প্রথম পাতা » মতামত » সর্বজয়া বঙ্গমাতা

সর্বজয়া বঙ্গমাতা

Sheikh Fazilatunnesa Mujib

বাংলা ভূ-খণ্ডে জন্ম নেওয়া একমাত্র নারী যাঁর স্বামী একটি দেশের মহান স্বাধীনতার স্থপতি-বঙ্গবন্ধু-জাতির পিতা! বাঙালি নারী হিসেবে তাঁর পতিভাগ্য অত্যন্ত সুপ্রসন্ন! বাংলা ভূ-খণ্ডে জন্ম নেওয়া একমাত্র বঙ্গমাতা যাঁর একজন কন্যা একটি দেশের চারবারের নির্বাচিত সরকার প্রধান। এশিয়া মহাদেশের অন্যতম একটি রাজনৈতিক দলের সভানেত্রী তাঁর প্রথমা কন্যা, তিনি জননেত্রী, তিনি দেশরত্ন! মা হিসেবে তাই তিনি রত্নগর্ভা। বাংলার জমিনে এমন ইতিহাস রচনাকারী আর কোনো নারী জন্ম নেননি। আর তাই তিনি অনন্যা।

এই নারীর বিয়ে হয়েছিল অল্পবয়সে। বিয়ের অনেক দিন পর তাঁর বাসর হয়েছিল। বাবা-মাকে হারিয়েছিলেন সেই ছোট বেলায়। তাই তিনি জানতেন শোক আর ত্যাগের স্বরূপ। যাঁর সাথে তাঁর বিয়ে হলো তিনি কেবল একজন রক্তমাংসের মানুষ নন- তিনি একটি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীনতার মহান কারিগর। তাঁকে চিনেছিলেন এই নারী। তাই শেখ মুজিবের প্রতি তাঁর কোনো অভিযোগ-অনুযোগ ছিল না। শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ হওয়ার সমস্ত আয়োজনে তিনি ছিলেন রুধির ধারার মতো। তিনি বঙ্গবন্ধুকে প্রকৃতই ভালোবাসতেন। তাই তাঁর প্রেমের আলোয় বঙ্গবন্ধু পথ চিনে নিয়েছিলেন বিকাশের। বঙ্গবন্ধু বিকশিত হয়েছিলেন বাংলার রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে, জেল-জুলুম অত্যাচারে তিনি কখনো নিবৃত্ত হননি। বলা যায় রেণু নামের মেয়েটির ভালোবাসা শেখ মুজিবকে ক্লান্ত হতে দেয়নি। যৌবনের চৌদ্দটি বসন্ত শেখ মুজিবের কেটেছে জেলে, সর্বংসহা এই নারীর জীবনে বসন্ত মানে শেখ মুজিবের ‘জাতির পিতা’ হওয়ার গল্প।

এই নারী কোথাও রাজনৈতিক ভাষণ দেননি, দল চালাননি, রাজনীতির মাঠে হাঁটেননি। তবু বাংলার মানুষের ঢল ছিল ধানমন্ডির হেঁসেলের পানে, বেগম মুজিবের রান্নাঘরের দিকে। ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত মানুষেরা শ্লোগানে শ্লোগানে শুকনো গলা ভিজিয়েছেন বঙ্গমাতার শরবতের জলে, কখনো স্নেহের পরশে।

১৯৬৯ সালের গণ-অান্দোলনে গণজোয়ার যখন চরমে তখন সরকার আলোচনায় বসল। বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হবে- এমন একটি গুঞ্জন শোনা গেলো। এ খবর পেলেন বেগম মুজিব। তিনি সাথে সাথে চিরকুট পাঠালেন তাঁর স্বামী শেখ মুজিবকে- ‘তুমি যদি প্যারোলে মুক্তি নাও তবে বাংলার জনগণকে নিয়ে আমি তোমার বিরুদ্ধে আন্দোলন করব।’ বঙ্গবন্ধু শর্তাধীন কোনো মুক্তি নিলেন না। ফলে ৬৯ এ সৃষ্টি হলো এক প্রলয়ঙ্কারী ইতিহাস। এতে সরকার সত্তরের নির্বাচন দিতে বাধ্য হলো। বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ছিলেন এমনই দূরদর্শী এক বাঙালি নারী।

৭ মার্চের ভাষণের আগের দিন বঙ্গবন্ধু পায়চারী করছেন। কী বলবেন এই নিয়ে ভাবনা। বেগম মুজিব তাঁকে পথ দেখালেন। বললেন- ‘বাংলার মানুষকে দেখে তোমার মনে যা আসবে তাই বলবে কাল। তুমি তাই বলবে যা তুমি বিশ্বাস কর এবং হৃদয়ে লালন কর।’ এরচেয়ে সুন্দর পরামর্শ আর কী হতে পারে!

বঙ্গবন্ধু সবসময় টেবিলে কাউকে না কাউকে নিয়ে খাবার খেতেন। কিন্তু এতে বেগম মুজিব কখনো বিরক্ত হতেন না। যুদ্ধের আগে একদিন সকালে বঙ্গবন্ধু ৩২ নম্বরের বাড়িতে হাঁটছেন। একজন হাবিলদার সেরাতে ডিউটিতে ছিল। বঙ্গবন্ধু সকালে তাকে পেয়ে বললেন- ‘আমাকে পাহারা দিচ্ছিস?’ হাবিলদার বলল- ‘জি, আপনিই এখন বাংলাদেশ।’ বঙ্গবন্ধু তাকে জিজ্ঞেস করলেন- ‘আমার জন্য কী করতে পারবি?’ হাবিলদার বলল – ‘আপনি বললে ছাদ থেকে লাফ দিতে পারি!’ বঙ্গবন্ধু তার হাত ধরে ওপরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন আর বলছিলেন- ‘চল, আজ তোর পরীক্ষা নেব। তুই কি সত্যই লাফ দিতে পারিস কি না, দেখব !’

বঙ্গবন্ধু হাবিলদারকে নিয়ে গেলেন রান্নাঘরে। বেগম মুজিবকে বললেন- ‘এই তোমার আরেক ছেলে। আমাদের নাস্তা দাও তো!’

বেগম মুজিব ছোটবেলায় সবাইকে হারিয়ে বাংলার মানুষকেই করেছিলেন পরম আপনজন। তাই তিনি সর্বংসহা হয়ে নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন। এমন জেলজীবন কাটানো একজন স্বামীর সংসার করেও পাঁচটি সন্তানকে পড়ালেখা করিয়েছেন। কাউকে বখাটে হতে দেন নি। বাংলার কতজন সাবেক রাষ্ট্রপতির সন্তানরা ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার মতো যোগ্য সেটা গবেষণার বিষয়। কিন্তু বেগম মুজিব তাঁর সকল সন্তানকেই যোগ্য করে তুলতে পেরেছিলেন।

১৫ আগস্টে শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়নি। একটা বংশকে নির্বংশ করার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। ১৫ আগস্টকে বৈধতা দিতে গিয়ে ব্যাংক ডাকাতি, লাম্পট্য আরো কতরকম গল্প তৈরি করা হয়েছে বাংলার জমিনে তার শেষ নেই । অপরাধ যে করেছে তাকে মারেন কিন্তু শেখ রাসেলকে মারা হলো কেন? বেগম মুজিবের মতো স্নেহপরায়ণ একজন মাকে কেন হত্যা করা হলো? এসবের পেছনে আছে অন্য এক কলঙ্কময় গাথা। হয়তো আজ আর কারো সেটি অজানা নয়।

‘জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা।’ সত্যিই তিনি ভেতরে ভেতরে জেগে উঠেছিলেন পরম যত্নে। বেগম মুজিবের অবদান বাঙালির ইতিহাসে চির অমলিন। তাঁর ত্যাগ ও ভালোবাসার মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। তাঁকে আরো জানার জন্য পাঠ্যপুস্তকে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
‘নারীর কারণে সবই হয় নারীর কারণে’ কিংবা ‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর!’ বাংলার স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনার পেছনে বাংলার এই মহীয়সী নারীর অবদান সবচেয়ে বেশি।

কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয়-

“কত মাতা দিল হৃদয় উপরি, কত বোন দিল সেবা
বীর স্মৃতি স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?”

দেরীতে হলেও শেখ ফজিলাতুন নেছার পাঠ এ জাতির মাঝে শুরু হয়েছে। সেটাও কম সুখকর নয়।

মতামত থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *