রসুলপুর নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলাধীন শালনগর ইউনিয়নের প্রায় ১ বর্গকিলোমিটার আয়োতনের মধুমতি নদীর পশ্চিম তীর ঘেষা একটি গ্রাম। ১৯৯০ এর দশকে এ গ্রামে ছিল সামাজিক, ধর্মীয় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলতে একটি মসজিদ একটি মক্তব এবং একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ছিলনা কোন মাইক গ্রামের প্রত্যেক প্রান্তসহ পাশ্ববর্তী গ্রাম থেকেও এসব প্রতিষ্ঠানে সালাত আদায় বা পড়াশোনা করতে লোক আসত। দশকের শেষের দিকে একে একে গ্রামে মসজিদের সংখ্যা হয় ৩টি মাইকের সংখ্যাও হয় ৩টি গ্রামের সবচেয়ে পূরাতন মসজিদ থেকে শুরু হয় মাইক সংযোগের পালা। বর্তমান মসজিদ, মক্তব এবং মাইকের সংখ্যা ৭টি আর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২টি।
সর্বশেষ মসজিদে মাইক কেনার আগে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল পার্শ্ববতী অনেক গুলো মসজিদ থেকে আযানের ধ্বনি শুনা যায় নতুন মসজিদ থেকে সুতরাং নতুন মসজিদে মাইকের দরকার হবেনা। কিন্তু সে প্রস্তাব ঠাই পায়নি মসজিদ চালু হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই মাইক কেনা হয়েছে। যদিও কয়েক দশক আগের ন্যায় মানুষের কন্ঠে মমতা মিশ্রিত যে আজানের ধ্বনি শুনা যেত সেটি এখন আর শুনা যায়না।
পার্শ্ববর্তী গ্রাম শিয়রবর সূরমা ইটের ভাটার পূর্বপার্শ্বে এবং পশ্চিম পার্শ্বে মাত্র পঞ্চাশ গজ দুরত্বে দুটি মসজিদ। একটু পশ্চিম দিকে এস এইচ বি আর আলিম মাদ্রাসায় একটি মসজিদ এবং মাদ্রাসার পূর্ব ও পশ্চিম পার্শ্বে প্রায় ৫০ থেকে ১০০ গজ দূরুত্বে দুইটি মসজিদ এবং প্রত্যেকটিতেই রয়েছে মাইক।
প্রত্যেকটি মসজিদ যে তাক্বওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়নি সেটি প্রতিষ্ঠাকালীন ইতিহাসের খোঁজ নিলে পরিষ্কারভাবে বুঝা যায়। কোন কোনটি দিরার বা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করার জন্য প্রতিষ্ঠত হয়েছে। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করার জন্য নির্মিত দিরার মসজিদ ভেঙ্গে ফেলার জন্য রাসুল সা. সাহাবীদের নির্দেষ দিয়েছেন এবং সাহাবীরা দিরার মসজিদ ভেঙ্গে ফেলেছেন এমন ইতিহাসও বিদ্যমান। অন্যদিকে দিরার মসজিদে সালাত আদায় করতে নিষেধ করে আল্লাহ ঘোষনা করেছেন “(হে নবি) আপনি কখনো দিরার মসজিদে সালাত আদায় করার জন্য দাড়াবেননা তবে যে মসজিদের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে তাক্বওয়ার উপর প্রথম দিন থেকে সেটিই আপনার দাড়ানোর যোগ্য স্থান। সেখানে রয়েছে এমন লোক যারা পবিত্রতাকে ভালবাসে। আর আল্লাহ পবিত্র লোকদের ভালবাসেন।” (সূরা তওবা-১০৮)
মসজিদ হলো আল্লাহর ঘর সেটি দলাদলি নয় বরং শুধু আল্লাহর ইবাদতের জন্য প্রতিষ্ঠিত হতে হবে “আর নিশ্চয় এই মসজিদ আল্লাহর সুতরাং তোমরা আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে ডাকিও না।” (সূরা জ্বীন-১৮)
এমনকি আল্লাহর ঘর কারা পরিচালনা করবেন সেটিও আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন যদিও খোঁজ নিলে অনেক মসজিদ পরিচালনায় সূদখোর, ঘূষখোর, আত্মীয়ের সম্পর্ক ছিন্নকারী বা মানুষের হক নষ্টকারীদের পাওয়া যাবে। “আল্লাহর ঘর মসজিদ পরিচালনা করবে যারা আল্লাহ এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাস করে, সালাত প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত আদায় করে এবং আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করেনা। আশা করা যায় তারা হিদায়েত প্রাপ্তদের অর্ন্তভ‚ক্ত।” (সূরা তাওবা-১৮)
আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আমাদের শিক্ষা দিলেন হিকমত এবং সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আল্লাহর পথে মানুষকে আহ্বান করার জন্য কিন্তু আমাদের দেশে শুরু হলো প্রায় ৫০ গজ অন্তর অন্তর দলাদলির মাধ্যমে মসজিদ নির্মাণ করে এবং প্রত্যেক মসজিদে মাইক সেট করে উচ্চ আওয়াজে শব্দ দূষণ করে রাত ২ টা থেকে সাহরি শেষ অবধি রান্না করার জন্য, সাহরি খাওয়ার জন্য ডাকাডাকির প্রতিযোগিতা। শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ, বিধর্মী, শ্রমিক, কৃষক বা কর্মজীবি কেউ রেহায় পায়না উচ্চ স্বরে দীর্ঘক্ষণ ধরে ডাকাডাকি থেকে যদিও রাতে সঠিকভাবে ঘুমাতে না পারলে পরবর্তী দিন সঠিকভাবে কাজ করতে পারবেনা কর্মজীবিরা ফলে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়বে। অন্যদিকে শিশু, বৃদ্ধ বা অসুস্থ সকলে হয়তো সিয়াম পালন করবেনা বা করলেও সকলে রাত ২টা থেকে প্রায় ভোর ৫টা পর্যন্ত জেগে থাকবেনা তাদেরকে মাইকে উচ্চ স্বরে ডাকাডাকি করে বিরক্ত করা হয়। “তুমি তোমার রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশ দিয়ে ডাক।” (সূরা নাহল-১২৫)
আবার এদেশে মুসলিম ব্যতিত অন্যান্য ধর্মের লোকও বসবাস করে তাদেরকে বিরক্ত করাও যাবেনা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ রব্বুল আলামিন ঘোষণা করেছেন “ধর্ম নিয়ে কোন বাড়াবাড়ি নয়” (সূরা বাকারা-২৫৬) আবারও তিনি আমাদের আরো সতর্ক করে ঘোষণা করেছেন “তোমাদের ধর্ম তোমাদের কাছে আর আমার ধর্ম আমার কাছে” (সূরা কাফিরুন-০৬)
আল্লাহ পবিত্র কুরান মাজীদে সাহরি এবং ইফতারের সময় স্পষ্ট এবং নির্দিষ্ট করে ঘোষণা করেছেন তাছাড়া বর্তমান আমাদের প্রায় প্রতি পরিবারে এলার্ম সেট করার বিভিন্ন উপকরণ রয়েছে তাহলে আমরা মাইকে শব্দ দূষণ করে নির্বিচারে সাধারণ মানুষের ক্ষতি করছি কেন? “সুবেহ সাদিকের শুভ্ররেখা কালোরেখা থেকে সুস্পষ্ট হওয়া পর্যন্ত খাও এবং পান কর অতঃপর রাত অবধি রোজা পূর্ণ কর।” (সূরা বাকারা-১৮৭)
রমজান মাসে রোজা পালন, ফরজ সালাত আদায়, তারাবীহ্ সালাত আদায়ের সাথে তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কিন্তু এই গভীর রাতে মাইকে উচ্চ স্বরে ডাকাডাকির কারনে খুশুগুজু সহকারে তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করাও মুশকিল। মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন “(গভীর)রাতের কিছু অংশ তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করবে এটি আপনার জন্য অতিরিক্ত কর্তব্য আশা করা যায় আপনার পালনকর্তা আপনাকে প্রতিষ্ঠিত স্থানে প্রশংসিত করবেন।” (সূরা বনী ঈসরাঈল-৭৯)
ফজরের সালাত পরবর্তীতে আবার এই মাইকে মক্তবের শিক্ষার্থীদের ডাকাডাকি শুরু হয়। পৃথিবীর কোন স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিসে বা আদালতে এমনকি কিন্ডার গার্টেনের শিশু বাচ্চাদেরও মাইকিং এর মাধ্যমে ডাকাডাকি করতে হয়না। তাহলে মক্তবের শিক্ষার্থীদের কেন ডাকতে হবে এটা নিয়ে আমাদের নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আর দিন ভরে মাইকে বিভিন্ন পণ্যের বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন, রাজনৈতিক, ধর্মীয় সমাবেশের ঘোষণা ও সমাবেশ, পারিবারিক, সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্সের শব্দ, ইট ভাঙ্গার যন্ত্র, স্থানীয় ভাবে তৈরিকৃত বিভিন্ন উচ্চ শব্দের যানবাহনের যন্ত্রনাতো আছেই।
বাংলাদেশ শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালায় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে রাত ৯ টা থেকে ভোর ৬ টা পর্যন্ত ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্যান্য সময় ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করতে পারবেনা। হাসপাতাল, শিক্ষাপতিষ্ঠান, অফিস আদালত আশপাশ ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। (তথ্যসূত্রঃ বিবিসি বাংলা, নভেম্বর ২১, ২০২০)
অন্যদিকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রি মোঃ শাহাব উদ্দিন শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রনে উচ্চ শব্দের মাইক ব্যবহার বন্ধ করার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, শব্দ দূষণের ফলে ৩০ ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। গবেষণার ফলাফলের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “শব্দ দূষণের ফলে শিশু মানসিক প্রতিবন্ধি হতে পারে। মাত্রাতিরিক্ত শব্দ মানসিক ক্লান্তি ও অবসাদ, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্নায়বিক সমস্যা, অমনোযোগিতা সৃষ্টি এবং স্মৃতিশক্তি হ্রাস করে। এসব ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে শব্দ দূষণের সব উৎস নিয়ন্ত্রন করতে হবে।” (তথ্যসূত্রঃ বাসস, অক্টোবর ২৭, ২০২২)
উচ্চ আওয়াজে মাইকের ব্যবহারের ফলে কত ডেসিবেল শব্দ দূষণ তৈরি হয় সেটি যন্ত্র সেট করলে বোঝা যায় তবে সাধারণ মানুষের ক্ষতি অব্যাহত আছে সেটি অনুমেয়। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং আবাসিক এলাকাও হাসপাতাল, শিক্ষাপতিষ্ঠান, অফিস আদালত এর ন্যায় নীরব এলাকা ঘোষণা করে শব্দ দূষণ করে এমন যন্ত্রের ব্যবহার আইন করে এখনই বন্ধ করতে হবে।
মুহাম্মদ আল্-হেলাল
এমফিল গবেষক (এবিডি)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
+৮৮০ ১৯১১ ৯৮১১৪৪
alhelaljudu@gmail.com