প্রায়ই একটা কথা চাউর হয় ঢাবি এশিয়ার সেরাদের তালিকায় নেই, বিশ্বসেরার তালিকায় হাজারের পরে সিরিয়ালধারী। একসময়ের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড আজ এই দশায় পতিত কেন? প্রশ্নটা খুবই স্বাভাবিক এবং ঢাবির একজন প্রাক্তন হিসেবে এসব খবরে আহত হই বৈকি!
বাংলাদেশ স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি ধর্মীয় উন্মাদনায় নিপতিত হয়েছে এটা তো দিবালোকের মতো সত্য। সবকিছুতে ধর্মীয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, ধর্মকে টেনে আনা এক ধরনের রোগে পরিণত হয়েছে। এগুলোর কোনটা লোকদেখানো, কোনটা রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ।
বাংলাদেশের স্কুল-কলেজে পাঠদানকারী শিক্ষক সম্প্রদায়ের একটা বিরাট অংশ কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মাঝে কৌশলে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে দেন। যারাই একটু প্রগতিশীল চিন্তা করতে যায় তারাই এখন কোণঠাসা। ধর্মকে সহজেই ব্যবহার করা যায় বলে অনেক ক্ষেত্রেই আপস কিংবা নির্লিপ্ত থাকতে হয় তুলনামূলক সাম্যে বিশ্বাসী মানুষদের।
সাম্প্রদায়িকতার বিষে জর্জরিত কোমলপ্রাণ ছেলেমেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেও মুক্তমুদ্ধির চর্চাকে তারা মেনে নিতে পারে না। জগত ধর্ম-বর্ণ-পেশার বৈচিত্র্যেই সুন্দর এটা তারা মানতে চায় না। অন্যের মতকে বেপরোয়াভাবে পরাস্ত করতে চায় তারা।
একসময় ঢাবিতেও ভিন্নদলমতের বিস্তার ছিল। হঠাৎ করেই গত দুই দশকে রাজনৈতিক মেরুকরণে সব কেমন উলট পালট হয়েছে। আমরা দেখেছি ঢাবির ছাত্রলীগ, ছাত্রদল একসাথে ধর্মকে ব্যবহার করা ছাত্র সংগঠনকে কীভাবে একাত্ম হয়ে প্রতিহত করেছে। গণতন্ত্রের সৌন্দর্যকে তো আর অস্বীকার করা যায় না।
এখন ক্যাম্পাসে সেদিন নেই। তাই সুবিধাবাদীরা, স্বাধীনতাবিরোধীরা কিন্তু বসে নেই। তারাও এখন খোলস পাল্টেছে। ছাত্রলীগে এখন তাই বিচিত্রলীগ ভরপুর। সুস্থ রাজনৈতিক চর্চার অভাব এর জন্য অনেকটা দায়ী। ধর্মীয় উগ্রবাদীরাও এখন ছাত্রলীগের নামে রাজনীতি করে। মানুষ হত্যা করেও ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেয়। এদের চিহ্নিত করতে হবে। বাংলার রাজনীতি থেকে ধর্মান্ধ তাড়াতে হবে সর্বাগ্রে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যতই পেছনের সারিতে থাক তবু বাংলার প্রগতিশীল মানুষেরা এটাকেই শেষ ভরসা করতে চায়। এতে ঢাবির দায় অনেক।
আজ আমারই এক ছাত্র যে ধরনের উগ্র ধর্মীয় পোস্ট দিয়েছে তাতে আমি আহত এবং অবাক হয়েছি। ১০ বছর আগেও ঢাবির কোনো ছাত্রের পক্ষে এ ধরনের কথা বলা অসম্ভব ছিল। দেখলাম তার পোস্টে সহমত ভাইরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তার মতে, ঢাবির কলাভবন অসভ্যতার চূড়ান্ত। ছেলেমেয়েরা মুক্তবুদ্ধির নামে নাকি নোংরামি করে! কলাভবনের শিক্ষকরা গাঁজা খেয়ে বিজ্ঞানের জ্ঞান দেয়! এই ছেলে পাগল নাকি? সে কয়েকটি নাম লিখেছে। হুমায়ুন আজাদকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয় সে ! অথচ ড. আজাদের একটা নখের যোগ্য বর্তমান বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিরল। ধর্মের ব্যাপারে তাঁর কিছু বিতর্কিত বিষয় আছে। জগতের সবাই যেমন শাহসুফি হবেন না, তেমনি সবাই আবার আইনস্টাইনও নন। আর এটাই পৃথিবীর সৌন্দর্য। কালো না থাকলে আলোর মূল্য কী?
এই কলাভবনে ছিলেন জ্ঞানতাপস শহীদুল্লাহ, মুনীর চৌধুরী, আনোয়ার পাশার মতো সূর্যসন্তানরা। গোবিন্দদেব, আনিসুজ্জামান স্যাররা কলাভবনের বারান্দায় হেঁটেছেন। এখনো আছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ফকরুল আলম স্যাররা! অথচ ঐ ব্যাটা বলে কী? আবুল ফজলরা তখনো ব্যর্থ, এখন তো ডাবল ব্যর্থ। নজরুল, রবীন্দ্রনাথ এগুলো না লিখে ‘স্বামী স্ত্রীর মধুর মিলন’ কিংবা ‘কাসাসুল আম্বিয়া’ জাতীয় বই লিখলে ভালো করতেন। এ জাতির বুদ্ধির মুক্তি নেই। বুদ্ধি এখানে আড়ষ্ট, জ্ঞান সীমাবদ্ধ। মুক্তিতো বহুত দূর!
মনটা খুব বিষণ্ন। বাংলা ভাষাকে আরবি মাখরাজের নিয়মে লিখছেন কেউ কেউ। যেখানে আলিফের টান আছে সেখানে বাড়তি আকার যোগ করছেন চার পাঁচটা। ‘শহীদ” বানানে ি দিতে বললে ক্ষেপে যায়। ‘বাংলাবিদ’ বলে তিরস্কার করে!
ঢাবি যেদিন নীলক্ষেতের মোড়ে ‘মুক্তি ও গণতন্ত্র’ তোরণ বানালো সেদিনই বুঝেছি ঘটনা ঘটে গেছে। চেনা বামুনের পৈতা লাগে না। সংরক্ষিত ব্যবস্থা মূলত অরক্ষিত অবস্থার কারণেই উদ্ভূত। ঢাবি আর কোনোকালে দাঁড়াবে কি না জানি না।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, অনেক ছোট ছোট বাচ্চা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা বই, ধর্মীয় বই পড়ার উপদেশ দেয়। বইগুলো বিতর্কিত আমি জানি। পড়েছিও কয়েকটা। তবু তারা বলে, আমি শুনি। তাদের ধারণা আমি ভুল পথে আছি।
বাংলার ক্লাসে এখন ‘লালসালু’ পড়াতে আর ভালো লাগে না। জাতি এই মহান উপন্যাসটি পড়ার জন্য প্রস্তুত না।