বাংলাভাষার একজন এবং একমাত্র শুদ্ধতম কবির প্রয়াণদিবস আজ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতাকে বলেছিলেন – চিত্ররূপময়। আরো অনেক প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা জীবনানন্দকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। সবই হয়েছে তাঁর মৃত্যুর পর। সম্ভবত, বাংলাভাষার একমাত্র কবি যিনি ‘মরণোত্তর কবি’ হিসেবে বাঙালির কাছে স্বীকৃতি পেয়েছেন। জীবিত জীবনানন্দকে নিয়ে কারোরই আগ্রহ ছিলো না। এমনকি তাঁর অতি নিকটজনেরও।
কয়েকটি চাকরি করতে হয়েছে তাঁকে। ব্যাপক আর্থিক টানাপোড়েন ছিলো তাঁর। অগ্রিম টাকা চেয়ে প্রকাশকদের কাছে দেনদরবার করতেন। প্রতিশ্রুতি দিতেন – লিখে দেনা পরিশোধ করবেন। কেউ ধার দিতেন, কেউ আবার এসবের ধার ধারতেন না।
অর্থকষ্ট কত প্রকার ও কী কী তা বঙ্গীয় কোনো কবি জীবনানন্দের মতো বুঝেছেন বলে মনে হয় না। তবু বিত্ত-বৈভব নিয়ে তাঁর কবিতা নেই। বৈষয়িক অভাবের চিত্র নেই, বোধের অভাব নিয়ে লিখেছেন অনেক।
তাঁর কবিতায় গোবরে পোকা আছে, প্যাঁচা আছে, কাক-দোয়েল আছে, চাঁদ আছে আর আছে মৃত্যুর সাধ, অন্ধকার এবং অন্ধকার। নেই কেবল সিকি, আধুলি কিংবা নগদ নোটের হিসাব। তিনি যখন নিদারুণ অর্থকষ্টে তখনই লেখেন ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যটি। এই মহান কাব্যটি প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর কয়েক বছর পর।
হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা ‘আগুনের পরশমণি’র একটি দৃশ্য – একটু আগেই পাক- মিলিটারি এসে তাদের শক্তিমত্তার প্রমাণ দিয়ে গেলো। চারদিক থমথমে। একজন ফকির শূন্য থালা নিয়ে বসে আছে। পাশে একজন দোকানদার আরেক জন অফিসফেরত লোককে জিজ্ঞেস করলো – স্যার, দ্যাশের অবস্থা কী? অফিসার বিড়বিড় করে বলছেন – ‘হুম! দ্যাশের অবস্থা!’ বলে ফকিরের শূন্য থালায় একটি পয়সা দিলেন। শূন্য থালা ঠন করে বেজে উঠলো। ফকির অফিসারের প্রস্থানপথের দিকে তাকিয়ে বললো – দ্যাশের অবস্থা ভালো।
বাঙালির দেশপ্রেম চাওয়া-পাওয়ার হিসাব-নিকাশে ঘনিষ্ঠ। বৈষয়িক হা- হুতাশের মধ্যে থেকে ‘রূপসী বাংলা’ র মতো কাব্য লেখা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। জীবনানন্দ ইতিহাসের সেই বরপুত্র যাঁর নাম জীবনানন্দ অথচ পুরো জীবনটাই তাঁর বিষাদে পূর্ণ। নিজে বীমা কোম্পানির চাকরিও করেছেন কিন্তু তাঁর জীবনবীমার নিশ্চয়তা হয়নি। সেটা চাকরি দিয়েও না, লেখনিতেও না। তাঁর বার বার চাকরি চলে গেছে। তাঁর কবিতা অশ্লীল – এই দায় নিয়েও চাকরি ছাড়তে হয়েছে তাঁকে! জীবনানন্দের কবিতা আমার মনে হয় সেকালেও লোকে বুঝেনি। একালেও বুঝে না। সেদিন এক ছাত্রকে জীবনানন্দ আওড়াচ্ছিলাম – ‘যারা অন্ধ তারাই সবচেয়ে বেশি চোখে দ্যাখে আজ।’ পাশে দাঁড়ানো ছাত্রের অভিভাবক বললেন – “জি স্যার, কথা সত্য। আমাগো এলাকায় এক অন্ধফকির আছে। আপনে যে নোটই তারে দিবেন, সে ঠিক বুইঝা ফেলবে। আজব না? অন্ধরা আসলেও বেশি দ্যাহে।”
তারপর থেকে আমি আবার জীবনানন্দের কবিতায় অশ্লীলতা খোঁজে বেড়াই। মৃত্যু আর অন্ধকার জীবনানন্দের প্রিয় বিষয়। তাঁর কবিতায় অতি তুচ্ছ পতঙ্গেরও অপূর্ব জীবনের সন্ধান মেলে। কেবল মানুষেরই সঙ্কট অনিবার্য সত্য হয়ে ওঠে। জীবনানন্দ জীবনের আলো দেখেছেন সুদূর ভবিষ্যতে, কল্পনায়, আকাশলীনার পরাবাস্তবতায়, সুরঞ্জনার হৃদয়-ঘাসে কিংবা পতঙ্গ-পিঞ্জরে। বাস্তবে তিনি মৃত্যুকেই সাজিয়েছেন বারবার। আর অন্ধকারকেই গাঢ় করেছেন শুধু। কোনো এক পঞ্চমীর চাঁদকে ভালোবেসেছিলেন কবি। চাঁদ ডুবে গেলেই সাধ মিটাবেন – মৃত্যুর।
উপমহাদেশে একটি গাড়ি চলে ইঞ্জিনে। গাড়িটির গতি বাংলার ঠেলাগাড়ির চেয়ে একটুও বেশি হবে না। এর নাম ট্রামগাড়ি। কলকাতায় এই জাতের গাড়িটি গত দেড়শ বছরের ইতিহাসে একটি মাত্র এ্যাক্সিডেন্ট করে। সেই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান বাংলার মহত্তম কবি জীবনানন্দ।
প্রয়াণ দিবসে, আপনাকে প্রণতি কবি।