কবির মৃত্যুর কয়েকমাস আগে সম্ভবত। আমরা নাটকের দল নিয়ে রবীন্দ্র সরোবরে গিয়েছি নাটক করতে। সেদিন সকালবেলা। চৈত্রসংক্রান্তির উৎসব ছিল সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যানারে। উন্মুক্ত মঞ্চের সামনের দর্শক গ্যালারি তখনও শিশিরস্নাত। আশেপাশে থাকা বৃক্ষলতায় শিশিরের টুপটাপ মৃদু শব্দ। সকালবেলার সূর্য উঠি উঠি করছে।
ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ঘুরে ঘুরে নাটক করেছি, অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে কাছে থেকে দেখেছি। প্রয়োজনে – অপ্রয়োজনে টুকটাক কথা বলেছি। তখন কাউকে এতো গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো না। মনে হতো, এঁরা আর আমিতে কোনো পার্থক্য নেই। আমাদের মনের চাওয়া ছিল এক, আমরা কথা বলতাম সমস্বরে, আমাদের দাবি ছিল গণতন্ত্রের, মানুষের মুক্তি ছিল আরাধ্য। পাশাপাশি হেঁটেছি, স্লোগানে স্লোগানে কথা বলেছি। আমাদের সংলাপ ছিল মুক্তিযুদ্ধের শব্দগুচ্ছে। আমরা গড়ে উঠেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। একই পথে আমাদের চলা ও বলা ছিল বলে কাউকে অতি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি তখন।
সেদিনের চৈত্রসংক্রান্তি উৎসবের উদ্বোধক ছিলেন একজন কবি। ব্যানারে নামটা পড়লাম। আগে তাঁকে সামনা-সামনি দেখিনি। অপেক্ষা করতে থাকলাম। কবি এলেন। তাঁর গায়ের সোয়েটারটা আমাকে আহত করলো। এতো কমদামি একটা জামা পড়ে এতোবড় কবি জনতার মঞ্চে! অবাকই হলাম। মাধ্যমিকে পড়ে আসা তাঁর একটি কবিতা আমাকে সারাজীবন আন্দোলিত করেছে –
মেঘনা নদী দেবো পাড়ি
কল অলা এক নায়ে
আবার আমি যাবো আমার
পাড়াতলী গায়ে।…
মনে আমার ঝলসে ওঠে
একাত্তরের কথা
পাখির ডানায় লিখেছিলাম
প্রিয় স্বাধীনতা।
কবিতাটি বিড়বিড় করে পড়ছি আর ভিড় ঠেলে আমি সামনে চলে এসেছি কবির। কবি কাঁচা হাতে শিখা প্রজ্বলন করলেন। বুঝলাম, বয়স হয়েছে। কাঁচা হাত না, হাত কাঁপছিল। তাঁর চুলগুলো কী অপরূপ শুভ্রতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তখন সেলফি কিংবা ক্যামেরার এতো সহজলভ্যতা ছিল না। আমাদের হাতের বাটন সেটটাই সহজে পকেটে ঢুকতো না! এন্ড্রয়েডের নাম তখন আমরা জানতাম না। এখনকার মতো হুড়োহুড়ি করে সেদিন কবির সাথে একটা সেলফি তুলতে চাইলে কি তিনি বিরক্ত হতেন? কে জানে?
চৈত্রসংক্রান্তির সেদিনের কবির ছবিটা আজো আমার মনে গেঁথে আছে। এরপরে বাংলাসাহিত্য পড়তে গিয়ে কবিকে বারবার পেয়েছি, তাঁকে মুখস্থ করেছি, তাঁর শিল্পসফলতার ব্যবচ্ছেদ করেছি। কিন্তু সেই চৈত্রের ভোরে দেখার ছবিটা এখনো তেমনি আছে। ঐ ঘটনার কয়েকমাস পরেই তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। রেখে যান তাঁর অজস্র সোনালি ফসল। বাংলার স্বাধীনতাকে নিয়ে এতো পরিমাণ কবিতা সমসাময়িক অন্য কোনো কবি লিখেছেন বলে আমার জানা নেই। তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যাও অনেক। উপন্যাস ও জীবনী লিখেছেন। প্রবন্ধ লিখেছেন। গানও লিখেছেন কিছু। গায়ক জেমসের গাওয়া বিখ্যাত গান ‘আমি তারায় তারায় রটিয়ে দেবো তুমি আমার…’ তাঁরই লেখা।
‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ বলে তিনি আক্ষেপ করেছিলেন একদা। আজ বেঁচে থাকলে জন্মদিনে কী উপহার দিতেন তাঁর পাঠককুলকে?
শুভ জন্মদিন কবি শামসুর রাহমান। ওপারে ভালো থাকুন।