বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থা বলেছে কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের জন্য আর ১৮ মাস অপেক্ষা করতে হবে। ১৮ মাস অনেক দীর্ঘ সময় মনে হতে পারে। কিন্তু ভ্যাকসিন উৎপাদনের কথা চিন্তা করলে একে খুব স্বল্প সময়ই বলতে হবে। সাধারণত ভ্যাকসিন তৈরিতে ৮ থেকে ১০ বছর সময় লাগে।
প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো ভ্যাকসিন আবিষ্কার। সুখবর হলো করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়ে গেছে। এরপর যে ধাপগুলো পার করতে হয়ঃ
পরীক্ষার চারটি স্তর এবং ফলোআপ
১. প্রথম স্তরটি হলো প্রাক-ক্লিনিকাল পরীক্ষা
এটি ল্যাবরেটরিতে করা হয় অন্য প্রাণীর উপর। এই ধাপ সফলভাবে পার করতে পারলে পরবর্তী ৩টি পর্যায়ে মানুষের উপরে পরীক্ষা করা হয়।
২. প্রথম পর্যায়:
কয়েকজন সুস্থ ব্যক্তির উপর ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে পরীক্ষা করা হয়। সাধারণত ২৫-৫০ জন স্বেচ্ছাসেবীর উপর প্রয়োগ করে ভ্যাকসিনটি বিভিন্ন মাত্রায় মূল্যায়ন করা হয়। ভাইরাসের বিরুদ্বে কাজ করছে কিনা, কী কী উপসর্গ দেখা দিল, কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিল কিনা, কোন জটিলতা দেখা দিল কিনা ইত্যাদি। তাৎক্ষণিক কোন জটিলতা নাও দেখা দিতে পারে। তাই সময় নিয়ে পরীক্ষা করা ছাড়া কোন উপায়ও থাকে না। এই ধাপে সাধারণত এক থেকে দুই বছর সময় লাগতে পারে। তবে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের ট্রায়ালগুলির জন্য এটি তিন মাসের মধ্যে করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
৩. দ্বিতীয় পর্যায়:
শত শত লোকের উপর ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করা হয়। এটি একটি এলোমেলোভাবে, ডাবল ব্লাইন্ড, প্লাসবো-নিয়ন্ত্রিত অধ্যয়ন যা আরও সুরক্ষা, কার্যকারিতা মূল্যায়ন করে এবং যার মাধ্যমে সর্বোত্তম ডোজ এবং ভ্যাকসিনের শিডিয়্যুল সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। এটি সাধারণত দুই থেকে তিন বছর সময় নিতে পারে। তবে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের ট্রায়ালগুলির জন্য এটি আট মাস নেবে বলে আশা করা হচ্ছে।
৪. তৃতীয় পর্যায়:
হাজার হাজার মানুষের উপর ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করে গবেষণা করা হয়। এটি সাধারণত দুই থেকে চার বছর সময় নিতে পারে। তবে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের ক্ষেত্রে এই ধাপটি দ্বিতীয় ধাপের সাথে মিলিয়ে ফেলা হতে পারে। আলাদা করে তৃতীয় ধাপের জন্য সময় ব্যয় করা হবে না সম্ভবত।
ফলোআপ:
এরপর রয়েছে ফলোআপ পর্যায়। এটি সাধারণত এক থেকে দুই বছর সময় নেয় তবে সম্ভবত এই ধাপে কয়েক মাস সময় ব্যয় করা হবে।
উৎপাদন
যদি পরীক্ষাগুলির সময়ই একটি ভ্যাকসিন প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন শুরু করা যায়, তবে তা অনুমোদন পেলেই সাথে সাথে জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া যাবে। তবে এটি এক প্রকার ঝুঁকি নিয়েই করতে হয়। কারণ শেষ পর্যন্ত সব ভ্যাকসিন অনুমোদন নাও পেতে পারে।
দ্রুত করা যায় না কেন?
ভ্যাকসিন নিরাপদ না হলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
১৯৬০ সালে হিউম্যান রেসপিরেটরি সিনসিটিয়াল ভাইরাস (আরএসভি) পরীক্ষার সময় অনেক নবজাতকের ক্ষেত্রে খারাপ উপসর্গ দেখা যায়। দুটি নবজাতক মারা যায়।
১৯৭৬ সালেও নভেল সোয়াইন ফ্লুর ভ্যাকসিন পরীক্ষা করতে গিয়ে ৩০ জন মারা যান এবং অনেকের শরীর প্যারালাইসিস হয়ে যায়।
২০১৭ সালেও ফিলিপাইনে ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন পরীক্ষা নিরাপত্তার কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
থ্যালিডোমাইড হল ৫০ এর দশকের শেষের দিকে আবিষ্কৃত একটি সিডেটিভ ড্রাগ যা বিশ্বব্যাপী ট্র্যাজেডির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ঔষধটি গর্ভাবস্থার বমি বমি ভাব দূর করার জন্য অনেক গর্ভবতী মহিলাকে দেওয়া হয়।
পরে দেখা গেল যে থ্যালিডোমাইড ভ্রূণের অপরিবর্তনীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়ায় এবং হাজার হাজার শিশু মারাত্মক জন্মগত ত্রুটির সাথে জন্মগ্রহণ করেছিল। তাদের মধ্যে অনেকে জন্মের কয়েক দিনের বেশি বেঁচে থাকতে পারেনি।
ভ্যাকসিন না পাওয়া পর্যন্ত নিজেকে রক্ষা করব কীভাবে?
- ঘরে থাকুন। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাবেন না।
- বাইরে গেলে মাস্ক ব্যবহার করুন।
- অসুস্থ মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ করবেন না।
- বাইরে থেকে এসে হাত সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ড ধরে ধুয়ে নিন।
- নাক মুখ স্পর্শ করা এড়িয়ে চলুন।
- অসুস্থ হলে বাড়িতেই থাকুন।
- কাশি বা হাঁচি দেওয়ার সময় টিস্যু ব্যবহার করুন এবং ঢাকনাযুুক্ত বিনে ফেলে দিন।
- প্রায়শই স্পর্শ করা বস্তু এবং পৃষ্ঠগুলিকে পরিষ্কার এবং জীবাণুমুক্ত করে নিন।
জেনে নিন
‘ভ্যাকসিন’ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘ভ্যাক্সা’ থেকে যার অর্থ গরু।
টিকা তৈরি হওয়ার আগে বিশ্ব ছিল অনেক বেশি এক বিপদজনক জায়গা।
ব্রিটিশ ডাক্তার এডওয়ার্ড জেনার লক্ষ্য করলেন দুধ দোয়ায় এমন গোয়ালিনীরা গরুর বসন্তে আক্রান্ত হলেও তাদের মধ্যে প্রাণঘাতী গুটি বসন্তের সংক্রমণ একেবারেই বিরল।
সে সময় গুটিবসন্ত ছিল সবচেয়ে ভয়ানক এক সংক্রামক ব্যাধি। এই রোগ যাদের হতো তাদের মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ মারা যেত। আর যারা বেঁচে থাকতেন তারা হয় অন্ধ হয়ে যেতেন, কিংবা তাদের মুখে থাকতো মারাত্মক ক্ষতচিহ্ন।
সতেরশো ছিয়ানব্বই সালে ড. জেনার, জেমস ফিপস্ নামে আট বছর বয়সী এক ছেলের ওপর এক পরীক্ষা চালান।
তিনি গরুর বসন্ত, যেটি কোন মারাত্মক রোগ না, তার থেকে পুঁজ সংগ্রহ করে সেটা ইনজেকশন দিয়ে ঐ ছেলের শরীরে ঢুকিয়ে দেন। কিছুদিন পর জেমস ফিপসের দেহে গরুর বসন্তের লক্ষণ ফুটে ওঠে।
ঐ রোগ ভাল হয়ে যাওয়ার পর তিনি ছেলেটির দেহে গুটিবসন্তের জীবাণু ঢুকিয়ে দেন। কিন্তু দেখা গেল জেমস ফিপসের কোন গুটি বসন্ত হলো না। গরুর বসন্তের জীবাণু তাকে আরও মারাত্মক গুটি বসন্ত থেকে রক্ষা করেছে।
ড. জেনারের এই পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয় ১৭৯৮ সালে। বিশ্ব এই প্রথম ভ্যাকসিন শব্দটার সাথে পরিচিত হলো।