আমি আর বাবা একই সঙ্গে স্কুলে যেতাম। উত্তরবঙ্গের এক অজ পাড়া গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে বাবার চাইনা ফনিক্স বাই সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারে বসে প্রকৃতির অপরূপ শোভায় বিভোর হয়ে কখন যে স্কুলে পৌঁছে যেতাম তা কখনও টেরই পেতাম না। প্রকৃতি কী অকৃপণভাবে তার রূপ, রস, শব্দ, গন্ধ সেই পথটায় ছড়িয়ে দিয়েছিল; তখনকার সেই কিশোর মনে যে ছাপ পড়েছিল, তা আজও নিজের অস্তিত্বে বহন করে চলেছি।
স্কুলে পৌঁছে বাবা যথারীতি চলে যেতেন শিক্ষক লাউন্সে আর আমি চলে যেতাম আমার ক্লাস রুমে। বাবা ছিলেন বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষক। কিন্তু তিনি ক্লাস নিতেন অনেক বিষয়েই। বাংলা ও সামাজিক বিজ্ঞান এ দুটি ক্লাসে তাঁকে শিক্ষক হিসেবে পেতাম। পুত্র বলে কোনো অনুকম্পা কখনোই তাঁর চোখের সমুদ্রে খেলা করতে দেখিনি। পড়া না পারলে তিনি তেমন কিছু বলতেন না, শুধু বলতেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত পড়া তৈরি না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়া তৈরি কর এবং তারপর পড়া দিতে পারলেই তুমি বসতে পারবে।’
অন্যান্য সব স্টুডেন্টদের বেলায় কিছুটা পক্ষপাত থাকলেও আমার বেলায় তা ছিল শূন্যের কোঠায়। এজন্য বাবার প্রতি আমার কোনো অনুযোগ বা অভিযোগ কিছুই ছিল না। কারণ তিনি ছিলেন আমার ‘হিরো বাবা’।
ক্লাস নাইন পর্যন্ত বাবা আমাকে তাঁর বাইসাইকেলের সম্মানিত সদস্য হিসেবে স্কুলে নিয়ে যেতেন এবং আসতেন। তারপর দশম শ্রেণিতে উঠলে আমার বাবার স্থান হলো সামনের রডে আর আমার স্থান হলো চালকের আসনে। এ ভাবেই আমাদের দু’জনের সময় খুব ভালোই কেটে যাচ্ছিল।
বাবা কখনোই আমাকে উপদেশ দেওয়া বা কোনো বিষয়ে জোর করে নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন তা। বাবা হয়তো মনে করতেন,
‘দেখিনা, স্বাধীনতা দিয়ে!’
বাবার সেই স্বাধীনতার সুখ আমি পুরোটাই গ্রহণ করেছি আমার জীবনে। ফলে তাঁর মধ্যে সুপ্ত যেসব ইচ্ছে ছিল আমাকে ঘিরে সেগুলোর প্রকাশ কোনোদিনও তিনি আমার কাছে করতেন না।
এস. এস. সি পর্যন্ত গ্রামেই কাটে আমার জীবন। বড় সুস্থির আর স্বপ্ন সুখের মতো মধুর ছিল সেই দিনগুলি। একসময় কলেজে পড়ার জন্য প্রথম পা দিই গ্রামের বাইরে। সেটা অন্য জেলায় অবস্থিত একটি কলেজ। সেখানকার পরিবেশ এবং পড়াশুনার মানের কথা চিন্তা করেই সেই কলেজে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে জাগে আমার।
বাবা আমাকে সেখানে পড়ার ব্যাপারে কিছুই বললেন না। কিন্তু কেমন জানি তিনি বিষণ্ন হয়ে গিয়েছিলেন। একই সাথে বসবাসের অভ্যাসের পরিবর্তন হয়তো তাকে ভাবিয়ে তোলে।
তাছাড়া ভালোবাসার প্রসঙ্গ তো রয়েছেই। অবশেষে সেখানেই ভর্তি হলাম। মাঝে মাঝে ছুটিতে বাড়ি এলে বাবার আদরে আর ভালোবাসায় আমি কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠতাম। ছুটি শেষ হয়ে গেলে দুজনার মনের মধ্যেই কেমন একটা বিষণ্নতার ছায়া ঘনিয়ে আসতো। কিন্তু আমরা তা প্রকাশ করতাম না।
কলেজে গিয়ে প্রথম কয়েক দিন লাগতো ভীষণ খারাপ। বারবার বাবাকে মনে পড়তো। কিন্তু সেই সময় ফোনে কথা বলার মতো সুযোগ ছিল না। তাই স্বপ্ন-কল্পনায় সাক্ষাৎ হতো বাবার সঙ্গে। মাঝে মাঝে একটা সুর ভেসে আসতো। যা আমাকে স্বর্গের কাছাকাছি নিয়ে যেত-
‘মন্দ হোক ভালো হোক, বাবা আমার বাবা, পৃথিবীতে বাবার মতো আর আছে কেবা?’
একসময় কলেজ জীবন শেষ করি। প্রশ্ন আসে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বো। বাবার পছন্দ বিভাগীয় শহরে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু আমার পছন্দ ছিল রাজধানীতে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। এবারও বাবার মতামতকে অগ্রাহ্য করে ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে বুঝতে পেরেছিলাম, বাবা কেন চান আমি বিভাগীয় শহরে অবস্থিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। হয়তো তিনি ভাবতেন, বাড়ির কাছাকাছি বলে যে কোনো সময় তিনি না হয় আমি সাক্ষাৎ করতে পারবো। পরে যখন বুঝলাম, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আর ফিরে যাবার উপায় ছিল না।
বাবা পড়তে ভালোবাসতেন এবং পড়াতেও। তাই যখনই বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হতো বাবার জন্য তখন আবশ্যকীয় কাজ ছিল তাঁর পছন্দের কিছু বই বাড়িতে নিয়ে যাওয়া। তিনি যেসব বই পছন্দ করতেন সেগুলো নিয়ে হাজির হতাম বাড়িতে। তারপর তিনি বুঁদ হয়ে যেতেন বই নিয়ে আর রাতের বেলায় বসতেন আমার সঙ্গে আলোচনায়। তাঁর ক্ষুরধার যুক্তি আমাকে অবাক করতো। মনে হতো, বাবা এত জানেন কীভাবে?
তিনি জটিল বিষয়গুলি এত অনায়াসে আমার কাছে ব্যক্ত করতেন যে, আমি ‘থ’ হয়ে যেতাম। এই আমার বাবা, মনে মনে গর্ববোধ করতাম। এছাড়াও তিনি আলোচনা করতেন, এই পশ্চাৎপদ গ্রামীণ শিক্ষাব্যবস্থাকে কীভাবে টেনে তুলবেন। মাঝে মাঝে পারিপার্শ্বিক অবস্থা তাঁকে হতাশ করলেও আবার তিনি আশায় বুক বাঁধতেন এবং বলতেন,
‘একদিন পরিবর্তন আসবেই। তখন আমি না থাকলেও তোরা তো রইলি। কি পারবি না আমার অসমাপ্ত কাজকে এগিয়ে নিতে?’
বাবার কথা শুনে আমার কান্না চলে আসতো। অনেক কষ্টে চোখের অশ্রুবিন্দুকে আটকিয়ে বলতাম,
‘কী বল বাবা? দেখ, তুমি অনেক পরিবর্তন আনতে পারবে এবং তা দেখেও যেতে পারবে।’
আমার কথায় বাবা আশ্বস্ত হতেন কি না জানি না। তবে হয়তো মনে জোর পেতেন।
আমি তখন চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। বাড়ি থেকে হঠাৎ খবর এল,
‘এখনি বাড়ি চলে আয়, বাড়িতে তোর ভীষণ দরকার।’
মনে মনে অনেক বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম। কী এমন হতে পারে যে বাড়িতে এত জরুরি তলব। কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছিলাম না, কী হতে পারে?
অনেক উৎকণ্ঠা আর শঙ্কা নিয়ে বাড়িতে গিয়ে দেখলাম, সাদা কাফনে মোড়া একটি লাশ। বুঝতে আর বাকি রইলো না। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। ইচ্ছে করছিল চিৎকার করে কান্নাকাটি করি। কিন্তু কোনো পাথর যেন সেই জলের ধারাকে আটকে রেখেছিল। ভাবতেই পারছিলাম না আমার বাবা আমাকে এভাবে একা রেখে চলে যাবেন! বুকের ভেতরে যে শূন্যতা হাহাকার করে উঠছিল তা আজও আমি সযত্নে লালন করে যাচ্ছি।
অনেকের বাবা স্বপ্ন দেখেন, তাঁর ছেলে অনেক বড় কিছু হবে। গোটা দেশের একজন নামকরা ব্যক্তি হিসেবে সন্তান বাবাকে করবে সম্মানিত। কিন্তু বাবা আমাকে কোনোদিন বলেননি, তুই এটা হবি, ওটা হবি। তবে তিনি একবার বলেছিলেন, ‘জন্মসূত্রে যেন মানুষ না হও, মানুষ হতে হলে কর্মসূত্রেই হয়ো।’
ওপারে কেমন আছ বাবা? আমার কথা মনে পড়ে কি তোমার? দেখে যাও, তোমার ছেলে কিছুই হয়নি। হয়েছে সামান্য একজন মাস্টার। হয়তো তোমার রক্তই আমাকে এ পথে টেনে এনেছে। কিন্তু তাই বলে ভেবো না আমি অসুখী। আমার ভালোলাগে পড়তে এবং পড়াতে ঠিক তোমারই মতো। তোমার মতোই স্বপ্ন দেখি। তাই কবি গুরুর মতোই বলতে ইচ্ছে করে,
‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও।
আপনাকে এই লুকিয়ে-রাখা ধুলার ঢাকা
ধুইয়ে দাও।
যে জন আমার মাঝে জড়িয়ে আছে ঘুমের জালে
আজ এই সকালে ধীরে ধীরে তার কপালে
এই অরুণ আলোর সোনার-কাঠি ছুঁইয়ে দাও।
বিশ্বহৃদয়-হতে ধাওয়া আলোয়-পাগল প্রভাত হাওয়া,
সেই হাওয়াতে হৃদয় আমার নুইয়ে দাও।।’