প্রথম পাতা » বিনোদন » বিদায় ‘মিয়াভাই’

বিদায় ‘মিয়াভাই’

Farooque

হুমায়ূন আহমেদকে একবার এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন- “সুনীল ইন্ডিয়ার হয়ে ‘পূর্ব-পশ্চিম’ নামে এতো বড় একটি উপন্যাস লিখলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে! অথচ আপনি এদেশের জনপ্রিয় একজন লেখক হয়েও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তেমন কোনো বড় উপন্যাস লিখছেন না। কেন?” জবাবে হুমায়ূন বলেছিলেন, “সুনীল মুক্তিযুদ্ধ দেখেন নি, এর ভেতর দিয়ে যাননি। তাই তিনি বড় উপন্যাস লিখেছেন। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি তাই লিখতে পারিনা!” পরে অবশ্য ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ নামে বড় একটি উপন্যাস হুমায়ূন লিখেছিলেন! হুমায়ূন আসলে বলতে চেয়েছিলেন এমন কিছু অভিজ্ঞতা আছে যা দেখলেও ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এগুলো কেবল নিজে উপলব্ধি করা যায়। শেয়ার করা যায় না। আমাদের মুক্তযুদ্ধ এমনই এক মহাকাব্য।

আজ একজন ফারুককে রূপালি জগতের মানুষ হিসেবে নয়, তাঁকে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও যে সম্মান করার কথা ছিল তা-ও হয়তো তিনি পেলেন না আ-পামর বাঙালির কাছে। বাঙালির কাছে শ্রদ্ধা সম্মান না পাওয়ায় আমি অবশ্য বিচলিত নই। কারণ, এখন আমাদের আছেই কী আর দিবই বা কী? এই প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের একজন বিজয়ী বীরের চেয়ে এরদোগান এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ! আমার দেশের সাত শ্রেষ্ঠ বীরের চেয়ে কথিত খেলাফতের স্বপ্নের যুবা ইমরান খান বেশি প্রিয়। এ জাতির মহানায়ক আছে অনেক তবু বিরাট একটি দল পশ্চিমের পানসি চাবায়! এরে বলে- ঘরে ভাতার রেখে কাঁইলাকুড় যায় লাঙ ধরতে!

ফারুকরা এদেশে ইসলাম কায়েম করার জন্য যুদ্ধ করেননি। ইসলামের খেলাফত চিন্তা করলে যুদ্ধের প্রয়োজনই হতো না। পাকিস্তানতো ইসলামি রাষ্ট্রই ছিল। একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়েছিল লক্ষ লক্ষ উন্মাদ! তাদের নেশা ছিল লাল-সবুজে, নেশা ছিল বিজয়ের উল্লাসে। ফারুক একজন বীরযোদ্ধা। তাই এ যুগের হাফপ্যান্ট পরা ধর্মপ্রাণ তরুণ তুর্কিদের কাছে তিনি ঋণখেলাপি! আওয়ামীলীগের বাটপার এমপি! মানুষকে ছোট করার কী অভিনব কৌশল! সারাজীবন গরিবের অভিনয় করা মানুষটির ঋণ নাকি ৫৫০০ কোটি! কী হাইস্যকর!! এদেশে আওয়ামীলীগ করলে, মুক্তিযোদ্ধা হলে তাদের কাছে আর নতুন অপরাধ লাগে না!

ফারুক যদি শুধু সারেং বৌ সিনেমা করেই বিদায় নিতেন রাপালি জগত থেকে তবু তাঁর জনপ্রিয়তা কমতো না। সুজন সখি, আবার তোরা মানুষ হ, নয়নমণি, জীবন সংসারসহ অসংখ্য সিনেমায় বাঙালির শৈশব কৈশোরকে রঙিন করে তুলেছিলেন তিনি। আজতো সিনেমা লাগে না! ওয়াজেই কতো বিনোদন! কিন্তু একসময় এদেশে সিনেমার প্রয়োজন ছিল। প্রেম ছিল। গান ছিল। জীবনে ছিল প্রাণ! এতোগুলো সিনেমা হল বন্ধ হলো। দেশের চোরতো কমলো না। এতো ওয়াজ নসিহত হচ্ছে। এদেশের কিশোর গ্যাং থামে না কেন? অথচ সবাই আজ ফারুককে নাস্তিক, জাহান্নামি বলে চিক্কুর দিচ্ছে! আসলে সমস্যা কোথায়?

সমস্যা মুক্তিযুদ্ধে! সমস্যা তাঁর দলীয় পরিচয়ে! এই দুটো অপরাধ না করলে ধর্মহীন বাঙালির কাছে হয়তো তিনি মাফ পেতেন। তাঁর ঋণখেলাপি নিয়ে একটা লেখা পেলাম। পড়তে পারেন :

ফারুকের বক্তব্য তুলে ধরা হলো-

“আমার একটা টেক্সটাইল মিল আছে। আমার সারাজীবনের টাকা, যেটা আমি অর্জন করেছি রক্ত দিয়ে। সেটা আমার আমি মিল তৈরীর পেছনে ব্যায় করেছিলাম। কিন্তু যারা বসেছিলেন ব্যাংকে, তারা ছিল সবাই চার দলীয় জোট ও জামাতের লোক। তারা আমাকে দেখে হাসতো আর বলতেন, এই যে আমাদের মহান মুক্তিযোদ্ধা চিত্রনায়ক ফারুক ভাই এসেছেন।

আমার ছোট কষ্টার্জিত একটি সংসার। সেটার জন্য কিছু করতে হবে বলে আমার ল্যান্ড আছে সেখানে গিয়েছি। এভাবে দুই বছর তারা ঘুরিয়েছে আমাকে। তারা বললো আপনি শুরু করেন, শুরু করার পর আসলো ২১ আগস্ট। তারা অমনি মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। তারা বললেন, পুরো বিল্ডিং করেন তারপর আসেন। কিন্তু আমি এত টাকা কোথায় পাবো। লাগবে ৫ হাজার স্কোয়ার ফিট। আমাকে বলেছে ৪৫ হাজার স্কোয়ার ফিট। আমি তো এসব বুঝিনা, আমিতো ফিল্ম থেকে গিয়েছি।

ওরা বললো পুরোটা আপনার টাকা দিয়ে শুরু করতে হবে। না হয় ক্যানসেল করে দিলাম। সেখান থেকে যুদ্ধ করতে করতে আসলাম আরো দুই বছর। আমি ঘুরতে ঘুরতে চাইতে থাকলাম এলসি করে দেন। বললো টাকা জমা দেন। দিলাম, তাও এলসি পেলাম না। সেটা ২০০৬ সালের ঘটনা। অনেক কষ্টে মেশিন আনলাম। বললাম, এর ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দেন। যেখানে আমাকে ১০ কোটি টাকা ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দিবে। সেখানে দিলো মাত্র ১ কোটি ৭০ লাখ। এভাবে এই মেশিন সেই মেশিন কিনতে টাকা খরচ হয়।

এরপর ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েই কারো কারো নীল নকশায় ব্যাংক আমাকে চিঠি দিয়ে জানায় আমার কাছে পাঁচ হাজার পাঁচশ ৩৩ কোটি পাবে। এভাবেই আমি এখন বিশাল এই ঋণের জালে পড়ে আছি।”

আমাদের তরুণ প্রজন্ম হয়তো জানেই না এদেশের ‘মহানায়ক’দের বিতর্কিত করতে কতো শত সুপারিনটেনডেন্ট বসে বসে আছে আরাম কেদারায়।

আমাদের রূপালি পর্দায় তিনি ছিলেন ‘মিয়াভাই’! পরপারে আপনি আনন্দময় ভুবনে থাকুন, প্রিয় নায়ক, প্রিয় যোদ্ধা।

বিনোদন থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *