সপ্তাহ দুয়েক আগে অনেকদিন পর পাকুটিয়া গেলাম৷ ঢাকা থেকে প্রথম গেলাম টাংগাইলের সন্তোষে৷ মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ সেখানে কিছুদিন থেকে তারপর সিএনজি অটোরিকশা করে পাকুটিয়া৷ যাওয়ার পথে দেলদুয়ার আর লাউহাটির মাঝখানে দেখা যায় সবচেয়ে সুন্দর একটা জায়গা৷ দুই পাশে সবুজ ধানখেত৷ মাঝখান দিয়ে চলে গেছে পিচঢালা রাস্তা৷ রাস্তার দুইপাশে সারিসারি গাছ৷ আগস্ট সেপ্টেম্বর মাসে দুইপাশের ক্ষেতে থাকে পানি৷ হাওরের মতো মনে না হলেও বিলের মতো রূপ ধারণ করে৷ রাস্তার পাশে সারি সারি দেখা যায় যাকে বলা যায় বেড় জালের চৌকি৷ এই জালের সঠিক নাম আমার জানা নাই৷ একটু পরপর জাল তুলে সিজনাল আর পেশাদার জেলেরা৷ তরতাজা ফ্রেস মাছ ধরা পরে৷ অনেকবার ভেবেছি সি এন জি বা বাইক থেকে নেমে মাছ দরদাম করবো আর পছন্দ হলে কিনে নিয়ে যাব৷ কিন্তু তা আর হয়ে উঠেনি৷
এখন রাস্তার দুইপাশে জালের চৌকি নাই৷ পানি এখনো আসে নাই৷ তবে আসবে৷ পানি বাড়ছে নদী আর খালে৷ রাস্তার দুই পাশে এখন ধানের চারা লাগানো ধানখেত৷ পানি আসলে বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে৷ এবার এসব কঁচিকাঁচার ধানক্ষেত দেখতে দেখতে বাড়ি গেলাম৷ যেতে যেতে নদী পড়ে একটা৷ নদীতে স্রোত৷ পানি বেড়েই চলেছে বলা যায়৷ পাকুটিয়ার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ধলেশ্বরী নদীর একটা শাখা৷ স্থানীয়ভাবে বেতুলিয়া নদী নামে পরিচিত৷ এই শাখা নদীর উপর একটা ব্রিজ হয়েছে অনেক আগে৷ নাম বেতুলিয়া ব্রিজ৷ এই নদীর পানি বেড়ে খালে পানি আসে৷ খালটা বয়ে গেছে একেবারে পাকুটিয়া বাজারের গাঁ ঘেঁষে৷ বর্ষাকাল আসলে আর খালে পানি আসতে দেরি হলে আমরা খালের পাড়ের রাস্তা ধরে চলে যেতাম বেতুলিয়া নদীর পেট থেকে আসা খালের লেজে৷ রাস্তাটা চলে গেছে পেত্নীপাড়া গ্রামের ভেতর দিয়ে৷ অনেকে ঠাট্টাতামাসা করে ভূতপাড়াও বলে৷
নদীর পাড়ে গিয়ে আমরা বসে থাকতাম৷ আর হিসাব নিকাশ করতাম পানি আর কতটুকু বাড়লে খালে পানি ঢুকবে৷ নদীর এই জায়গায় খেয়া ঘাটও ছিল একটা৷ এখন ব্রিজ হওয়ায় আর নাই বোধহয়৷ খেয়াঘাট থেকে পশ্চিমে একটু দূরেই ব্রিজ৷ মিলিয়ে দিয়েছে দিঘুলিয়া আর ঘাগড়া গ্রামকে৷ আমরা মাঝেমাঝে নৌকায় চড়ার শখ হলে নদীর এই পাড় থেকে ঐপাড়ে চলে যেতাম৷ আবার ফিরতি নৌকায় এই পাড়ে ভূতপাড়ায়৷ আসার সময় দেখা যেতো সূর্যাস্ত৷ তারপর আবার খাল পাড় ধরে হেটে হেটে বাড়িতে৷
কিছুদিন পরেই পানি চলে আসতো খালে৷ ঘোলা পানি৷ নতুন পানিতে নামতে মানা করা হতো৷ পানিতে কুমির থাকতে পারে৷ নদী থেকে খালে চলে এসেছে নাকি কুমির! আমরা প্রায়ই শুনতাম অমুক গ্রামে একজনকে কুমিরে নিয়ে গেছে৷ গোসল করতে নেমেছিল নদীতে৷ আমি খালে বা নদীতে কখনো কুমির দেখি নাই৷ দেখার শখ ছিল৷ দেখেছি শুধু শুশুক৷ গ্রামে এদেরকে শিশু বলে৷ নদীতে শিশু আসছে৷ প্রথমে ভাবতাম মানব শিশু আবার নদীতে ভেসে আসছে নাকি আবার! শিশু দেখেছি অনেক৷ ডলফিনের মতো দেখতে৷ নৌকায় নদীতে চলাফেরা করলে নৌকার কাছেই এরা ডুবাডুবি করে বেড়ায়৷ ডলফিনের মতোই এরা বন্ধুসুলভ৷
একবার দূরের এক গ্রামে একটা শুশুক ধরা পড়েছিল৷ পাকুটিয়া বাজার থেকে অনেকের সাথে আমিও দেখতে গিয়েছিলাম৷ গিয়ে দেখি মেরে গাছে ঝুলিয়ে রেখেছে৷ আমি ভেবেছিলাম গিয়ে দেখব সাঁতার কাটছে৷ নির্মম৷ কষ্ট পেয়েছিলাম৷
খালের পানি বেড়ে গেলে সেই পানি চলে যায় ক্ষেতে খামারে৷ আমরা খালের পাড়ে পাটখড়ি পুঁতে রাখতাম৷ একদিনে পানি কতটুকু বাড়ে তা মাপার জন্য৷ পানি বাড়লে আনন্দ হতো৷ পোলাপানের চিন্তা৷ বন্যা হলে ফসলের ক্ষতি হবে, মানুষের ঘরবাড়ি ডুবে যাবে, পুকুরের মাছ ভেসে যাবে সব মিলিয়ে বিশাল ক্ষতি বন্যার কারনে৷ এসব চিন্তা পোলাপানের আসার কথা না৷ পানি বাড়লে কলাগাছের ভেলা বানানো যাবে, ধানক্ষেত থেকে মাছ ধরা যাবে, খাল থেকে বড়শি দিয়ে পুঁটিমাছ আর গুলশা মাছ ধরা যাবে এসব চিন্তা আসতো৷
এবার বাড়ি গিয়ে দেখলাম খালে পানি আসেনি এখনো৷ আর খাল বেচারাও আছে চাপে৷ দুই দিক থেকে চাপ খেয়ে হয়ে গেছে সুতানলী সাপের মতো চিকন৷ সুতানলী নামে আদৌ কোন সাপ আছে কিনা তা আমার জানা নাই৷ পাকুটিয়ায় শুক্রবারের হাটে সাপুড়েরা সাপের খেলা দেখাতো আর মহৌষধ বিক্রি করতো৷ আমাদের পোলাপানের আগ্রহ মহৌষধ নিয়ে না, সাপ নিয়ে৷ বাক্স থেকে একটা একটা সাপ বের করতো আর তার সাথে সাপের নাম বলতো সাপুড়ে৷ একটা সুতার মতো চিকন সাপ বের করে বলতো এই সাপের নাম সুতানলী৷ সাপুড়ের কাছ থেকে দেখা আর শেখা এই সুতানলী সাপ আর শব্দটি৷ যাই হউক, খনন করলে সবকিছু বাড়ার কথা৷ কিন্তু এই সুতানলী খালটি খনন প্রকল্পের আওতায় পড়ে না বেড়ে কমে গেছে৷ দুই পাশের মাটি কিছুদিন পর ভেঙ্গে পড়ে খাল আরো ভরে গেছে৷ পাড় ভাঙ্গায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গাছগুলো৷ অনেক গাছ হেলে পড়েছে, ভেঙ্গে পড়েছে খালের উপর৷
যাই হউক, খালে পানি এখনো না আসলেও নদীতে বেশ পানি বেড়েছে৷
বাড়িতে গেলেই আমার ভাইঝি আমাকে ব্যস্ত রাখে সবসময়৷ বিকেলে ভাইঝিকে নিয়ে ফড়িং ধরলাম বাড়ির সামনে৷ আগে এখানে মাঠের মতো ছিল৷ এখন ভাঙারির দোকান৷ তারপরও অনেক গাছপালা আছে৷ তুলসি গাছ আছে কয়েকটা৷ বড় আতা ফল গাছ আর কাঁঠাল গাছও আছে৷
ছোটছোট গুল্মলতার মাথায় ফড়িং এসে বসে৷ ভাইঝি ফড়িং ধরতে বলে আবার ধরার পর ছেড়ে দিতে বলে৷ ফড়িং ধরলে আল্লাহ রাগ করবে তাই৷ আমিও ধরে ছেড়ে দেই৷ আমারও ইচ্ছা ধরে ছেড়ে দেয়াই৷ চুপিচুপি ফড়িং এর পেছন থেকে হাত দিয়ে ধরে ফেলি৷ ছোটবেলায় পাটখড়ির মাথায় জিগা গাছের আঠা লাগিয়ে ফড়িং ধরতাম৷ তারপর ছেড়ে দিতাম৷ মায়া লাগতো৷ আমার ভাইঝির মাথায় এই বুদ্ধি এখনো আসে নাই৷ না আসলেই ভালো৷ আসলেও আল্লাহ রাগ করবে ভেবে বুদ্ধি কাজে লাগাবে না৷ আল্লাহ সুবুদ্ধি দিক সবাইকে৷ সুবুদ্ধিতেই পৃথিবীর কল্যাণ৷ প্রকৃতির কল্যাণ৷