প্রথম পাতা » মতামত » একটা ভণ্ড ও ইতর প্রজন্মের বাংলাদেশ

একটা ভণ্ড ও ইতর প্রজন্মের বাংলাদেশ

broken

বাইরে খুব একটা যাই না। প্রয়োজনে গেলেও সোজা রাস্তায় হাঁটি। চারপাশে তাকানোর সাহস পাই না। বিড়িখোড় বঙ্গীয় তরুণের পোশাক, মোবাইল-আসক্তি, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, মুখের বিশ্রী শব্দতরঙ্গ কানকে বিশ্বাস করাতে ভরসা পায় না যে, আমাদের সভ্যতা বলতে কিছু আছে? ফেসবুকে আসি, কতক্ষণ থাকি, চলে যাই। কোনো নিউজের কমেন্টবক্সে যাই না। ভয় করে! কী লেখা আছে ভাবতেই গা গুলিয়ে যায়। বমি আসে। তারপরও কিছু বিষয়ে বেকুব জনতার সমর্থন কোন দিকে তা জানার জন্য ক্বচিৎ ঢুকে পড়ি। বমি হবার আগেই বেরিয়ে আসি। মানুষের ভাষা ও চিন্তার এমন দুর্দশা আগে কখনো ছিল বলে মনে হয় না। আমরা নষ্টের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। এবার মনে হয় আমাদের নিঃশেষ হওয়ার পালা! আমাদের শিক্ষা, ধর্ম, দর্শন কোনোটাই ফলপ্রসূ হলো না। আমরা হেরে গেলাম। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই আমরা অতলে হারিয়ে যাচ্ছি! আমাদের উত্তরণের পথ সম্ভবত অবরূদ্ধ হয়ে গেছে।

আমাদের শিক্ষাটা তো কোনো কাজেই আসলো না। মুখস্থের ভয়ে সৃজনশীল এলো, জিপিএ এলো। আবার হঠাৎ সব অকার্যকর মনে হলো। বাংলার ছাত্ররা বরাবরই কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালির ফসল। কারো সাথে পরামর্শ হলো না, কারা এই পদ্ধতি এনেছিল, কেন এটি কাজ করলো না এইসব দরকারি প্রশ্নের উত্তর জানা জনগণের অধিকারের মধ্যে পড়ে। কেন এই দেশের শিক্ষা নিয়ে যুগে যুগে এতো ঢংঢাং করতে হয়! কেন একটা পদ্ধতি এদেশে বিশ বছরও স্থায়ী হতে পারে না? এখন যা আনা হচ্ছে তার পাইলট প্রকল্প কোথায় হলো, কীভাবে হলো, কতবছর পর আবার এটি বন্ধ হবে? তখন আবার কী আসবে তা জানাতে হবে না আমাদের? সৃজনশীল পদ্ধতি ছেলেদের পড়ার টেবিল, প্রতিষ্ঠান থেকে বিচ্যুত করেছে। পাশকরা বিদ্যা জাতির জীবনীশক্তিকে গ্রাস করেছে। শিক্ষায় অ-শিক্ষক লোকজনের দখলদারিত্ব, অহেতুক খবরদারি, তাদের সবজান্তার অহমিকা ও আহম্মকি মানসিকতা পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে করেছে টালমাতাল। ফলে, একটি সরকারি স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র তার শিক্ষককে থাপ্পড় মেরেছে! একটি নয়, ভুলেও নয়, দুটি থাপ্পড় সে মেরেছে সজোরে, পরিকল্পিতভাবে। এরপরও সে বা তার পিতা অনুতপ্ত হয়নি। এরা বুঝেছে অকার্যকর শিক্ষাব্যবস্থায় চপেটাঘাত করা যায় যাকে তাকে। ঐ নির্মম ও নিষ্ঠুর তরুণটি উন্মাদনায় তা-ই করেছে যা এদেশের শিক্ষকদের ওপর প্রতিনিয়তই করা হয়! ৩৫ ব্যাচের একজন ছোকরা ৭ম ব্যাচের একজন প্রিন্সিপালের সামনে পা তুলে বসে, তাঁকে শাসন করে, অধস্তন হিসেবে ‘সাহেব’ সম্বোধন করে! কখনো কখনো মমতাজ স্যারদের বাধ্য করা হয় তাঁর জুনিয়রের পা ধরে অকারণে ক্ষমা চাইতে। আদালতে সেই পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে একদিন বন্দোবস্ত হয় শিক্ষা ক্যাডারের অস্তিত্বকে বিলীন করার! যে বৈষম্য ছিল বৃটিশ আমলে, পাকিস্তান পিরিয়ডে তা স্বাধীন বাংলাদেশেও এখন ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এমন বৈষম্যের সমাজ ও রাষ্ট্রে উদীয়মান দেশপ্রেমিক তরুণপ্রজন্ম আশা করা যায় না। এখানে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয় একই পরীক্ষায় ও প্রশ্নে উত্তীর্ণ হয়েও কেউ কেউ আলাদিনের চেরাগ পায়, কেউ পায় মাটির প্রদীপ- ধিকি ধিকি জ্বলে! এদেশের ছাত্ররা দেখে একজন ৬ষ্ঠ গ্রেডের কর্মকর্তা কোটি টাকার গাড়ি পায়, মেইনটেনেন্স বাবদ টাকা পায়, আনসার পায়, পুলিশ পায়! অথচ তার কলেজের প্রিন্সিপাল চড়ে রিক্সায়, ঠেলায় পড়ে হোন্ডায়! সে তার শিক্ষককে মারবে না তো কাকে মারবে? মোল্লার দৌঁড় মসজিদ পর্যন্ত, প্রিন্সিপালের দৌঁড় ৪র্থ গ্রেড!

সমাজে এগুলো দেখে দেখে এরা বড় হয়। এসব বৈষম্য তরুণদের সুকান্তের মতো বিপ্লবী করে না, নজরুলের মতো বিদ্রোহী করে না, এদের আস্কারা দেয়- তুমিও করো : যেমন খুশি তেমন! দেশে আইন আছে, বিধি আছে, উপবিধি আছে, প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন আছে তাতে কী? কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। সুপরিয়ররা যেভাবে চাইবে সেভাবেই সব চলবে। এ জাতি কোনোদিন শিক্ষক চায়নি। তা-ই শিক্ষক সম্প্রদায়ের প্রতি তাদের এতো হিংসা। শিক্ষকরা হবেন মহান। বিত্তহীন, ক্ষমতাহীন মহান। এরা অন্ধকারে গন্ধরাজ- শুধু বিলিয়ে যাবেন।

বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেসবই আজ সুদূরে পরাহত। কাঙ্ক্ষিত মুক্তি কোথাও নেই। ব্যাংক, বিমা, বাজার, স্টেশন, মার্কেট, পদ্মা-যমুনা-ইলিশ সবই দখলদার শয়তানদের বেদখলে। সাধারণ মানুষের হৃদয়ের আর্তনাদ শুনবে কে? ভোটের রাজনীতির ডামাডোলে একটি ব্যালটের মূল্য বেশি, মানুষের চাইতে; একটি বুলেটের মূল্য যত, একটি সৃষ্টিশীল মাথার মূল্য তত বেশি নয়! ঘুণেধরা সমাজব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে সুঁইপোকাদের পোয়াবারো, মুখোশে মুখোশে মানুষের সাথে শুয়োরের বসবাস।

‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’ নামে একটি বায়োপিক আজ মুক্তি পেয়েছে। সিনেমাটির ট্রেলার আমার খুব ভালো লেগেছে। আমি সপরিবারে ছবিটি দেখব বলে অধীর অপেক্ষায় আছি। এই ছবি প্রসঙ্গে কিছু জানার জন্য ট্রেলারের কমেন্টে যাই। কী ভয়াবহ! হা হা রিঅ্যাক্টে সয়লাব, আবার এমন অনেক কমেন্ট পাওয়া যায় যা মেনে নেওয়ার মতো নয়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যে ধরনের কথাবার্তা তারা লিখছে পড়লে শরীরের রক্ত হিম হয়ে আসে। যে লোকটি এ জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিলো তাঁর প্রতি মানুষ কী করে ওমন বাজে মন্তব্য করতে পারে? বাঙালি এতো অকৃতজ্ঞ হয় কী করে? কী একটা অসুস্থ প্রজন্ম গড়ে উঠছে চোখের সামনে! স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু, দেশপ্রেম এগুলো যেন হাসির খোরাক! ছিঃ! আমরা কি এমন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম? স্বাধীনতার মহান স্থপতি শেখ মুজিব কি এই প্রজন্মের জন্য নিজের এবং পরিবারের সমগ্র সত্তাকে বিসর্জন দিয়েছিলেন??

দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ভাঙন ধরলে অবক্ষয় কী চরম পর্যায়ে নেমে আসতে পারে তা আজকের বাংলাদেশ দেখলে বুঝা যাবে। যে জাতি শেখ মুজিবকে হাসির পাত্রে পরিণত করতে পারে তাদের শিক্ষাটা যে পুরোপুরি হয় নাই একথা নিশ্চিত জানবেন। যেদিন সকল বৈষম্য দূর হবে, শিক্ষকদের পবিত্র সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া হবে সেদিন কাঙ্ক্ষিত মুক্তি আসবে।

বি.দ্র. উল্লিখিত সিনেমায় বঙ্গবন্ধু চরিত্রে আরেফিন শুভ ও অন্যান্য চরিত্রে যাঁরা অভিনয় করেছেন তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। মনে রাখবেন, কতিপয় স্বাধীনতাবিরোধীদের কাছে আপনারা ‘দালাল’ বা অন্য অনেক দোষে দুষ্টু হবেন কিন্তু ইতিহাস আপনাদের মনে রাখবে।

মতামত থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *