ক্রিকেট আমার বিষয় না। আমি এই খেলাটা খুব ভালো বুঝিও না। তবে আপনারা জেনে অবাক হবেন ঘরোয়া ক্রিকেটে একদা আমার বেশ দাপট ছিল। এক সময় পাড়ায় পাড়ায় ক্রিকেট বাজি হলে আমার ডাক পড়তো। বিশেষ বিশেষ শর্তে আমি সেসব খেলায় অংশ নিতাম। দু একবার জয়ের নায়ক(খল) ছিলাম আমি। টেকনিকে পছন্দের দলকে জিতিয়েছি। পরে কয়েকটি মারামারির পর আমার ক্রিকেট চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। আমি ক্রিকেট থেকে ফিরে আসি। পড়াশোনায় মনোনিবেশ করি। যারা শৈশব-কৈশোরে আমাকে জানেন তাদের কেউ কেউ আমার এই গুণটি জেনে থাকবেন। আমি কী ছিলাম? না, বোলার না। ব্যাটসম্যান? নারে দাদা, দিদিরা। ব্যাট হাতে কখনো দাঁড়াইছি মনে পড়ে না। মূলত আমি ছিলাম স্কোরার! হাতের লেখা সুন্দর ছিল বলে পোলাপান সমীহ করে স্কোরার হিসেবে খেলায় নিয়ে যেতো। উপরন্তু ক্লাস ক্যাপ্টেন থাকায় আন্তঃস্কুল খেলাতেও আমার নামটি গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হতো। আমি ‘দুধভাতের’ মতো পাকা খেলোয়াড়দের মনোযোগ আকর্ষণ করতাম। বস্তুত, খেলাধুলায় আমি ছিলাম অদরকারি উপদ্রব। তবু বন্ধুরা পাশে রাখতো। ভুলভাল স্কোর করে দুই একবার পছন্দের দলকে জিতিয়ে দিলাম। এরপর লাগলো মারামারি! সেই মহামারির পরই আমি ক্রিকেট থেকে চিরতরে অবসর নিলাম!
১৯৯৯ সালে আমরা ছোট মানুষ। কিছু কিছু বুঝি। একটু মনে আছে : কোনো এক খেলায় সামান্য বৃষ্টি হয়েছিল। খেলা শুরু হতে সামান্য দেরি হচ্ছিল। ঐ সময়টা শান্ত-আকরাম খানরা ওয়ানডে/টেস্ট স্ট্যাটাসের জন্য/ বিশ্বকাপে খেলার জন্য আইসিসির দিকে তাকিয়ে। তারা চেষ্টা করছে। বৃষ্টিবিঘ্নিত খেলাটি যেন পরিত্যক্ত না হয় সেজন্য বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা নিজেদের জন্য বরাদ্দ তাওয়াল দিয়ে ক্রিজের পানি মুছেছে! একটা মাম পানির হাফ লিটার বোতলের জন্য তাঁরা তীর্থের কাক হয়ে মাঠে থেকে ম্যানেজমেন্টের দিকে তাকিয়ে থাকতো! আজকের দিনে এমন কিছু কল্পনাতেও আসবে না। কতোটা দুঃসহ সময় তাদের গিয়েছে কোনো এককালে। তারপর বুড়িগঙ্গায় কতো জল গড়াল! বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাদের দাপট দেখাল। ধীরে ধীরে হোয়াইট ওয়াশ হয়ে উঠলো বাংলাওয়াশ! ক্রিকেটের বিশ্বমোড়লদের নাকানি চুবানি দিল আমাদের আশার ফুল আশরাফুলরা! রফিকের সরলতায় বাংলার সহজিয়া রূপটি কতোই না স্পষ্ট হতো! বেচারা ইংরেজি জানতেন না। তাঁকে কয়েকবার বাঁচিয়েছেন আতাহার আলী কিংবা সতীর্থরা। একটা ইংরেজি শব্দও তিনি বলতে পারতেন না! একজন যোদ্ধা মাশরাফি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ছেঁড়া লিগামেন্ট তুচ্ছ করে খেলে গেছেন দেশের জন্য। একবার কোনো এক খেলায় তামিম তো একহাতে খেলেই বাজিমাত করলো। বিস্ময়বালক সাকিব ক্রিকেট দুনিয়াকে নতুন করে ভাবতে শেখালো। বিশ্বক্রিকেটে টানা কয়েকবার সে হলো এক নাম্বার অলরাউন্ডার। ব্যাটে, বলে তার দারুণ পারফর্মেন্স সত্যিই দৃষ্টিকাড়া। মাহমুদউল্লাহ-মুশফিক দুই ভাইরার দাপটে বাইশ গজের ক্রিজ যেন আদরণীয় শ্বশুরালয়। বাংলাদেশ খেলে, বিশ্ব অবাক তাকিয়ে রয়!
আঠারো কোটি মানুষের আবেগ আর ভালোবাসা মিশে আছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। আমাদের জীবনে আনন্দ নাই। আমাদের বাজার নষ্ট, ক্ষেত নষ্ট, রাজনীতি নষ্ট। আমাদের খেলা এখন রাজনীতির মাঠে! খেলারামগণ চিৎকার করে বলে- ‘খেলা হবে’! এরপর এ ওরে ডাকে, সে তারে ডাকে! আমরা লজ্জায় মরি। আমাদের মরিচ কিনলে শুটকি কেনা হয় না, পাঙ্গাশ মাছটাও চলে গেলো হাতছাড়া হয়ে! ব্রয়লার গেছে, পেঁপেঁ গেছে, আলু-বালু সব গেছে! শীত গেছে, বর্ষা গেছে, বৃষ্টি গেছে, আষাঢ় গেছে। পৌষ গেছে, মাঘ গেছে, চৈত্র আসে অসময়ে। পাট গেছে পাঠার দখলে, ভোট গেছে ভুট্টোর দরবারে। কচুগাছ, কলাগাছ আগে খাইতো শুয়োরে, এখন খায় মানুষে। ঘুষ-ঘাস-সুদ-বাঁশ ছাগলের খাদ্য, প্রিয় বদ্বীপে বাজে অসুখের বাদ্য। কে দিবে আশা, কে দিবে ভরসা?
শত হতাশার মাঝেও বিদেশের মাটিতে যখন বেজে ওঠে বিউগলের করুণ সুর- আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি…আমাদের চোখ চিকচিক করে। আমাদের হৃদয়ে ধ্বনিত হয় একটি স্লোগান- আজ জিতবোই! শেষ একটি বলে যদি লাগে দশ রান তখনো আমরা স্বপ্ন দেখি দুটি নো বলের, তার সাথে একটি ছয়, একটি চার!!! আমরা খেলোয়াড়দের একলা ফেলে টিভি সেট ছেড়ে উঠি না। সাথেই থাকি। এর নাম লেগে থাকা। জিতলে মিছিল করি। হারলে তাদের বাড়িঘরে আগুন দিই না। আশায় বুক বাঁধি একদিন করব জয়- উই শেল ওভারকাম সাম ডে….!
চোখের সামনে আমাদের খেলোয়াড়রা কোটিপতি হলো। কতোজনের পূর্বাচলে প্লট হলো, ঢাকায় ফ্ল্যাট হলো, সুন্দর নারী হলো, গাড়ি হলো! এই দেশের দর্শকদের কী হলো? নাথিং! আমাদের বাড়িগাড়িফ্ল্যাট কিছুই নেই। আমরা দিন দিন আরো ফকির হয়েছি। ত্রিশ বছর আগের গরিব আর আজকের গরিবে ব্যাপক পার্থক্য। জাতীয় মাছটার নাম নিতেও এখন ভয় করে! বেশি না পাঁচ! দেড় কেজি ওজনের একটা ইলিশ এখন পাঁচহাজার টাকায় পাওয়া কঠিন! অথচ, সাকিব-তামিমরা এই চোখের সামনে বড় হলো। না করলো পড়ালেখা, না করলো টিউশনি, না দিল বিসিএস! তারপরও সাকিব সম্ভবত শত কোটি টাকার মালিক! খেলাটা ছাড়া তার কাছে আর সবই বড় রকমের খেলা। সে উদ্ভট আচরণ করে, দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেয়। যখন তখন দল ত্যাগ করে, দেশ ত্যাগ করে! তাকে কিছু বললেও মাইন্ড করে, না বললেও মাইন্ড করে। তাদের রাগ ভাঙান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! এই দেশের ১৫০০০ শিক্ষা ক্যাডার সদস্য জিম্মি হয়ে আছে তাদের খোঁজ কে নেয়? শিক্ষার কী হাল তা কে জানতে চায়? অথচ পারিবারিক ঝগড়া মেটান দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহী ব্যক্তি! ছোটবেলায় স্কোরার না হয়ে ব্যাটবল ধরলে ভালো করতাম!
পাড়ার ক্রিকেটারদের মতো এরা ঝগড়া করে। একজন আরেকজনের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ায়। দেশের স্বার্থের চেয়ে এদের কাছে বড় ব্যক্তিস্বার্থ, নিজের জেদ, আত্মঅহমিকা! এই হলো ক্রিকেট! ভদ্রলোকের খেলা। বাঙালির আর কিছু না হোক টাকা হলে গরিমা বাড়ে। এদেরও তাই হয়েছে। যেসব সাধারণ মানুষ একটি ব্রয়লার মুরগি কিনতে পারে না সেসব মানুষের ভ্যাটের টাকায় এদের বেতন হয়! অথচ ভাবখানা দেখলে মনে হয় তারা লাটসাহেবের পুত্র সবাই? দেশের মানুষের কথা ভাবলে কোনো খেলোয়াড়ই (রাজনীতির অথবা ক্রিকেটের) বেপরোয়া হতে পারতো না। বোর্ডগুলো চলে রাজনৈতিক ইশারায়। ফুটবল তো ডুবেছে এক নির্লজ্জ ‘আইরন ম্যান’ এর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে। ক্রিকেটেও অলরাউন্ডারের ছোঁয়া লেগেছে।
ফিল্ম জগতের আরেক হিরো, স্বঘোষিত নাম্বার ওয়ান সেও প্রথম শ্রেণির ফ্রট। ৪০ লাখে চুক্তি করে এখন চাচ্ছে এক কোটি। দেশের চলচ্চিত্রের রাহুর দশা যখন তুঙ্গে তখন এই মহাত্মা তার ফি বাড়িয়ে বাঙালি তাওহিদি জনতার বিরাট উপকার করলেন। আগামি বছরের মধ্য বাংলাদেশে হল থাকবে বড়জোর ৬৩ টি! (২০০৪ এ দেশের ৬৩ জেলায় বোমা হামলা হয়। সেসব ‘পুণ্য’ স্থান ছাড়া আর কোথাও হল থাকবে বলে মনে হয় না)! যে বাঙালি একটা ব্রয়লার কিনতে পারে না তার আবার সিনেমা দেখা! হলগুলো বন্ধ হলে মেগাস্টার বাটপার দুই রমণী নিয়ে চলে যাবে ময়নাদ্বীপে! সেখানে রোমান্স করবে আর হালি হালি পোলা পয়দা করবে! যারা তাকে হাফ লেডিস বলেছিল তারা তো শরমে মোমের মতো গইলা গেছে। ভবিষ্যতে আরো গলবে।
বাংলাদেশে এতো এতো নাম্বার ওয়ান জিনিসের ভিড়ে আসল মানুষটা কই? বলতে পারবেন? এদের বিপুল পরিমাণ টাকাগুলো বাঙালির কোন কামে লাগছে একটু জানাবেন? শিক্ষায়, চিকিৎসায়, মানুষের জীবন মান উন্নয়নে তারা কি ফিতা কাটতে পেরেছেন?
শৈশবে নুরু নামে এক ছেলের সন্ধান পেয়েছিলাম। সে একবার একটা টুর্নামেন্ট ছাড়ল। নাম খুঁজে পেলো না। তখন চিন্তা করল নাম নিয়ে এতো চিন্তার কী আছে? টুর্নামেন্টের নাম হলো : ‘নুরু স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট!’ তখন নুরুকে দেখেই বুঝেছিলাম মানুষ বেঁচে থাকতেই স্মৃতির পাতায় চলে যায় তার বোকাচোদা চিন্তার কারণে!
বাংলাদেশের ফুটবল তো নুরুর দখলে, ক্রিকেটে আর নুরুরা না আসুক! খেলোয়াড় যেমনই হোক, মানুষ তৈরি হোক। খেলোয়াড় তৈরি করা যায়, মানুষ তৈরি করা যায় না!!!