদন্ডে নয়, বরং যৌক্তিক প্রয়োজনে হিংসাত্মক পন্থা অবলম্বনের পক্ষপাতী। তাঁর মতে, “Man for man, the strength of non-violence is in exact proportion to the ability, not the will, of the non-violent person to inflict violence” (Quoted in Mahajan, 1990, p. 960).
গান্ধী তৃতীয় ধরনের অহিংসা হিসেবে ভীরুর ইতিবাচক অহিংসার কথা বলেছেন, যেখানে তিনি উল্লেখ করেন, একজন ভীরু এবং অহিংসা কোনভাবেই সমমুখী হতে পারেন না। কারণ একজন ভীরু শঙ্কার সম্মুখীন না হয়ে পশ্চাতগমণ করে। যাকে তিনি কাপুরুষোচিত, অপ্রাকৃতিক এবং অসম্মানজনক হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এক্ষেত্রে গান্ধী পলায়নবৃত্তির তুলনায় সহিংসতায় লিপ্ত হওয়াকে শ্রেয় বলে গণ্য করেন।
অন্যদিকে গান্ধী, সত্যাগ্রহ বলতে সত্যের প্রতি অবিচল থাকাকেই নির্দেশ করেছেন। ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞা এবং অহিংস পন্থায় লক্ষ্য অর্জনের জন্য কষ্ট স্বীকারের মানসিকতাই সত্যাগ্রহ। অহিংসা এবং সত্য একে অন্যের পরিপূরক। গান্ধীর মতে, অহিংসা এবং সত্য একে অন্যের সাথে এমনভাবে জড়িয়ে আছে বাস্তবে এদের আলাদা করা অসম্ভব। ঊভয়ই মূলত একি মুদ্রার এপিট-ওপিট মাত্র, তাই কেউ এদের কোন নির্দিষ্ট একটিকে পছন্দ করে অন্যটি থেকে নিজেকে বিচ্যুত করতে পারে না। তথাপিও অহিংসা হচ্ছে মাধ্যম এবং সত্য হচ্ছে সর্বোচ্চ পর্যায়। আবার অহিংসা হচ্ছে সর্বোচ্চ কর্তব্য এবং একে যদি আমরা যথাযথভাবে পালন করতে পারি তাহলে নিশ্চিতভাবে সত্য অর্জিত হবেই। যখন উভয়কে আমরা কঠোরভাবে উপলব্ধি বা আকড়ে ধরতে পারবো, তখন চূড়ান্ত বিজয় প্রশ্নাতীত(Quoted in Jahanbegloo, 1992, pp. 18–19)| এর অর্থ হলো, সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য একাগ্রচিত্তে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে এবং অহিংসা ও সঙ্কার সম্মুখীন হওয়ার পথে অগ্রসর হতে হবে।
সত্য প্রতিষ্ঠা বা অন্বেষণ করতে হলে হিংসার অবলম্বন করতে হয় না, কারণ সত্যাগ্রহীর শক্তি কষ্ট স্বীকারের উপর নির্ভর করে। সুতরাং অহিংসা এবং সত্যাগ্রহ প্রয়োগ করতে হলে আত্ম-সংশোধন করা এবং নৈতিক মানদন্ডে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। দৃশ্যতঃ সত্যাগ্রহ এবং নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের মধ্যে সাদৃশ্য থাকলেও গান্ধী এদের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। তাঁর মতে, নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ দুর্বলের অস্ত্র কিন্তু সত্যাগ্রহ সবলের অস্ত্র। সত্যাগ্রহের ক্ষেত্রে গান্ধী বিভিন্ন কৌশলের কথা বলেছেন, যার মধ্যে অনশন; স্বেচ্ছায় দেশ ত্যাগ; অনিষ্টকারীর সাথে অসহযোগিতা তথা অসহযোগ আন্দোলন যার মধ্যে পদক ও সম্মাসসূচক পদ গ্রহণে অস্বীকৃতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন পরিষদ, আদালত, ক্লেশ স্বীকার করা ও বিভিন্ন পণ্য বর্জন অন্যতম; ধর্মঘট; আইন অমান্য অন্দোলন, যাকে গান্ধী সত্যাগ্রহের চূড়ান্ত রূপ বলেছেন। তাঁর মতে যখন সকল কৌশল ব্যর্থ হয় তখনই এই ধরনের চূড়ান্ত কর্মসূচি গ্রহণ শ্রেয়।
গান্ধী ব্যক্তিগত এবং গণ দুই ধরনেই আইন অমান্য আন্দোলনের কথা বলেছেন। তিনি স্বরাজ প্রতিষ্ঠাই অহিংসা এবং সত্যাগ্রহের চূড়ান্ত লক্ষ্য বলেছেন। স্বরাজ বলতে তিনি স্বশাসনকেই বুঝিয়েছেন এবং প্রত্যেক ব্যক্তির নিজেকে শাসন করার অধিকারের কথার মাধ্যমেই তিনি স্বরাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেকে শাসন করার মাধ্যমে এটা উপলব্ধি করবেন যে, সকলের কল্যাণেই নিজের কল্যাণ নিহিত, যা বুদ্ধ তাঁর দর্শনে বারংবার নির্দেশ করেছেন।
তথ্যসূত্র:
করিম, সরদার ফজলুল (২০০২) দর্শনকোষ, পঞ্চম, ঢাকা: প্যাপিরাস।
বড়ুয়া, রুবি এবং বিঃ বঃ (১৯৮৬) গৌতম বুদ্ধ: দেশকাল ও জীবন, প্রথম, ঢাকা: সাহিত্য সমবায়।
Chakma, N. K. (2014). Ohimsa ( Ahimsa ). In Banglapedia: National Encyclopedia of Bangladesh. http://en.banglapedia.org/index.php?title=Ohimsa_(Ahimsa)
Chakma, N. K. (2015). Buddhism. Banglapedia: National Encyclopedia of Bangladesh. http://en.banglapedia.org/index.php?title=Buddhism
Copley, A. (1987). Gandhi : Against the Tide (First). Basil Blackwell Inc.
Erikson, E. H. (1970). Gandhi’s Truth (First). Faber.
Gandhi, M. K. (1994). An Autobiography or The Story of My Experiments with Truth (Second). Navajivan Press. https://doi.org/10.2307/40194291
Gethin, R. (1998). The Foundations of Buddhism (First). Oxford University Press.
Jahanbegloo, R. (1992). Gandhi and the Struggle for Non-Violence. The UNESCO Courier: A Window Open on the World, XLV(6), 18–22. https://doi.org/48223/pf0000091404
Mahajan, V. D. (1990). Recent Political Thought (Seventh). S. Chand Limited.
Siderits, M. (2016). Buddhism as Philosophy: An Introduction. Routledge. https://doi.org/https://doi.org/10.4324/9781315261225
Siderits, M. (2019). Buddha. Stanford Encyclopedia of Philosophy. https://plato.stanford.edu/entries/buddha/
Smith, D. and W. J. (2016). Reading The Buddha as A Philosopher. Philosophy East and West, 66(2), 515–538. https://doi.org/10.1353/pew.2016.0026.
Stefon, M. (2015). Ahimsa. Encyclopaedia Britannica. https://www.britannica.com/topic/ahimsa
UN. (2020). International Day of Non-Violence. United Nations. https://www.un.org/en/observances/non-violence-day
Disclaimer: আল-আমিন, মো:, (২০১৯) “অহিংসা ও মানবতাবাদ: মহাত্মা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা,” তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি জার্নাল, দ্বিতীয় বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, পৃ. ৭৫-৯৫। প্রবন্ধের অংশ বিশেষ।