প্রথম পাতা » বিনোদন » শিল্পীর দায় : সমাজে ও জীবনে

শিল্পীর দায় : সমাজে ও জীবনে

Artist's responsibility

বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে বলে মনে হয়। দেশের অর্ধেকের বেশি প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। এর সাথে সংশ্লিষ্ট লক্ষাধিক লোকজন পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। করোনাকালে এই ক্রান্তিমান প্রবলতর ভাবে নিম্নগামী হয়েছে। স্থবির হয়ে পড়েছে নাটকপাড়া, বিনোদনমাধ্যম, বিএফডিসিসহ প্রায় সকল শোবিজ অঙ্গন। অনেকেই বেছে নিয়েছেন ভিন্ন কর্মময় জীবন।

বাংলাদেশের সংস্কৃতি-অঙ্গন স্থবির হয়ে পড়লে জাতির জন্য সেটা মোটেই সুখকর হবে না। একটি দেশের শিল্পসাহিত্যের সমৃদ্ধির সাথে সে-দেশের ভূ-রাজনীতি, মানুষের জীবনমান সবকিছুই জড়িয়ে থাকে। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে আঘাত এসেছে মানে হলো দেশের মৌলিকচেতনায় আঘাত হেনেছে। আর এর সুযোগে দেশে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে মৌলবাদ, প্রতিক্রিয়াশীলতা, জঙ্গীবাদ, রাজনৈতিক সংকট ও সামষ্টিক বিনষ্টি।

সংস্কৃতি অঙ্গনের স্থবিরতার পেছনে বহুবিধ কারণ বিদ্যমান। দর্শক-শ্রোতার রুচির পরিবর্তনের সাথে পাল্লা দিয়ে শোবিজ অঙ্গনের পরিবর্তিত না হওয়া, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, সহজলভ্য ইন্টারনেট, হাতে হাতে মোবাইল ফোন, বিনোদনের বহু মাধ্যমের আনাগোনা প্রভৃতি কারণ এক্ষেত্রে ক্রিয়াশীল। তবে আমি ভিন্ন একটি কারণ নিয়ে কয়েকটি কথা বলতে চাই :

আমার মনে হয় শোবিজ অঙ্গনের অনেকেই বেপরোয়া জীবন যাপন করেন। তাদের অনেকেই অনেক টাকা উপার্জন করেন তবে তা ধরে রাখতে পারেন না। তাই একসময় তাদের নিঃস্ব-রিক্ত অবস্থা চোখে পড়ে। এ প্রসঙ্গে অনেকের মধ্য থেকে এন্ড্রো কিশোরের কথা বলা যায়। তিনি বাংলাদেশের গানের জগতে লক্ষাধিক গানে প্লেব্যাক করেছেন। তাঁর পারিশ্রমিক আমার জানা নেই। তবু মনে হয় জীবনের শেষপ্রান্তে এসে দশ লক্ষ টাকার জন্য গণভবনে যাওয়া এন্ড্রো কিশোরের জন্য সমীচীন হয়নি। অসুস্থ হলে প্রায় সকলকেই সরকারের আর্থিক সহায়তা নিতে হয়। নিজেরা বড় একটা হাসপাতালও করতে পারেনি এই পঞ্চাশ বছরে! মাইকেল তাঁর মহাকাব্যের এক জায়গায় বলেছেন- ‘যৌবনে অন্যায় ব্যয়ে বয়সে কাঙাল!’ কিংবা কোনো কবির- ‘যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি/ আশু গৃহে সে দেখিবে না আর নিশীথে প্রদীপ বাতি!’ লালন বলেন- ‘সময় গেলে সাধন হবে না!’ আমাদের শিল্পীরা অকালে কাঙাল! বাত্তির সব তেল শেষ করে বসে থাকেন!!

ব্যক্তিগত জীবন যাপনেও তারা এক ধরনের প্রবঞ্চনার আশ্রয় নেন। নাটক সিনেমায় এতো প্রেম অথচ দাম্পত্যে তাদের নিত্য কলহ। প্রায়ই সংসার ভাঙার কথা শোনা যায়। নব্বই দশকের ওমরসানি-মৌসুমি, নাইম-শাবনাজ, বিপাশা-তৌকির, মৌ-জাহিদ হাসানদের ছাড়া কারোরই সংসার তেমন টেকেনি। নিজেরা যে জীবন অনুশীলন করেন না, সে জীবনের কথা অন্যদের শোনায়ে লাভ কী? অন্যরা পয়সা খরচ করে ওসব শুনতে যাবে কোন সুখে? রবীন্দ্রনাথ বলেন- ‘জীবনের সাথে জীবন যোগ করা না হলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা!’ আমাদের তারকাদের সংলাপ-অভিনয় না শুধু নিজেরাও সস্তা পসরায় রূপান্তরিত হয়েছেন। বাঙালি হিসেবে এহেন পরিচয় আমাদের লজ্জিত করে, ব্যথিত করে।

ইদানিং নানারঙের ‘মঠেল’দের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এরা কেউ সিনেমার মঠেল আবার কেউ রাজনীতির মঠেল। প্রকারে ভিন্ন হলেও উভয়েই তরলে নিমজ্জিত, গরলে সমর্পিত! এরা যদি এ জাতির ‘মডেল’ হয় তবে সহজেই বুঝা যায় বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যার্জন আরো কতোদূর! কতোদূর!!!

শিল্পী চাইলেই তার মতো চলতে পারেন না। তিনি যখন সকলের হয়ে যান তখন তিনি নিজের জীবনে, সমাজে, রাষ্ট্রে দায়বদ্ধ হয়ে যান। শিল্পী সেই দায়কে অস্বীকার করতে পারেন না। যথার্থ মহৎ শিল্পী নিজেকে বিপন্ন, বিপর্যস্ত করেও ব্যক্তিত্বকে কখনো বিসর্জন দেন না।

একালে আমাদের তারকাশিল্পীদের আর ‘সবই আছে'(?) কেবল ব্যক্তিত্বই নেই!!

বিনোদন থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *