প্রথম পাতা » গল্প » হলুদ প্রজাপতি

হলুদ প্রজাপতি

Himu

টিউশন থেকে ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা। এই টিউশনটা বেশ দূরে। মিরপুর ১৪ থেকে ফিরতে বহু ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়। তবু তো ছেড়ে দেওয়ার উপায় নেই। সবেধন নীলমণির মতো এই একটি টিউশনই এখন ভরসা। চার হাজার পাঁচশ টাকা এই বাজারে কিছুই না। তবু এই টাকাটার কতোই না মূল্য ! বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স শেষ করা একটা বেকার যুবকের কাছে এই শহর যে কতো নিরানন্দ তা অনেকের কাছেই রূপকথার মতো লাগবে। রাহাত রূপকথার কোনো রাজপুত্র নয়। তবু তার জীবনটা পাতালপুরীর রহস্যঘেরা এক অদেখা ভুবন। এ জীবনের সমস্তই ক্লেদাক্ত। কোথাও সৌরভ নেই, আছে কদর্য দুর্গন্ধময় গ্লানি। রাত এগারোটার পর নীলক্ষেতে মাসে একবার ভালো খেয়ে হেঁটে যেতে বেশ লাগে। এ সময় জীবনের অতি উচ্চ ভাবনাগুলো দলবেঁধে একত্র হয়। একটা সুন্দর সাজানো সংসার। ছোট্ট একটা জগতের স্বপ্ন। এ স্বপ্নটা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একজন মানুষ দেখতে পারবে না? এ এমন কী যে এই স্বপ্নটা দেখতেও তার বিষম খেতে হয়! জীবনের বড় আয়োজন সে প্রত্যাশা করে না। যাদের জীবন খুঁড়িয়ে চলে তাদের জীবন সহসাই দ্রুতগামী হয় না। জীবনটা বাংলা সিনেমার বেবিট্যাক্সি নয় যে ঘুরতে ঘুরতেই মার্সিডিজের চাকায় রূপ নেবে।

সাড়ে চার হাজার টাকার মধ্যে রাহাত দুইশ টাকা খেয়েছে রাতে। হাতে আছে বিয়াল্লিশ শ। মিহিরকে দিতে হবে বারশ। তিন হাজার টাকায় এক মাস! গত মাসেও বারশ টাকা ঋণ করতে হলো। একটা আবেদন ছিল। মাঝে মাঝে চাকরির আবেদন করতে হয়। এখন মাস্টার্স শেষ। বেকারের খাতায় নাম চলে গেছে। অমিভাই বলতেন, অনার্সের পর টিউশন হারাম। অথচ মাস্টার্সের পরও হারাম কাজটা দিব্যি করে যাচ্ছে রাহাত। উপায় নাই। এই টিউশনটা না থাকলে আরো আগেই তাকে ঢাকা ছাড়তে হতো। ঢাকা ছেড়েই বা সে যাবে কোথায়? বোনের বাসায়? ওটাও যে বাসা তা নয়, নরক! বোনকে একটা ফোন দেওয়া দরকার। এতো রাতে ফোন দেওয়া কি ঠিক হবে? দেই একটা ফোন! আল্লাহ ভরসা। তার বোনজামাই ধরবে নিশ্চিত। বোনের কাছে কোনো ফোন এলে দুলাভাই আগে ফিল্টার করে নেয়। তারপর বোন পায়।

ফোনে রিং হচ্ছে।

– কে? আপা?
– না। তুমি কে?
– আমার নম্বর তো সেভ থাকার কথা। স্ক্রিন কি নষ্ট দুলাভাই?
– এতো রাতে? এতো রাতে ফোন করছো কোন আক্কেলে? রাত ১১. ৪৫ এ কোনো ভদ্রলোক ফোন করে?
– করে। যারা বিপদে পড়ে তারা করে।
– তোমার কী বিপদ?
– আমাকে ছিনতাইকারী ধরেছে দুলাভাই। পঞ্চাশ হাজার টাকা মুক্তিপণ চায়। এই মুহূর্তে পারবেন আমাকে ছাড়িয়ে নিতে? নেন একটু কথা বলেন। দুলাভাই চাপাস্বরে হ্যালো হ্যালো বলতে বলতে কেটে দিলেন। নেটওয়ার্কের সমস্যা হচ্ছে বললেন। আগামী একমাস এই নেটওয়ার্ক আর কাজ করবে না।

দুর্ঘটনাগুলো ঘটেও দ্রুত। বাবা মারা গেলেন মাস ছয়েক আগে। তিনি মারা যাননি। বেঁচে গেছেন। বোনের বাসায় ছিলেন আমৃত্যু। বাবা আমার বাবা। পরগাছার মতো জীবনটা কাটিয়ে চলে গেলেন। উপভোগ করতে পারেননি কিছুই। সুনীলের কবিতার মতো লাঠি লজেন্স, রয়েল গুলির জন্য সারাটা জীবন আর্তনাদ করেছেন। ধরতে পারেননি কোনোটাই। মা মারা যাওয়ার সময় বাবাকে শপথ করিয়েছিলেন তিনি যেন আর বিয়ে না করেন। বাবা শপথ রক্ষা করেছিলেন। পনেরটি বছর তিনি একা কাটিয়েছেন। আমাদের মাতৃ-পিতৃস্নেহে লালন করেছেন। শেষ দুটি বছর বাবা প্যারালাইজড হয়ে যান। তখন তার ভার পড়ে বোনের ওপর। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে নিতে হয়েছে। এই দুই বছরে কয়েকবার তালাকের বন্দোবস্ত হয়েছে। দুলাভাই ঝঞ্ঝাট পছন্দ করেন না। নীরবে থাকতে চান। তারও দুটি ছেলে আছে। ছোট চাকরি করেন। নিজের সংসার চালানোটাই তার জন্য কষ্টকর। এর মধ্যে একজন অর্ধমৃত মানুষকে দেখভাল করা সত্যিই বিরক্তের। শেষবার সব ঠিক হলো ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে। আমি গোপনে তার অফিসে চলে গেলাম। আমার দুঃখী বোনটার জন্য আমি কিছুই করতে পারছি না। পড়ালেখা বাদ দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই, অথচ ছয়টা মাস পার হলেই কিছু না কিছু একটা হবে। এমন সময় কারো পায়ে পড়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। দুলাভাই সত্যি সত্যি মহত্ত্ব দেখালেন। আমি সেদিন ভাঙা গলায় শুধু এ অনুরোধটুকু করেছিলাম, আমার বোন যেন এ কথা না জানে। ও সহ্য করতে পারবে না। দুলাভাই হয়তো কথা রেখেছিলেন। আমার চরম অপমানের কথাটি তিনি কাউকে বলেননি।

বাবার মৃত্যুসংবাদে আমি খুশি হলাম। আমার বোনের সংসারটি টিকে গেলো সেই খুশি। আমার বাবাও অপমানের জীবন থেকে মুক্তি পেলো সেই আনন্দেও আমি আনন্দ-অশ্রু বিসর্জন করলাম। বাবাদের বোনের বাড়িতে থাকতে নেই, অন্তত এটুকু বুঝেছিলাম। এ কথাকে আমি ফিলসফিক্যাল ট্রুথ বলবো না। পৃথিবীতে বহু বোনজামাই ভালো থাকতে পারে। ছেলে বেঁচে থাকতে বাবাকে বোনের বাড়িতে রাখার মতো বিড়ম্বনা আর নেই। আমি কি জীবিত? একে কি বেঁচে থাকা বলে? গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসগুলোতে আমার সময় কাটে সাড়ে চার হাজার টাকার হিসাব মেলাতে মেলাতে। প্রতিটা রাত কাটে সকালে কতো কমে নাস্তা করলে দুপুরে একটু মাছ মাংস খাওয়া যাবে! আমার কোনো দিবস নেই। কোনো আনন্দ উৎসবে আমার অংশগ্রহণ নেই। প্রেম নেই। রাগ অভিমান নেই। প্রয়োজনীয় বইগুলিও কিনে পড়তে পারি না। এর ওর কাছ থেকে ধার করে, ফটোকপি করে, লাইব্রেরি, সেমিনারে গিয়ে গিয়ে কোর্স শেষ করি। রেজাল্টও তেমন ভালো না। টেনেটুনে সিজিপিএ থ্রি! এটি আসলে কোনো জীবনই না। জীবন অন্য জিনিস। পতঙ্গের চেয়েও নিকৃষ্ট জীবন আমার। শেয়াল কুত্তার জীবন যাকে বলে আরকি! একটা জাদুর শহরে এসে কোনো রূপার কাঠি, সোনার কাঠি আমাকে স্পর্শ করেনি। আমি লৌহখণ্ডও হতে পারিনি। আমার জীবন নিরুত্তাপ, বিষণ্ন। কেবলই টিকে থাকা। জীবন মানুষকে কোথায় নিয়ে গেছে! কেউ কেউ এ জীবনকে কতো রকম করে আলোড়িত করে ফেললো। অথচ কী করলাম! যোগ্যরাই এখানে টিকে থাকবে। ব্যর্থরা বিদায় নেবে। আমার বিদায়ের পালা। আমি পারিনি জীবনকে সাজাতে।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার নারী। কেউ তো পাঁচবছরে একটিবারের জন্য হাতটা বাড়িয়ে দেয়নি। এদের প্রতি আমার কি কোনো মোহ থাকতে নেই? কতো হাজার হাজার প্রেম হলো মানুষের সাথে মানুষের। একটা প্রেমও কি হতে পারতো না! একটি নারীকে ভালোবাসার মতো যোগ্যতাও আমার তৈরি হয়নি। পৃথিবীর কোনো আয়োজনেই আমি নেই। আমার থাকার অধিকার নেই।

মায়ের মুখ আজ আর মনে পড়ে না। বাবার ঝাপসা চোখ দুটি স্মৃতির পাতায় অম্লান হয়ে রবে। বাবাকে কোনো মাসে দুই তিনশ টাকা সবার আড়ালে হাতে দিয়ে আসতাম। বাবা দুধভাত খুব পছন্দ করতেন। ওই টাকাটা দিয়ে আপা দুধ কিনে খাওয়াতেন। বাবাকে দুধভাত দিতে হতো গোপনে। সামান্য দুধভাত নিয়েও মাঝে মাঝে বড়ো ঝামেলা হতো। ছয়মাস আমার কাছ থেকে কেউ দুধভাত খায় না। একদিন হয়তো আমারও একটা সংসার হবে। আমার সন্তান হবে। তারাও আনন্দ করে দুধভাত খাবে। সেদিন বাবাও কি থাকতে পারতো না তাদের সাথে? কালো ফ্রেমের মোটা পুরু গ্লাসের চশমায় বাবার বিদীর্ণ মুখটা সহসাই ভেসে ওঠে রাহাতের। তার চোখের জল নিয়ন আলোয় হলুদ হয়ে ওঠে! রাত তখন সাড়ে বারোটা।

এ সময়টা সব জায়গায় নীরবতা। বটতলায় কেউ নেই। সেখানে বসে ভাবে কিছুক্ষণ। অপরাজেয় বাংলার পাদদেশটা খুব আপন মনে হয়। যেন নিজের বাড়ির আঙিনা। হলটা ছাড়তে হবে দ্রুত। এখন সে বহিরাগত। ছাত্রত্ব শেষ। কোথায় যাবে? কোথায় গেলে জীবন টার্ন নেবে জয়যাত্রার পথে। জীবনটাকে পাল্টাতেই হবে। ইতর প্রাণীর জীবন থেকে তাকে ওঠে যেতে হবে বহুদূরে।

অপরাজেয় বাংলায় বসেই সে হলুদ পলির ব্যাগটা খোলে। সন্ধ্যায় নীলক্ষেত কুরিয়ার থেকে নিয়ে টিউশনে গিয়েছিল। আর খোলা হয়নি। তার বোন কী একটা পাঠিয়েছে।

পলিব্যাগ খোলার পরই একটা চিরকুট পেলো। তার বোন লিখেছে :

“তোর জন্য একটা হলুদ পাঞ্জাবি পাঠালাম। কাল পহেলা ফাল্গুন। শুনেছি ক্যাম্পাসে কতো অনুষ্ঠান হয়! তুই পাঞ্জাবিটা পরে ঘুরবি। কালতো ভালোবাসা দিবসও শুনলাম! তোকে কে ভালেবাসবে? হাঁদারাম একটা। বোনের ভালোবাসা অনন্ত, অবিরাম। ভালো থাকিস ভাই আমার!”

রাহাতের চোখ চকচক করছে! আজ তার ইচ্ছে করছে টিএসসি হয়ে রোকেয়া হল, শামসুননাহার হলের পাশ দিয়ে একটু ঘুরে আসতে!

হালকা বাতাস বইসে। সত্যিই ফাগুন চলে এসেছে। একটু একটু ঠান্ডাও লাগছে। এই বাতাসের নাম নাকি লিলুয়া বাতাস! মন ভালো করে দেওয়া হাওয়া। রোকেয়া হলের সামনের দ্বীপে বসে আছে রাহাত। গায়ে হলুদ পাঞ্জাবি। মাঝে মাঝে দুই একটা গাড়ি দ্রুতবেগে চলে যাচ্ছে। কতোক্ষণ বসে ছিল মনে নেই।

রাহাত এবার হাঁটা শুরু করে হলের দিকে। রাত তিনটা। বেশ ঠান্ডা পড়েছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় একটি হলুদ প্রজাপতি হেঁটে যাচ্ছে অপূর্ব জীবনের প্রান্তছুঁয়ে।

গল্প থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *