প্রথম পাতা » মুভি » সিনেমা দেখার গল্প

সিনেমা দেখার গল্প

Mujib The Making of a Nation

সিনেমা দেখার একটা নেশা আমার আগে থেকেই ছিল। এমনও দিন গেছে যেদিন পরপর চার শো দেখেছি। তখন ঢাকায় থাকতাম। ১২ টায় আনারকলি, ৩ টায় চম্পাকলি, ৬ টায় ক্যাপরি, ৯ টায় বর্ষণে শেষ শো দেখে ২ টার দিকে এয়ারপোর্ট! বাকি রাতটা সিএনজি অথবা স্টেশনে কাটিয়ে সকাল সকাল বাড়িতে ফিরতাম! কী ভয়াবহ অবস্থা! এমন অবশ্য খুব বেশিদিন নয়। কয়েক মাসের মধ্যেই আমি জীবনে ফিরে আসি খুব পজিটিভলি। তবে ভালো সিনেমা মুক্তি পেলে হলে যেতাম। ‘মনপুরা’ সিনেমার পর ‘আয়নাবাজি’ দেখেছিলাম হলে গিয়ে। এ দুয়ের মাঝে বা পরে আর যাওয়া হয়নি। জেলা শহরে থাকি। হলের পরিবেশ তেমন ভালো নয়। হলে যাওয়ার মতো কোনো সিনেমাও আসেনি।

গতকাল হঠাৎ আমার একমাত্র বৌ সিনেমা দেখতে চাইল। ‘মুজিব : একটি দেশের রূপকার’ সিনেমার ট্রেলার, গান নাকি ওর ভালো লেগেছে। বাসায় তেমন একটা সময়ও দেওয়া হয় না। তাই বিশাল বহর নিয়ে আমি চললাম। বৌ পোলাপান নিয়ে এই প্রথম হলে যাওয়া। নিজে বহু সিনেমা হলে বসে গিলেছি। কিন্তু বারো বছরে এই প্রথম একসাথে সিনেমা দেখতে যাচ্ছি। বড় আর মেজো ছেলেকে নিয়ে এখন ভাবতে হয় না। ধমক দিলে কাজ হয়৷ ছোটটারে ধমক দিলে ফল হয় উল্টা। এরে সিনেমা হলে নিয়ে যে কোন বিপদে পড়ব আল্লাহ জানে। তবু রওয়ানা হলাম। বাসার কাছেই হল। ৫/৭ মিনিট লাগে।

ডিসি সব রিজার্ভড। রিয়ালে ঢুকে দেখি মনে হয় পার্টটাইম গরুর খামার হিসেবে ভাড়া চলে। ভ্যাপসা গরম, সিট বলতে ভাঙাচোরা ব্যাঞ্চ। পাশে ফ্যান যা আছে সব চলে না। স্যাঁতস্যাতে। মশার ভয়াবহতা টের পাওয়া গেলো। সিনেমার যখন রমরমা অবস্থা তখনকার নিয়মিত দর্শক আমি। হলের পরিবেশ কেমন ছিল তা দেখেছি। বড় হয়ে সিনেমা দেখেছি স্টার, বলাকা সিনেপ্লেক্সে। হলের এ হাল দেখে আমি চরম হতাশ। প্রস্রাবের গন্ধ তো ফ্রি। সাথে বিড়ির উৎকট গন্ধ। মানিকের পাট ও পাঠার মিশ্র গন্ধ এর কাছে কিছুই না। বললাম, চল যাই। সিনেমা দেখব না। বৌ বলল তুমি ওদিকে কথা বল। কিছু টাকা দাও। কাজ হবে। একজনকে বললাম ব্যবস্থা করেন, টেকাপয়সা আমার কাছে তেজপাতা! মুহূর্তে কাজ হলো। বক্স নামে একটা রুম থাকে। ওটায় ব্যবস্থা হলো। ডাবল ফি। বাচ্চাদেরও টিকেট লাগবে। কথা না বাড়িয়ে পাঁচটা কাটলাম। কিছুক্ষণ পর আরেকজন এলো। ‘এতো টিকেট কাটছেন কেন? তিনটা হলেই চলে। দুইটা ফেরত দেন। দেন, আমি ফেরত দিয়ে দেব।’ ‘টাকা দিবানা?’ ‘না, ফেরত নেয় কি না কে জানে? দেখি চেষ্টা করি। এখন কয়টা টাকা বকশিস দেন।’ কথা বাড়ালে আমি জানি এখানে সিনেমা আরেকটা হবে। দিলাম ৫০ টাকা। যা, বিদায় হ। ছবি দেখি। দেখলাম, আধা ঘণ্টায় আড়াইশ টাকা নয়-ছয় হলো। অথচ এই জাতি দোষ দেয় শুধু সরকারের! যে যেখানে পারছে সেখানেই চুরিচামারি, বাটপারি করে দেশটা ফাক করে দিচ্ছে।

একজন বললো গত সপ্তাহে একটা কী সিনেমা ছিল তাতে দর্শক ছিল তিনজন! এদের তো কোনো কোনো শোতে কারেন্ট বিলও উঠে না। পর্দা তেমন সুবিধার না। ঘোলা দেখা যায়। ডিজিটালের যদি এই হাল হয় তবে এনালগের খবর কী? সিনেমা শুরু হলো। পর্দায় ভেসে উঠলো জাতীয় পতাকা। বাজছে জাতীয় সঙ্গীত। এখানে যাদের দেখলাম তাদের ৯০% শিক্ষিত দর্শক। কিন্তু পতাকা বা এনথেম এর প্রতি সম্মান দেখিয়ে তেমন কাউকে দাঁড়াতে দেখলাম না। অথচ একসময় মূর্খরা সিনেমা দেখতো। পুরো হল ভর্তি ছিল দর্শক। তারা সবাই একযোগে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করতো। মনে এক ধরনের আনন্দের প্লাবন বইতো। সেদিন এখন গেছে। একেবারেই গেছে।

পর্দায় বঙ্গবন্ধু ভেসে উঠলেন। আমার পোলারা চিৎকার করে উঠলো- বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু!!! আরেফিন শুভ নিজেকে ছাড়িয়ে বঙ্গবন্ধু হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তাঁকে স্যালুট। বঙ্গবন্ধুর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, কণ্ঠ, দরদ, দৃঢ়তা সবই আনার প্রচেষ্টা ছিল সর্বত্র। কাজটি সম্পন্ন করতে কঠিন এক সংগ্রাম শুভকে করেছেন। দীর্ঘ সময় নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নিশ্চয়ই ক্লান্তি, হতাশা, রোমাঞ্চ সবই তাঁর ছিল। বঙ্গবন্ধুর দ্রোহ ও প্রেমের দ্বৈতরূপ ফুটিয়ে তোলার প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ। বঙ্গবন্ধুর জীবনকে সেলুলয়েডে ধারণ করা অত্যন্ত কঠিন। শুভ কঠিনকে জয় করার প্রত্যয়ে জয়ী হয়েছেন। তাঁর মার্কস ৮৫। এ প্লাস।

বেগম মুজিবের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনজন। একজন শিশু শিল্পী, দিঘি ও তিশা৷ রেণু যেমন বঙ্গবন্ধুকে ও তাঁর সংসারকে টেনে নিয়েছেন তেমনি সিনেমার গল্পটিও টেনে নিয়ে গেছেন। পরিচালকের এই কনসেপ্টটি ছিল অনন্য। গল্পটি আমাদের বলেছেন বেগম মুজিব। এর ব্যত্যয় হওয়াটাই ছিল অস্বাভাবিক। শিশু শিল্পীর চরিত্রটি দারুণ হয়েছে। একজন এতিম কন্যার চরিত্রে মায়াময় এক জোড়া চোখ দিয়ে সে অনেক কথা বলেছে। তার নম্বর ৯০!

দিঘি তার অংশটুকু করেছে অসাধারণ। বিশেষ করে ‘কী কী জিনিস এনেছো দুললা বিবি সখিনার লাইগা’ গানটিতে তার এক্সপ্রেশন ছিল খুবই রোমান্টিক। তার মার্কস ৯৫!

তিশা ভালো করেছে। তবে মাঝে মাঝে ‘ভাই বেরাদরের’ ছবিয়ালে তাঁকে পাওয়া গেছে। একজন মহীয়সী নারীর চরিত্রে আরেকটু সংগ্রামী ছাপ থাকা প্রয়োজন ছিল। তবে গল্প বলায় কৃতিত্ব দেখিয়েছে। কণ্ঠের জাদু ছিল। তাঁর মার্কস ৭৫!

তাজউদ্দিন চরিত্রে রিয়াজ নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি। সোহরাওয়ার্দী চরিত্রে তৌকিরও তাই। তাঁদের দুজনের মোট মার্কস ১২০!

মোশতাক চরিত্রে বাবু ফাটিয়ে দিয়েছেন। ইতিহাসের কলঙ্কিত চরিত্রটি রূপদানে বাবু ছাড়া গতি ছিল না। তাঁর মার্কস ৯৫!

তোফায়েল আহমেদকে তেমন স্পেস দেওয়া হয়নি। টিক্কা খানের চরিত্রে জায়েদ খান একবার দেখা দিয়েই কাম সেরেছে। তাঁর উপস্থিতিতে নারী দর্শকরা নড়েচড়ে বসেছে। ফেসবুকের কীর্তিকলাপে তিনি বেশ জনপ্রিয় বুঝা যায়। তাঁর মার্কস ৮৫!

শেখ লুৎফর রহমানের চরিত্রে চঞ্চল, সায়েরা বানুর চরিত্রে দিলারা জামান এ প্লাস পাবেন। মাওলানা ভাসানির চরিত্রে রাইসুল ইসলাম আসাদ ও শামসুল হকের চরিত্রে সিয়াম এ ডাবল প্লাস।

বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের চরিত্র, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও অন্যান্য চরিত্রে যারা রূপদান করেছেন তারা ভালো করেছেন। শেষ দৃশ্যটি ছিল ভয়াবহ। এই সিনেমার শেষ দৃশ্য দেখলে তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে আর কথা চলে না!

সাউন্ডে নম্বর : ৯৫

কোরিওগ্রাফে : ৯০

চিত্রায়ণে : ৯০

একজন মহানায়কের জীবনীকে তিন ঘণ্টার রিলে আনার দুর্দান্ত সাহস দেখানোয় পরিচালক শ্যাম বেনেগালকে স্ট্যান্ড মার্কস দেওয়া যায়।

এ সিনেমার চিত্রনাট্যে সংলাপের পরিমিতবোধ ছিল অসাধারণ। অকারণে একটি শ্লোগান, একটি সংলাপ, একটি শব্দও করা হয়নি।

আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে অহেতুক কথামালার বদৌলতে এমন পরিমিতিবোধ থাকলে এই অঙ্গনটি আরো সুন্দর হতো।

বি. দ্র. ছবির বিরতির পরপর ছোটপোলার পটি করার (পরে বুঝেছি মিছা কথা) জন্য বাইরে নিয়ে যাওয়া এবং টয়লেট খোঁজার হাঙ্গামায় দুই একটি সিন দেখতে পারিনি। তবে তিন ঘণ্টার যে অসীম ধৈর্য সে ধরেছে সেজন্য তার কাছে কৃতজ্ঞ। তবু সে কোনো মার্কস পাবে না! সে ভবিষ্যতের ছাত্র। তার জন্য একটি বৃত্ত! বৃৃত্ত কীসের প্রতীক কে জানে?

মুভি থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *