প্রথম পাতা » ভ্রমণ » একটি আটপৌরে ভ্রমণ বিত্তান্ত

একটি আটপৌরে ভ্রমণ বিত্তান্ত

highway

চাকরীর সুবাদে আমাকে প্রতি সপ্তাহেই একবার করে ঢাকা-টাংগাইল, টাংগাইল-ঢাকা যাওয়া আসা করতে হয়৷ প্রতি শনিবার কল্যাণপুর খালেক পাম্প থেকে সকাল -সন্ধ্যা নামে বাসে করে সকাল আটটায় রওনা হয়ে সাড়ে দশটা নাগাদ টাংগাইলের পুরাতন বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে পৌছাই৷ বাসে উঠেই সিটে হেলান দিয়ে ঘুমাই চন্দ্রা পর্যন্ত৷ অনেক সময় ঘুম ভাঙ্গে মির্জাপুর গিয়ে৷ মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের ৭১ গেটের সামনে৷ মাঝেমাঝে বিশেষ কোন কারণে শনিবার সকালে টাংগাইল যেতে না পারলে বিকেলে চারটার বাস ধরে যাই৷ তখন আর বাসে ঘুমাই না, কানে হেডফোন গুঁজে বাসের জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে দেখতে যেতে থাকি, হঠাৎ ঘুমে চোখ লেগে আসলে সিটে হেলান দেই৷

আগে ঢাকা থেকে টাংগাইল যেতে অনেক কষ্ট করতে হতো৷ মহাখালী থেকে বাস ছেড়ে আব্দুল্লাহপুর হয়ে আশুলিয়া দিয়ে টাংগাইল যেতে হতো৷ এখনো ঐ রাস্তায় যাওয়া আসা করা যায় কিন্তু বাস সার্ভিস ভালো না৷ নিরালা সুপার, ঝটিকা আর ধলেশ্বরীর মতো অনেক লোকাল বাস আছে৷ কোন এসি বাস চলে না এই রুটে৷ ঢাকা-টাংগাইল রুটে প্রথম এসি বাস সার্ভিস সকাল- সন্ধ্যা আর সোনিয়া৷ কিছুদিন আগে সার্বিক নামে আরো একটা এসি বাস সার্ভিস চালু হয়েছে৷ এই তিনটি বাস-ই কল্যাণপুর খালেক পাম্প থেকে ছেড়ে যায়৷ দুই ঘন্টা পরপরই বাস ছাড়ে৷ লাস্ট ট্রিপ ছেড়ে যায় সন্ধ্যা ৬ টার দিকে৷

ভালো বাস সার্ভিস চালু হয় তখনই যখন রাস্তা ভালো হয়ে যায়৷ ঢাকা-টাংগাইল মহাসড়ক এখন চার লেনের প্রশস্ত আর চকচকে রাস্তা৷ বছর দুই আগেও এরকম ছিলনা৷ রাস্তা ছিল খানাখন্দে ভরা, ধুলায় অন্ধকার হয়ে থাকতো৷ বাসের পেছনের সিটে বসলে ঝাঁকুনি লেগে তড়াক করে মাথা প্রায় বাসের ছাদে লাগার মতো অবস্থা হতো৷ বাসের জানালা দিয়ে ধুলা ঢুকলে মনে হতো বাস কোন এক মরুভূমিতে সাইমুম-ধুলা ঝড়ের কবলে পড়েছে৷ তাড়াহুড়া করে বাসের জানালা বন্ধ করে দিয়েও রেহাই পাওয়া যেতোনা এই মরুঝড়ের কবল থেকে৷

এখন টাংগাইল যাওয়ার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ আলাদা৷ কল্যাণপুর থেকে বাসে চেপে বসলে সর্বোচ্চ আড়াই ঘন্টায় যাকে বলে চ্যালচ্যালাইয়া টাংগাইলের পুরাতন বাস স্ট্যান্ডে পৌছে যাওয়া যায়৷ রাস্তায় ধুলাবালি নাই, থাকলেও এসি বাসে ঢুকার উপায় নাই৷ নন-এসি বাসে গেলেও ধুলার পেরেশানি নাই৷ পিচঢালা চকচকে কালো রাস্তা৷ দুইপাশে দুইচাকা আর তিন চাকার যানবাহন চলার সরু পাকা রাস্তা৷ চার চাকার জন্য বিপরীতমুখী চওড়া দুই লেন৷ ডিভাইডার দিয়ে রাস্তাগুলো আলাদা করা৷ ডিভাইডারের গায়ে জেব্রার মতো কালো আর সাদা ডোরাকাটা লাইন৷ আবার বিভিন্ন বাইপাসের সংযোগস্থলে হয়েছে এলিভেটেড ওভারপাস৷ নিচ দিয়ে রিক্সা ভ্যান আর মানুষ এপাশ থেকে ঐপাশে নির্বিঘ্নে যাতায়াত করে আর উপর দিয়ে শোঁ করে চলে যায় দূরপাল্লার বাস ট্রাক৷

টাংগাইল যাওয়ার পথে বাইপাসগুলোর নাম আমার কাছে বেশ লাগে! কয়েকটার নাম মনে আছে, তার মধ্যে করাতিপাড়া বাইপাস নামটি শুনলেই ছোটবেলায় করাতিরা হাতে টানা করাত দিয়ে গাছ কেটে যে কাঠ বানাতো সে দৃশ্য মনে ভেসে উঠে৷ স’ মিলের প্রচলন আসার পর করাতিদের বাশঁ দিয়ে উঁচু একটা মাচাঁ বানিয়ে একজন উপর থেকে আর অন্যজন নিচ থেকে করাত চালিয়ে কাঠ কাটার আয়োজন চোখে পড়ে না আর একদমই৷ শেষ আমি করাতিদের এরকম গাছ কাটার দৃশ্য দেখেছিলাম সেইন্ট মার্টিনে ২০১৬ সালে৷ সেখানেও একখানা স’মিল বা করাত কল হয়তো বসে গেছে এতোদিনে৷ এখন তো প্রায় সবখানেই ইটভাটার মতো করাত কলের উপস্থিতি৷ করাতকল ছাড়া এখনও কোন একটা বাজার আছে তা ভাবাই যায়না৷ দুই একটা হয়তো আছে কিন্তু সেগুলো বর্ধিষ্ণু বাজার নয় বলে আমার বিজ্ঞ মতামত৷

করাতিপাড়া বাইপাস ছাড়াও করোটিয়া বাইপাস, তারোটিয়া বাইপাস, আশেকপুর বাইপাস, রাবনা বাইপাস নামগুলো মনে আছে৷ এসবের বাইরেও আছে আরো অনেক বাইপাস৷ সব বাইপাসে যাত্রী নামে না৷ করাতিপাড়া আর করোটিয়া বাইপাসে আমি বেশি যাত্রী নামতে দেখেছি৷ করোটিয়ার শাড়ির হাটের দিন সবচেয়ে বেশি যাত্রী নামে এই করোটিয়া বাইপাসেই৷ ছুটির দিনে এই বাইপাসে নেমেই অনেকে দেখতে যায় লোহা আর কাঠ দিয়ে বানানো সেকালের করোটিয়া জমিদার বাড়ি৷ মহেড়া জমিদার বাড়ি পেছনে ফেলে রেখে এসেছি৷ ঢাকা থেকে টাংগাইল যাওয়ার পথে আশেকপুর বাইপাস দিয়েই টাংগাইল শহরে ঢুকতে হয়৷ যমুনা সেতুর দিক থেকে আসলে রাবনা বাইপাস দিয়ে টাংগাইল সদরে ঢুকা যায়৷

আশেকপুর বাইপাস দিয়ে ঢুকে আমি নেমে যাই পুরাতন বাস স্ট্যান্ডে৷ এই বাসস্ট্যান্ডের পাশেই টাংগাইলের ঐতিহ্যবাহী শিবনাথ উচ্চ বিদ্যালয় অবস্থিত৷ আমি বাস থেকে নেমে কখনো বিদ্যুৎচালিত রিক্সা আবার কখনো অটোরিক্সাতে করে রওনা হই সন্তোষ এর দিকে৷ আমার কর্মস্থল এই সন্তোষেই৷ শহর থেকে সন্তোষ যাওয়ার পথে যেসব জায়গা পড়ে সেসব জায়গার নামও আমার কাছে বেশ ভালো লাগে৷ নামগুলোর মধ্যে সাহিত্যিক মূল্যমান রয়েছে বলে আমি উচ্চ ধারণা পোষণ করি৷

রিক্সাতে করে নিরালা মোড় আর শান্তিকুঞ্জ মোড় পাড় হয়ে বেবী স্ট্যান্ড অতিক্রম করে লৌহজং নদী ব্রিজ দিয়ে পাড় হয়ে যেতে থাকি সোজা পিচঢালা রাস্তা ধরে৷ সরকারী এম এম আলী কলেজের আগেই পড়বে রাণী দীনমনী শশ্মান ঘাট৷ এই শশ্মান ঘাটের পাশেই রয়েছে একটা পাকুর গাছ আর নিচে পানিতে ফুটে আছে অনেক লাল পদ্মফুল৷ এই জায়গাটাই আমার সবচেয়ে প্রিয় যাওয়া আসার পথে৷ জায়গাটাতে সব সময় একটা ছায়া সুনিবিড় ভাব থাকে৷ এম এম আলী কলেজের সামনে থেকে একটি রাস্তা চলে গেছে সন্তোষ আর পোড়াবাড়ির দিকে৷ আরেকটি রাস্তা চলে গেছে বাম দিক দিয়ে নাগরপুর উপজেলার দিকে৷

সন্তোষের রাস্তা ধরে কিছুদুর আগালেই ডানপাশে চোখে পড়বে দেয়ালঘেরা গাছপালায় লুকানো সাদা একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি৷ বাড়িটি মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান সাহেবের৷ টাংগাইলের গন্যমান্য ব্যক্তিত্ব তিনি৷ উনার নামে করা মাহমুদুল হাসান কলেজ টাংগাইলের একটি সুনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান৷ আরো একটু এগিয়ে গেলে ডানপাশেই পড়বে প্রায় দুইশো বছরের পুরাতন সন্তোষ জাহ্নবী উচ্চ বিদ্যালয়৷ বিদ্যালয়টি ১৮৭০ সালে পাঁচআনীর জমিদারনী জাহ্নবী চৌধুরানী প্রতিষ্ঠা করেন৷ এই বিদ্যালয়টির বিশেষত্ব হলো এতে কোন জানালা নেই৷ আছে শুধু ৯৯ টি দরজা৷ এই দরজা দিয়েই আলো আসে! এবার একটু সামনেই আমাকে রিক্সা থেকে নামতে হবে৷ মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর গেটেই আমার আটপৌরে ভ্রমণের ইতি৷

ভ্রমণ থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *