কয়েক বছর আগে, একরাতে এগারোটার মতো বাজে। টিউশনি করে বাসায় যাচ্ছি। রাস্তা বেশ ফাঁকা। আমি যে এলাকায় থাকতাম তখন সে এলাকা এখনকার মতো ঘিঞ্জি ছিল না। সেখানে আগে কারেন্ট চলে গেলে গাছের ফাঁক গলে চাঁদের আলো মাটি ছুঁয়ে যেতো। সে রাতে ব্ল্যাক আউটের পূর্ণিমায়, প্রায় ফাঁকা রাস্তায় কিছুক্ষণ পরপর টুংটাং করে রিক্সাগুলো আমাকে ক্রস করে চলছিল। আমি হুমায়ুন আজাদের কবিতা উচ্চকণ্ঠে বলছিলাম- ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’…!
আমার এক এলাকাতো বড়ভাই যিনি ‘বৃক্ষমানব’ নামে পরিচিত (বৃক্ষমানব মানে সে বৃক্ষে থাকে না, হাতে ডলে লতাপাতা খায় নিয়মিত) সে-ও যাচ্ছিল একই দিকে, আমার পিছে পিছে। কবিতা বলা শেষ হলে তার হাত আমার কাঁধে রেখে বললো- ব্যাক্কল, তুই এই কথা কি আজকা জানস? “ভাই কোন কথাটা?” আমি নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ করে জানতে চাইলাম। একরাশ ধোঁয়া আকাশের দিকে ছেড়ে বললো- “এই যে কইলি, সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে! কবেই তো নষ্টরা সব নিয়া নিছে !”
আমি তার কথা বিশ্বাস করবো কোন দুঃখে? যার নৌকা চলে পাহাড় বেয়ে তার কথার গুরুত্ব দেওয়ার কিছু আছে? সব চলে যায় কীভাবে?
এই যে এতো বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, শহিদ মিনারে লম্বা লাইন! কারা দাঁড়ায় সেখানে? কারা পালন করে বিজয়গাথা? এতোবড় স্টেডিয়ামে কারা সসম্মানে দাঁড়িয়ে বুকে হাত রেখে মুখে উচ্চারণ করে- ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি…!’ সবই কি ভুয়া? সবই ফক্কিকার!
এক বড় ভাই বলছিলেন- একজন মুদি দোকানিও দেশের সেবা করতে পারে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম- ক্যামনে? উত্তর এলো- “সে ওজনে কম দেবে না, ভেজাল পণ্য বেচবে না, এরচেয়ে দেশপ্রেম আর কী আছে?” কথাটা ব্যাপক মনে ধরলো।
কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? আজ মনে হয়, মুদি দোকানি থেকে শুরু করে অতি উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত কেবলই চোরের কারখানা বেড়েছে আমাদের। পঞ্চাশ বছরে আমরা পুরো রক্তকে দূষিত করে ফেলেছি। সহসা আমাদের মুক্তি হবে না।
বাংলাদেশ কাগজে-কলমে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে থাকলেও বাস্তবতা কিন্তু অনেকটা অন্যরকম। এদেশে এখনো আশ্রয়হীন লোকের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। ‘মুজিববর্ষে’ গৃহহীন মানুষকে একটু সুখের আশ্রয় দিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছেন। ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’ – এর আওতায় পর্যায়ক্রমে গৃহহীনদের ঘর দেওয়া হচ্ছে। আমি যতদূর জানি, প্রতিটি ঘরের জন্য বাজেট ১৯০০০০ (এক লক্ষ নব্বই হাজার টাকা)। যদিও বাজেটটি কম, তবু প্রকল্পটি যাঁরা বাস্তবায়ন করছেন তাঁরা একটা হোমওয়ার্ক নিশ্চয়ই করেছেন। বাজেট কম হলেও অন্তত উদ্বোধনের পরের দিন ভেঙে পড়ার কথা না। সেখানে চুরিচামারির একটা বিষয় অনেকের নজরে এসেছে। বাংলাদেশের জন্য এরচেয়ে দুঃসংবাদ আর কী হতে পারে। তবে চোররা সব দিনের চোর, সকলেই প্রায় ফার্স্ট ক্লাস!!
সিভিল সার্ভিসের একটা ক্যাডারে আমি আছি। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের অগ্রজ অফিসাররা চলে গেলে, আমরা প্রশাসনে এলে সবকিছুতে একটা রেভ্যুশনাল গতি আসবে। কিন্তু আসলে আমার চিন্তাটা ভুল। কারণ এদেশে সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করাই দুরূহ। এতে করে ব্যক্তিগত অশান্তি, পারিবারিক ও সামাজিক ব্যাধিতে জর্জরিত হতে হয়। এদেশের সবাই যেন একই শেকলে বাঁধা- চোরে চোরে গাঁথা, এক চোরে ধরা খাইলে সব চোরের ব্যথা! এখনকার তরুণ অফিসাররা মনে হয় আগের চেয়ে আরো ভয়ঙ্কর। কারণ, এরা ভিক্ষুকের টাকায় ভাগ বসায়, অনাহারীর খাবারে থাবা দেয়! এরা দেশকে কতদূর নিয়ে যাবে? সবাই ‘স্যার’ সম্প্রদায়। জনগণের টাকায় পড়ে, জনতার বেতন খেয়ে সমাজের উচ্চমঞ্চে সকলে ‘স্যার’ সেজে আছে। অথচ, এই দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ যাঁদের, সেই উন্মূলিত শ্রেণিই দলিত, নিপীড়িত।
সর্বসহায়হারা এসব দলিত সম্প্রদায় অসুস্থ রাজনীতির কাছে ধরা, অনিয়মের কাছে ধরা, দুর্বৃত্তায়নের কাছে ধরা। বাংলাদেশে এসবই তাঁদের নিয়তি বলে শিরধার্য। সর্বংসহা এসব ব্রাত্যজনের অভিশাপে একদিন ধ্বসে যাবে নগর, সুরম্য প্রাসাদ! কারণ, ভাঙনের মুখে টেকে না কিছুই।
ঘরহীনদের ঘরে যাদের কালোহাত পড়েছে রাষ্ট্রের উচিত তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা। একটি গোষ্ঠীর কাছে সকল অর্জন, সকল স্বপ্ন, সকল নীতিকে জলাঞ্জলি না দিয়ে সরকারের উচিত এসব মহতী কাজে পরীক্ষিত শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করা। বৈষম্য দূর করে সকলকে সমান সুযোগের আওতায় আনলেই এসব কালোহাত ভেঙে যাবে অচিরেই।
জয় হোক মেহনতি মানুষের।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।