প্রথম পাতা » জীবনযাপন » ডিম আগে না মুরগি আগে?

ডিম আগে না মুরগি আগে?

hen or egg

বউ ইদানিং খুব ঝামেলা পাকাচ্ছে। ক্রমশ তার সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে। বাজার থেকে ফেরার পর তার সন্দেহ আরো তীব্র হয়। আমার যেহেতু একটাই বৌ সুতরাং ঝামেলা সামাল দিয়েই চলতে হয়। তাকে হাতে ধরে কিরা কসম কেটে বুঝাই যে সে-ই আমার একমাত্র। মাঝে মাঝে বাংলা সিনেমার গানটানও ধরি : ‘তোমার আগেও আর কেউ নাই, তোমার পরেও আর কেউ নাই, আমি আশিক, তুমি প্রিয়া!’ বৌ হাত ঝটকান দেয় : ‘বুইড়া বয়সে আর ঢং ঢাং করা লাগব না। বাজারের হিসাব দেও। ডিম কি এক হালিই কিনছিলা? নাকি দুই হালির অর্ধেক এই বাসায় আনছো?’

আমারে পাগলা কুত্তায় কামড়াইছে? ৫০ টাকা ডিমের হালির যুগে কারো সাথে লদকালদকি করব? এক সংসার চালাইতে গিয়েই মাঝে মধ্যে ভুলে বৌরে ডাকি খালাম্মা! এবার আসল কথায় আসি। আমার বৌয়ের বিশ্বাস কেনাকাটায় আমি দরদাম করি না। যেমন, তার ভাবনা ডিমের দামে একটু দামাদামি করলেই চল্লিশে দিতে পারে। কারণ ডিমতো পঁচনশীল। কিন্তু তারে আমি কেমনে বুঝাই এই দ্যাশে পঁচনশীল কেবল মানুষ! মানুষই একমাত্র এ ভূ-খণ্ডে কাঁচামাল আর সবই পাকামাল। আমি তাকে আশ্বস্ত করে বলি : দরদাম করি গো! কাম হয় না!

কাল রাতে ডিম আনলাম পঞ্চাশ টাকা হালি। বৌ জিজ্ঞেস করল : দাম করো নাই? মনটায় চাইল কানের নিচে একটা মারি। একবার এক চড় মেরে শেষ পর্যন্ত বিষয়টা পা অবধি গড়িয়েছে। থাক, মেয়ে মানুষ। দিনদুনিয়া বুঝে কম। ‘কে হায় হৃদয় খুড়িয়া’ পা ধরতে ভালোবাসে? রাগ চাপা দিয়ে বললাম : দাম করেই এনেছি। ষাট চাইল, পঞ্চাশে আনলাম! জিতছি না?

‘তোমার আবার জিতা! কোনোদিন তো জিততে দেখলাম না!’ ‘কও কী, তোমারে পাইয়া জিতছি না!’ মৃদু হাসির রেখা দেখলাম ঠোঁটে! দুর্মুল্যের বাজারে সকাল বেলায় হালকা হাসিটাও প্রাণে দোলা দেয়। বুঝলাম, বাংলা পড়ে খারাপ করি নাই! ভিতর থেকে কথা বাইর হয়!

বাজারের ব্যাগ হাতে বৌ বলল : চল, আজ আমিও যাব বাজারে। দোকানদাররা তোমাকে খালি ঠকায়। দেখি কম দামে জিনিস পাওয়া যায় কি না! মেজাজ এবার সত্যি খারাপ হলো। নারী মা হিসেবে সেবিকা, বোন হিসেবে স্নেহপরায়ণ, স্ত্রী হিসেবে ঘ্যানঘ্যান প্যানপ্যান। আমি না হয় এসব সহ্য করি, বাজারের লোক সইবে কেন? ভাবলাম, যা গরম! যাক মজা বুঝে আসুক। আমিও হাত তুলতে পারিনা, গরমে একটা চিকন শাস্তি হোক! আচ্ছা, চল যাই।

ছোট পোলা সঙ্গে গেলো। রিক্সায় উঠেই সে চিৎকার শুরু করল : আম্মু দুদু খাব! নে, এইবার বাজার কর। রিক্সায় দুদু খাওয়াও! পোলারে আছাড় মারতে গিয়েও মারলাম না। চিপস দিয়ে তাকে শান্ত করা হলো। গলির মুখে ঢুকতেই এক বদমাশ বলল : আপা, ডিম নেন। চল্লিশ টাকা হালি! আমি শুনেই বিষম খেলাম! কয় কী? গতরাতেও তো…!

বৌ দরদাম করে পঁয়ত্রিশে নামাল। আমাকে দেখিয়ে দিয়েছে- এমন একটা ভাব নিয়ে পুরা এক ডজন কিনে ফেলল। এদিকে আমি তো ঘামছি। আজকে আমার খবর আছে! কিন্তু এই শালার ঘটনা কী? এতো কমে কেমনে কী?

ঘটনা হলো : এই বেহেশতি ফেরেস্তা ভাই দাম বাড়বে মনে করে দুইদিন আগে বিশ হাজার ডিম কিনেছে। কিন্তু তীব্র গরম, কারেন্ট নাই তাই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার যোগাড়! তাই লস দিয়ে হলেও টাকাটা তুলতে চাচ্ছে, অন্তত লোকসানটা কম হোক! শালা ডাকাইত!!

বরাবরের মতো সকালেই বৌ এর কাছে হেরে গেলাম। বাজার শেষে ফিরতি পথে পোলাকে ধমকাচ্ছি। বজ্জাত পোলা! রাস্তাঘাটে এটা খাব, ওটা খাব! বৌ রাগের কারণ ধরতে পেরে মিটিমিটি হাসছে।

নাস্তার টেবিলে খবর দেখলাম কোনো এক এমডির বেতন সাড়ে ছয় লাখ! আবার চা শ্রমিকদের বেতন ১২০ টাকা রোজ! কিন্তু বছর শেষে উভয়ের মাথাপিছু আয় আড়াই লাখ টাকা! জটিল হিসাব! ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’ এই মীমাংসা এই প্রশ্নের কাছে কিছুই না। বৌকে বললাম একটু চা দাও। ‘গ্যাস শেষ!’ কারেন্টের হিটারে গরম কর। ‘কারেন্ট নাই!’ সকাল বেলায়ই ‘শেষ’ আর ‘নাই’ দিয়ে শুরু! সকালটা হালকা করা দরকার। কেমন জটিল হয়ে যাচ্ছে!

বৌকে বললাম : বল তো ডিম আগে না মুরগি আগে?

– জনগণ আগে
ধূর! আমি কই কী! আমার সারিন্দায় বাজায় কী! ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’?

– মানুষের দাম আগে। ১২০ টাকায় কারো একবেলাও চলে না।
বেতন বাড়ানো হয়েছে তো! ২৫ টাকা বেড়ে ১৪৫!

– মানুষকে নিয়ে তোমাদের মজা করার রেওয়াজটা গেলো না।
থাক না ওসব। তুমি আমার প্রশ্নের উত্তরটা অন্তত দাও। চা তো দিলে না! চিনি ছাড়া!! কড়া লিকার!! বল, ডিম আগে না মুরগি আগে?

– তোমরা যারা সাড়ে ছয় লাখ টাকা বেতন নাও, আর ২৫ টাকা বাড়িয়ে এককাপ কড়া লিকারের চা খেয়ে তৃপ্তির সঙ্গে মনে কর জনগণের জন্য বিরাট কিছু করলে তাদের থেরাপির জন্য ডিম আগে!
বাজারে গেলে সবার মাথাই খারাপ হয়! আমার সামনে বারটি আস্ত ডিম! ‘আচ্ছা, আজ তাপমাত্রা কত ডিগ্রি’ বলে একটা উছিলা নিয়ে বৌ এর সামনে থেকে কেটে পড়লাম!

জীবনযাপন থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *