আমার শৈশব কেটেছে পরীক্ষাবিহীন। গ্রামের মেঠোপথ, ধানিজমির আলপথ আর রবীন্দ্রনাথের ছোটনদী ছিল আমার শৈশবজুড়ে। ছোটবেলায় পাহাড়েও গিয়েছি কতো! মহিষের গাড়িতে চড়ে নদীর চর, পাহাড়িয়া পথ, বালু আর কাদার সাগর পাড়ি দিয়ে চলে যেতাম যখন তখন।
ছেলেপেলেরা সকালে খেয়ে বের হলে আর সন্ধ্যার দিকে বাড়িতে ফিরতে পারলেই আমাদের মা-বাবার জন্য যথেষ্ট ছিল। আমাদের সময় ‘দুপুরের খাবার’ বলতে কিছু ছিল না। আমরা সকালে ভরপেট খেতাম। সারাদিন পর আবার সন্ধ্যায়! সারাদিন কখনো দু-একটা চকলেট, মাঝে মাঝে একটা আইসক্রিম, কখনো হাওয়াই মিঠাই আর ছিল ‘কটকটি’! ভাঙা বোতল, টিন, নষ্ট হাবিজাবি দিয়ে সামান্য কটকটি আমরা দুই তিন ঘণ্টা চেটে খেতাম। আমাদের ছিল অসীম ধৈর্য। কটকটি কামড়ায়ে খেলে তাড়াতাড়ি শেষ হবে এই ভয়ে চেটে খাওয়া হতো! ধানকাটা শেষ হলে আমরা দলবেঁধে ধানকুড়াতে যেতাম। কৃষক ধানকাটার পর জমিতে যে শীষগুলো পড়ে থাকতো সেগুলো কুড়াতাম! আগের দিনের কুড়ানো ধানে পরেরদিন সকালবেলা গরম গরম ভাঁপাপিঠা কিনতাম! একটা পিঠা খেতে আমাদের অনেক সময় লাগতো! শেষ করতে চাইতাম না।
গরমকালে নদীতে ভাসতাম। সারাদিন একটা প্যান্ট পরে কিংবা সেটা মাথায় গুঁজে অথবা কলমির ডালে ঝুলিয়ে রেখে নদীতে ঝাপাঝাপি খেলতাম। বালুর ঘর বানানো, গামছায় মাছ ধরা, সাঁতার কাটা এভাবেই দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হতো কখন টেরই পেতাম না। একবার রাবারের একটা প্যান্ট মাথায় গুঁজে নদীতে সাঁতার কাটার সময় কখন পানিতে পড়ে ভেসে গেছে টেরই পাইনি। সারাদিন দুঃখে নদীর চরে পড়ে রইলাম ন্যাংটা হয়েই। সন্ধ্যার দিকে মা খবর পেয়ে দুই চড় দিয়ে বাড়িতে নিয়ে গেলো। সেই প্রথম ইদ ছাড়া আরেকটা নতুন প্যান্ট পেয়েছিলাম!
গ্রামের স্কুলে ভর্তি হলাম। পরীক্ষা বলতে মাথার ওপর দিয়ে কানধরা। আমি পরীক্ষায় ফেল করলাম। বয়স হয়নি বলে হাত কান পর্যন্ত গেলোই না! অনেক কান্নাকাটির পর অতিরিক্ত ছাত্র হিসেবে আমাকে নেওয়া হলো। এক দেড় বছর সেখানে পড়লাম। স্যার একদিন পরীক্ষা নিতে চাইলেন। মৌখিক। আমাকে বললেন ‘বৈশাখ’ বানান করতে! বৈশাখ বানানে যে এতো প্যাঁচ সেদিন বুঝেছিলাম। বানান করতে পারলাম না। লিখতে পারি কিন্তু বানান করে বলতে পারিনা। এই অপরাধে স্যার সন্ধিবেত চালান করলেন কয়েকটা। আমি প্যান্ট ভিজায়ে ফেললাম!
এরপরে আমার আনন্দময় শৈশব শেষ হলো। পড়ে রইল মহিষের গাড়ি, নদীর বাঁক, পাহাড়, ভাটিয়ালি গান, সোনালি ধানের মায়ার জগত। অপুর মতো নিশ্চিন্দিপুর পেছনে ফেলে এগিয়ে চললাম সামনে অথবা পিছনে। অথবা কোনোদিকেই নয়! ঢাকাশহরে আমার দ্বিতীয় জীবন শুরু হলো। প্রাথমিক বিদ্যালয় দিয়ে শুরু হলো দ্বিতীয় যাত্রা।
সে অনেক কথা। সবকথা এখানে বলারও দরকার নেই। আদমজী ক্যান্টমেন্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার পর অসাধারণ কয়েকজন শিক্ষক আমি পেলাম। তাঁদের মধ্যে শ্রদ্ধেয় Upal Talukder স্যার অন্যতম। ইসলামের ইতিহাসের সাঈদ স্যার, বাংলার পারভীন ম্যাডাম আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নটা দেখালেন। মনস্থির করলাম পড়ালেখা করলে ঢাবিতেই করব। না করলে টঙ্গি সরকারি কলেজ। ঐ বছর আমি শুধু ঢাবি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম তুলেছিলাম।
আমার পরীক্ষার কিছুদিন আগে পাশের বাসার এক মেয়ের বাল্যবিবাহ হলো। জগতে কতো জনেরই বিয়ে হয়! আমার কেন জানি এই বিয়েটা খুব আহত করলো। আমি ভাবলাম আর পড়ালেখা করে কী হবে! কার জন্য পড়ব? উকিল ব্যারিস্টার হবো কার জন্য?
ভর্তি পরীক্ষা দিব কিনা এই সন্দেহ প্রবল হলো। পড়ি না। লম্বা লম্বা সুখটানে মনের বিরহ কিছুটা কাটে। নাটক করি, আড্ডা দেই। আড্ডার প্রধান বিষয় হৃদয়ভাঙার অপরাধ বিষয়ক হিসাব-নিকাশ! বিবাহিনীর বিরহে আমি কুপোকাত।
তারপর পরীক্ষার ডেট হলো। ভাঙামন নিয়ে আমি ঢাবির সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে বসলাম। ২০০৫ সাল! জামাই Mir Mohammad Maruf Miah খ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ বলতে পারবে। আমাদের জীবনের সব তারিখ মুখস্থ করার দায়িত্ব তার!
প্রশ্ন হাতে নিয়ে মাথা ঝিম ধরে গেলো। সাধারণ জ্ঞান সবই অসাধারণ মনে হলো! ইংরেজিতো ইংরেজির মতোই! বাংলা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পর মনে হলো মেয়েটা বিরাট বোকামি করেছে!
দুইদিন পর এক বদমাশ পত্রিকা নিয়ে আমার বাসায় হাজির! ‘রোল দে, রেজাল্ট দিছে’! আমি কাঁপছি, কাঁদতে পারছি না! প্রায় হাঁটুগেরে টেবিল পর্যন্ত গেলাম। উত্তেজনায় হার্টবিট পড়ে তো ওঠে না অবস্থা। ১৪৩৯! হ, কপিলার ময়নাদ্বীপে যাওয়া হলো না!
মনে আছে, আব্বারে জড়ায়ে ধরে সেদিন খুব কাঁদছিলাম! একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলে মানুষকে কাঁদতে হয় কেন সেটির রহস্য আজো পাইনি।
আমার ভর্তি পরীক্ষার ১৮ বছর পার হয়েছে। আজো পরীক্ষা হচ্ছে। আমার সন্তানতুল্য অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষা দেয় প্রতিবছর। এবারও দিচ্ছে। মহান স্রষ্টা তাঁদের পিতাকে জড়িয়ে ধরিয়ে একবার হাউমাউ করে কাঁদার তৌফিক দিন। সকলের জন্য শুভকামনা।