আমরা প্রবাসী, ও ভাই আমরা প্রবাসী। হ্যাঁ, জরুরৎ-এর তাগিদে আমরা দেশ ছেড়ে বিদেশে আছি। বিদেশে আসার পর ধিরে ধিরে অনেকের পরদেশি এক বা একাধিক বা কতিপয় বন্ধু তৈরি হয়। অনেকের সঙ্গে পরিচয় হায়। কিছু কিছু লোকের সাথে সম্পর্ক একটু বেশি হয়ে থাকে। ধিরে ধিরে এক দুই লাইন করতে করতে অবশেষে সে দেশের ভাষাও টুকটাক শেখা হয়ে থাকে। জবানে চর্চা হতে থাকে তাদের বাগ্বিধি। আবার আমরাও সুযোগ বুঝে কোপ মারি। অর্থাৎ বিদেশীদের একটা দুইটা করে বাংলা বাক্য বা বোল শেখানোর চেষ্টা করে থাকি। অবশ্য সব প্রবাসী যে এই তালিকায় আছেন, তা কিন্তু নয়।
নাম তার লুডু, সাউথ আফ্রিকান, বয়স ৬০ হতে পারে। তাকে বাংলা শেখার প্রতি একটা আগ্রহ দেখি। কোনো বাংলাদেশী ভাই হয়তো তালিম দিচ্ছেন তাকে। শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ঢাকা, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, মুন্সিগঞ্জসহ কিছু জেলার নাম মুখস্থ আছে। আবার, এক টাকা, দশ টাকা, একশ, পাঁচশ, হাজার টাকা বলতে পারে। লাথি দিমু, আমি গরীব মানুষ, টাকা নাই, এমন কিছু কথাও দুই একটা উচ্চারণ করতে পারে।
এক কেজি চাল দে, ডাক্তার দেখামু টাকা দে, তোদের ভোট লাগবে না, এই হাসিস ক্যান, পড়া পারিস না কান টানে লাল করে দিমু, হেতো ভাত খাচ্ছিস ক্যান, আমি ড্রাইভিং পারি না কাপড় সেলাই করতে পারি, ভাজা পোড়া খাই না পেট ব্যাথা করে, এই ছেলে বাড়ি যা মা ডাকে। এমন ধরনের উক্তিও বহু বলে থাকে।
এই লুডু কিছু বাংলা গানেরও আংশিক অশুদ্ধ সা-রে-গা-মাহীণ সুর করে গাইতে পারে। এসব গানের মধ্যে আছে : মধু হই হই ওরে বিষ খাওয়াইলা, চুমকি চলেছে একা পথে, ও মোর ময়না গো, বোরকা পরা মেয়ে পাগল করেছে, হাত ধরে নিয়ে চলো পথ চিনি না, ইত্যাদি ইত্যাদি।
আরও একজন আছে লুডুর মতো, নাম ফেড্রী। বয়স হবে প্লাস মাইনাস কুড়ি। সেও কোনো এক বাংগালী ভাইয়ের কাছ থেকে টুকরো টুকরো বাংলা শিখেছে। তার বাংলা শেখার মধ্যে আছে : ধর সাইকেল মুতে আসি, পাতলা পায়খানা যেখানে সেখানে করিস না, প্রেম করা ভালো না, আমার গার্ল ফ্রেন্ড দশটা, এমন এমন অদ্ভুত বাক্য বলে থাকে। কিছু বাংলা গানের দুই এক লাইনও কন্ঠস্থ করতে পেরেছে। যেমন : কালো বন্ধুর প্রেমে পরেছি, আমার সরল মনে গড়ল ঢেলে কেন দূরে চলে গেলে।
এতক্ষণে যে সমস্ত বাক্য বা বাংলার কথা বলে গেলাম এগুলোতে দুঃখ নেই, বরং একটু মজা পাই। হাসি পাই, হাসতে ইচ্ছেও করে। বিদেশীদের কেউ বাংলা বললে ভালো লাগে, ভালো লাগারই কথা, সবারই ভালো লাগে। অল্প অল্প বললেও ভালো লাগে। গানের দুই এক লাইন পারে, তাও ভালো লাগে।
কিন্তু, এই লুডু আর ফেড্রী কিছু বাংলা শিখেছে যা মুখে উচ্চারণ করা যায় না, যা লিখতে পারছি না। তাদের মুখে উচ্চারিত উপরে উল্লেখিত বাংলা সমূহ আমাদের কয়েকজন বন্ধুর সামনে ব্যবহার করলে আপত্তি থাকে না। কিন্তু যখন বিশ্রী বাক্যগুলো উচ্চারণ করে থাকে তখন লজ্জায় মাথা একদম হেড হয়ে যায়। যে বিশ্রী বা বেঢপ বাক্যতে আমাদের আবরূতে আঘাত করে । বাংলা ভাষায় যে বাহাদুরি আছে, তাতে আঘাত করে।
ওরা যখন হাসির ছলেও শব্দ সমূহ বলে থাকে তখন হয়তো ওরা জানে না ওগুলোর অর্থ প্রকাশে কি মর্মার্থ হতে পারে। তবে আমরা কিন্তু মর্মার্থ বুঝতে পেরে মর্মদাহীতে জ্বলিত হই। লুডুদের উপর আক্রশ ঝারতে শরীরের টেম্পার যতটুকু হাই হয়, তার চেয়ে বেশি আক্রশ ঝারতে মন চায় তাদের প্রতি, যারা ফেড্রীদের এমন উপযুক্ত বাজে বাক্য তামিল দিচ্ছে।
আমরা কেন লুডু-ফেড্রীদের এমন বিশ্রী বাংলা বাক্য শেখাচ্ছি? আমরা কেন বাক্য বুঝি না? যিনি বা যাহারা এদের এমন বদ হজমি বাক্য শেখাচ্ছে, সেই সব পন্ডিতেরা কেন বাক্য বুঝতে পারে না? ভালো বাংলা শেখানো, সেটা তো সুন্দর লাগে। কিন্তু রাবিশ খবিশ বাংলা শিখিয়ে নিজেদের গালাগালি নিজেরাই কেন হজম করার জন্য অধীর আগ্রহে ধৈর্য ধরি?
এক বাংলাদেশী ভাই হয়তো ওদের এতো কুৎসিত বাংলা বাক্য শিখিয়ে আত্মতুষ্টির মাঝে ডুবে আছেন অথবা নিজে নিজে বাহবা নিয়ে গর্বের বাগিচায় সুবাতাস নিচ্ছেন। কিন্তু তাকে এতটুকু বুঝতে হবে যে, আপনার শিক্ষা দেওয়া দুর্গন্ধ বাংলা বাক্যগুলো আপনার এক বন্ধু বা দেশীয় ভায়ের গায়ে লাগাচ্ছে, যে সমস্ত রূচিবিরোধী বাক্যতে আমার-আপনার নিকট-জন জড়িয়ে আছে।
কেপটাউনে অনেক এলাকাতে এই লুডু ও ফেড্রীর মতো এমন বাংলা ভাষা পারঙ্গম আফ্রিকানের সৃষ্টি আছে। আর এদেরকে বানাচ্ছি আমরাই। অসৌজন্যমূলক বাক্যগুলো লুডু ও ফেড্রীদের না শেখালে নিজের ব্রেনওয়াশের ঘাটতি খুব বেশি হয় কি?