প্রথম পাতা » গল্প » ভাঙ্গারী সুখ

ভাঙ্গারী সুখ

আমাদের বাড়ির পাশেই একটা ভাঙ্গারীর দোকান আছে৷ ছোটবেলা থেকেই এই ভাঙ্গারীর দোকান আমরা দেখে আসছি৷ আরো একটা দোকান ছিল৷ বয়স্ক করে একজন লোক ঐ ভাঙ্গারীর দোকানের মালিক ছিল৷ সে দুপুরবেলা দোকানে বসে নাকে গামছার কোণা ঢুকিয়ে হাঁচি দিত। ঐ দোকান এখন আর নাই৷ এখন যে ভাঙ্গারীর দোকানটি আছে সেটার মহাজন মিজান নামে চল্লিশোর্ধ্ব এক লোক৷ মিজানের এই দোকানে প্রায় ১৫ জনের মতো কর্মচারী কাজ করে৷ এরা সবাই বিভিন্ন জেলার লোক৷ দূর দুরান্ত থেকে এখানে এসেছে কাজের তাগিদে৷ ভাঙ্গাচোরা মালামাল এই এলাকার আশেপাশে বেশি পাওয়া যায় আর ঢাকার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভালো তাই হয়তো এখানে ভাঙ্গারীর ডেরা বসিয়েছে মিজান মামা৷ আমরা উনাকে মিজান মামা ডাকতাম৷

গ্রামের ভাঙ্গারী দোকান আর শহরের ভাঙ্গারী দোকানের মধ্যে পার্থক্য আছে৷ গ্রামের ভাঙ্গারীওয়ালা কাঁধে বাখারিতে দুইটি বাঁশের ঝুড়ি ঝুলিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়৷ একটা ঝুড়িতে থাকে শন পাপড়ি বা হাওয়াই মিঠাই৷ আরেকটা খালি৷ হাতে থাকে পিতলের ঘন্টি৷ সারাদিন ঘুরে ঘুরে শন পাপড়ির বিনিময়ে লোহা লক্কর, প্লাস্টিকের জিনিস পত্র, পুরাতন সাইকেল থেকে শুরু করে পুরাতন টায়ার টিউব, টিন ইত্যাদি সংগ্রহ করে সন্ধ্যার দিকে দুই ঝুড়ি ভর্তি করে দোকানে ফিরে৷

দোকানে ফেরত আসলে মিজান মামা সেসব পুরাতন জিনিস পত্র দোকানের আড়কাঠ থেকে ঝুলানো বড় একটা দাঁড়িপাল্লা দিয়ে মেপে মেপে নেয় আর হিসাবের খাতায় পরিমান আর টাকার হিসাব লিখে রাখে৷ এভাবে ১৫ জনের মালামাল মেপে নেয় আর হিসাব খাতায় লিখে রাখা হয়৷ দিনের টাকা দিনে দেয়া হয়না এই কর্মচারীদের৷ অনেক মালামাল জমা হলে একদিন তিন টনী বা পাঁচ টনী একটা বা দুইটা ট্রাক আসে৷ ভাঙ্গারীর মালামাল ধরণ অনুযায়ী বস্তা করে আলাদাভাবে ট্রাকে তোলা হয়৷ এই মালামাল ঢাকার বড় মহাজনের কাছে বিক্রি করে মিজান মামা৷ বিক্রি করে টাকা পেলে তারপর টাকা পরিশোধ করে কর্মচারীদের৷

মিজান মামাসহ বাকি সবার রান্নাবান্না হয় দোকান ঘরের ভেতরে৷ গ্রামের এক মহিলা এসে ১৫ জনের রান্না করে দিয়ে যায়৷ তিন বেলা৷ খেয়েদেয়ে রাতে তারা এই বড় টিনের দোকান ঘরেই ঘুমায়৷ রাতে খাওয়ার আগে সন্ধ্যার দিকে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে শন পাপড়ি বানানোর জন্য৷ ময়দা, চিনি দিয়ে মাটির চুলায় মন্ড বানিয়ে পাটিতে নিয়ে হাত দিয়ে টেনেটেনে শন পাপড়ি বানানো আমি আগ্রহ নিয়ে দেখতাম ছোটবেলায়৷ শন পাপড়ি বানানো শেষ হলে শুরু হয় ভাগ বাটোয়ারা৷ সবাইকে চাহিদা অনুযায়ী শন পাপড়ি দেয়া হয়৷ যার যার শন পাপড়ি পলিথিনের ব্যাগে মুড়িয়ে ঝুড়িতে সাজিয়ে রেখে তারপর তারা রাতের খাবার খায়৷ সকাল সকাল বের হয়ে যায় শন পাপড়ি নিয়ে৷

ভাঙ্গারী মালামাল যেদিন ট্রাকে করে ঢাকায় নেয়ার দিন আসে সেদিন একদিকে বিভিন্ন রকমের গান বাজতে থাকে আর অন্যদিকে চলতে থাকে মালামাল ট্রাকে লোড করা৷ “গাঙ যদিও যায় শুকাইয়া, মুছে না তো গাঙ এর র‍্যাক (চিহ্ন বা গঠন)”, “আমি বিয়ে করবো এক গরীবের মেয়ে, যে ভালোবাসবে আমায় একবেলা খেয়ে’, “প্রেমের কি জ্বালা তোরা দেখরে” এধরনের গান বাজতে থাকে একটার পর একটা৷ শুধু আজানের সময় বন্ধ হয়ে যায় গান৷ গানের তালে তালে অনেক কর্মচারীকে নাচতেও দেখা যায়৷ এই ট্রাক ঢাকায় গেলে কিছুদিন পরেই হাতে টাকা আসবে৷ টাকা নিয়ে প্রায় এক বছর পর বাড়িতে যাবে সবাই৷ গাঙ এর র‍্যাক এক বছরে মুছে যাওয়ার কথা না ৷

গল্প থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *