প্রথম পাতা » জীবনযাপন » বিচিত্র বিলাপ

বিচিত্র বিলাপ

লেখাটার নাম দিলাম ‘বিলাপ’! আমার এই কথাগুলো সমাজকে বদলে দেবে না। সমাজের মানুষ এগুলো গ্রহণও করবে না, জানি। মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা অব্যক্ত কথাগুলো কয়েকদিন থেকেই ঘুরছে। আনমনে বলাবলি করি। এটা যেহেতু ব্যক্তিগত একটা ডায়রি, সুতরাং এখানে কিছুকথা বলাই যায়। কেউ পড়লে পড়ুক, না পড়লে নাই। বাস্তব জীবনেও আমার কাছের মানুষ বলতে দু চারজন। নীরবে নিভৃতেই চলে যাচ্ছে দিনকাল। এর মধ্যেই একদিন ঘটনা ঘটে যাবে। নিষ্ফল জীবনের ইতি ঘটবে ইতিহাসহীন এক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। মানবজাতির জন্য আমার কোনো অংশগ্রহণ নেই- এই বিষয়টি আমাকে ভাবিত করে সবচেয়ে বেশি। স্রষ্টা আমাকে এই বিশেষ গুণটি দেননি- মানুষের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করার মতো মহৎ আমি হতে পারলাম না। উদ্ভ্রান্ত মনে অনেক বিষয় একসাথে উঁকি দিচ্ছে। তাই এক এক করে কিছু কথা লিখছি।

ব্লাক আউটের পূর্ণিমায়

কয়েকদিন থেকেই বিদ্যুতের চরম অব্যবস্থাপনা সারাদেশের মানুষকে দিশেহারা করে তুলেছে। বিদ্যুতের ঘাটতি সরকার মেটাতে পারছে না বলে ভয়াবহ লোডশেডিং শুরু হয়েছে। একসময় আমরা ইংরেজিতে ‘লোডশেডিং’ প্যারাগ্রাফ পড়তাম, মুখস্থ করতাম। আমার মনে হয় গত চৌদ্দ বছরে এই প্যারাগ্রাফটি বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের তেমন একটা পড়তে হয়নি। বিদ্যুতে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসেছিল। দেশের প্রতিটি গ্রামকে বিদ্যুতের আওতায় আনা হয়েছে। এর ফলও হয়েছে সুদূরপ্রসারী। যোগাযোগ এবং বিদ্যুত এ দুয়ের ফলে অনেক মফস্বলের মানুষ হয়েছে স্বাবলম্বী। চর এলাকাগুলোতে জীবনমানে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। কৃষিতে এসেছে বিপ্লব। কৃষকের মনে আছে প্রশান্তি। দেশকে সত্যিকারের উন্নত করতে চাইলে আমাদের কৃষিকেই আঁকড়ে ধরতে হবে। কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। কৃষক হাসলে, দেশ হাসবে। তবে মধ্যস্বত্বভোগী বদমাশদের কারণে অনেক সময়ই কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পায় না। বাজার মনিটরিং খুব জরুরি। কারওয়ান বাজারের ৩০ টাকার পটল কেন পলাশীর মোড়ে ৮০ টাকা হয় এই রহস্য উদঘাটন জরুরি৷ পেঁয়াজ আমদানির খবর শুনেই ৯০ টাকার পেঁয়াজ কেন ৬০ টাকায় নামে এর কৈফিয়ত তলব করাও সুশাসনের জন্য জরুরি।

পায়রা কয়লা বিদ্যুতকেন্দ্রটি বন্ধ হওয়া এ সময়ের জন্য সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা। তবে শীঘ্রই ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত জাতীয় গ্রিডে দ্রুত যোগ হবে বলে আশ্বস্ত করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। ছোট বাচ্চা এবং বৃদ্ধরা অনেক কষ্ট করছে। তাদের কষ্ট যেন দ্রুত লাঘব হয়, আল্লাহ সহায় হোন।

বিদ্যুত বিপর্যয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার পাশাপাশি নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়ও আছে। বিদ্যুতের অপচয় আমরা রোধ করতে পারিনি। আমরা অনেক সময়, এই গরমের আগেও কাঁথা গায়ে দিয়ে ফ্যান ছেড়ে শুয়ে থেকেছি সারারাত। বিছানা থেকে ওঠে অপ্রয়োজনীয় ফ্যানটা বন্ধ করার আলস্যে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে অনেক বাসাবাড়িতে। অফিসে কেউ নেই অথচ সব ফ্যান চলছে, এসি চলছে, লাইট জ্বলছে। অপ্রয়োজনীয় লাইটিং, সাউন্ড, অটোরিক্সার যত্রতত্র অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার বিদ্যুত অপচয়ের অন্যতম কারণ। আপনি যদি একটু সচেতন হোন তবে বিদ্যুতের অনেক সাশ্রয় করা সম্ভব। আমরা তো তবু কিছুটা সুখ পেলাম। এমন অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম থাকবে কোন আঁধারে ভাবতে পারেন?

গত চৌদ্দ বছরে দেশে যতগুলো কমিটির কাগজ বেরিয়ছে ততগুলো সবরিকলা বা চাম্পাকলাও এদেশে চাষ হয়নি। কারেন্ট নিয়ে এতো এতো ট্রল হচ্ছে অথচ এতগুলো বছর যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত দেওয়া হলো তার জন্য কে দিয়েছিলেন ধন্যবাদটা? সবকিছুরই তো শেষ আছে। এই পৃথিবীর বিদ্যুত, তেল, গ্যাস সবই তো পরিমিত। এগুলোর একটিও যদি চিরতরে শেষ হয়ে যায় তবে আগামির বাংলাদেশ চলবে কীভাবে এই গবেষণা কি কোনো বুয়েটিয়ান, চুয়েটিয়ান, রুয়েটিয়ান করেছেন কখনো ? জানি, তারা করছেন না। কারণ, তারা বিসিএস নিয়ে ব্যস্ত। ঢাকা মেডিকেলে পড়ালেখা করে সর্বোচ্চ মেধাবী ছেলেটি পুলিশের চাকরিতে যায়, এডমিনে যায়, টেক্সে যায়। এরজন্য দায় কার? সমাজের। আমাদের। আমরা তাকে শিখিয়ে দেই- তোমার ক্ষমতা থাকলে এদেশে তুমি ভালো থাকবে। হাতে ছড়ি থাকলে সব পাবে। বন্দুক থাকলে এদেশ তোমার! জনগণের টাকায় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়ে মানুষের সেবা করতে না গিয়ে আত্মস্বার্থজীবী হয়ে সে চলে যাচ্ছে জনতা থেকে নির্জনতায়। একজন ডাক্তারের সেবা আর একজন এসপির সেবায় আকাশপাতাল তফাত। জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আমাদের প্রয়োজন মানবিক ডাক্তার, কসাই নয়। দেশে এখন সেবকের অভাব। যার অভাব নেই তা হলো- কমিটির৷

দেশের অলিতে গলিতে লাখ লাখ সভাপতি আর সেক্রেটারি। একটা ইদগা মাঠেও আছে নবনির্বাচিত কয়েক পদের কমিটি। ইদগা (উত্তরকোণ) ইউনিট কমিটি, এভাবে দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম নামীয় কমপক্ষে হাফডজন কমিটির দেখা পাবেন। একবার কৌতূহল নিয়ে একটি ইউনিট সম্মেলনে গেলাম। একটি দলের ইউনিট কমিটি হচ্ছিল। বহু দেনদরবারের পর ঘোষণা এলো- এলাকার প্রধান গাঁজাখোর হলেন পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক। পনেরদিন আগে চুরি করে ধরা খাওয়া এক বড়ভাই হলেন ইউনিটের সমাজকল্যাণ সম্পাদক। কমিটি ঘোষণার পর আমার মুখ থেকে আপনিই বেরিয়ে এলো- ‘গো@ মারছে গো কাকা!’ চতুর্দিকে কমিটির লোকজন। একজনও তৈরি হয়নি জাতীয় বিপর্যয়ে যার থিওরি আমাদের আলো দেখাবে ব্লাক আউটের পূর্ণিমা হয়ে!!!

জীবনযাপন থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *