স্মরণকালে বেশ কয়েকটি মৃত্যু আমাদের অনেককে সম্ভবত নাড়া দিয়েছে। বিশেষ করে একলা এপার্টমেন্টের নিঃস্ব জীবনের নিস্তরঙ্গ বেশ কয়েকজনের মৃত্যু আমাদের চিন্তার জগতকে অনেকটা বিক্ষত করেছে। আমরা বিস্মিত, হতবাক কিন্তু ততটা ভাবান্তর আমাদের হয়নি। এ-ই চলছে, এভাবেই চলবে হয়তোবা।
নগরবাসী বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সবচেয়ে কঠিন জীবন হচ্ছে একাকী থাকার যন্ত্রণা ভোগ করা। জীবনের সর্বস্ব দিয়ে সন্তানকে পড়িয়েছেন, মানুষ করেছেন। এখন তারাও জীবনের তাগিদে হয়তো বিদেশে। দেশে বুড়া-বুড়ি একসাথে থাকলে তবু কপালে সোনায় সোহাগা। অনেক ক্ষেত্রেই হয় স্বামী আছেন, স্ত্রী নেই আবার স্ত্রী আছেন কিন্তু স্বামী নেই। এই নিঃস্বঙ্গতা দিনের পর দিন নগরবাসীদের আয়ু কমিয়ে দেয়। অনেকে চরম একাকিত্বকে মেনে নিতে পারেন না। ফলে, আত্মবিনাশের মাধ্যমে আত্মমুক্তির পথ খুঁজে নেন।
গত কয়েকমাসে এমন একাকী ও নিঃস্বঙ্গতার কয়েকটি মৃত্যু বাংলাদেশে আলোচিত হয়েছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আত্মহত্যাটি দেখলাম গতকাল। একদম সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। জনৈক মহসিন নামের এই ভদ্রলোক ব্যবসায়ী ছিলেন। ক্যান্সার তার শরীরে বাসা বেঁধেছে। দুজন সন্তানের কেউ কাছে থাকে না। তিনি অনেকের দ্বারাই হয়েছেন প্রতারিত। আত্মহত্যা করে জীবন থেকে মুক্তি নিয়েছেন তিনি। তবে আমার মনে হয়েছে লোকটি তার মাথায় গুলি করেনি : একটা নষ্ট, পঁচনশীল সমাজব্যবস্থার মগজে তিনি আঘাতটা করতে চেয়েছেন। হয়তো পেরেছেন কিংবা পারেননি।
‘মহসিন সাহেব নামকরা ব্যবসায়ী ছিলেন। সন্তানদের বড়ো করেছেন, মানুষ করতে চেয়েছেন। হয়তো তারা মানুষ হয়েছে কিংবা হয়নি। সংসারের অন্যদের দ্বারাও তিনি প্রতারণার স্বীকার হয়েছেন’ : এমন গল্প বাংলাদেশের বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় প্রতি কিলোমিটারেই দু চারটি পাওয়া যাবে। এক পর্যায়ে সন্তানরা মানুষ হয়ে দূরে চলে যায়। তখন গ্রাস করে একাকিত্ব, রোগ-শোক, প্রিয়জনের অবজ্ঞা, অবহেলা। মৃত্যুকেই এ পর্যায়ে মুক্তির পথ মনে হয়। সমাজ ধীরে ধীরে আত্মবিনাশের প্রশস্ত রাস্তা করে দেয়। আত্মবিনাশ না করলেও আপনার একটি অনিবার্য স্বাভাবিক মৃত্যু হবে একাকী ঘরে। দুর্গন্ধ বের হওয়ার আগে আপনার লাশের সন্ধান কেউ জানবে না। জনাব মহসিন এই আশঙ্কা থেকেও আত্মহত্যার অধিকারটি সংরক্ষণ করেছেন। এ সমস্ত লোকদের জন্য আত্মহত্যাকে অধিকারের পর্যায়ে দিয়ে দেওয়াই ভালো। লোকগুলো তবু আত্মতৃপ্তি নিয়ে মরুক, পরিত্যক্ত-পরিত্যাজ্য মৃত্যুর চেয়ে এ বরং ভালো।
বাংলাদেশে একান্নবর্তী পরিবার আর কখনো ফিরবে না। বাড়ির সবচেয়ে বৃদ্ধ লোকটির মৃত্যুতেও আকাশ বিদীর্ণ করে কাঁদবে বাড়ির চাকরটাও।
নাতি-নাতনি নিয়ে সুখবাস এদেশে এখন দূর-অতীত। আত্মীয় সমাগম বা প্রিয়জনের আগমন বাংলার মানুষ আর চায় না। মানুষ এখন একা থাকতেই পছন্দ করে। তাই তার নিয়তি এখন একাকিত্ব।
শুধু অর্থের পেছনে না ছুটে ভালোবাসার বন্ধনটা বাড়ানো উচিত। সন্তান সন্তান করে নিজের জীবনকে ত্যানাব্যানা বানাবেন না। যে কোনো ভাবে একাকিত্ব দূর করবেন। প্রয়োজনে একাধিক বিয়ে করুন। লোকলজ্জা বা সন্তানদের মুখের দিকে তাকালে একাকিত্ব ঘুচবে না। নারী পুরুষ উভয়ের জন্যই সত্য। সবচেয়ে ভালো হয় নিজের জন্মভিটেয় যান। গ্রামের সাথে একটা আত্মিক যোগাযোগ গড়ে তুলুন। শেষ জীবনটায় নগরে ধুকে ধুকে না পড়ে থেকে গ্রামে কোনো একটা দাতব্য প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে জীবনকে আনন্দময় করে তুলুন। মানুষের সাথে চলতে শিখুন, জীবনে বিষাদ কম আসবে। অন্তর্মুখী স্বভাব পরিহার করে বহির্মুখী উদ্যমে চলুন।
শেষবেলায় জীবনটাকে উপভোগ করার জন্য আপনাকে মানুষেরই দ্বারস্থ হতে হবে। সুতরাং জনবিচ্ছিন্নতা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখুন। সৃষ্টিশীল হতে চেষ্টা করুন। দেশপ্রেমে জাগুন। দেশের সেবা করতে চাইলে সংসদে যেতে হয় না। আত্মবিনাশে নয়, জনগণের মাঝে আত্মবিসর্জনের ত্যাগী মানসিকতায় জীবনকে গড়ে তুলুন।