আঠারো কোটি বাঙালির মধ্যে কমপক্ষে পনেরো কোটি মানুষের এখনো শেষ আশ্রয় বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ড। এর জল-স্থল-অন্তরীক্ষ, আলো-বাতাস-সূর্য আমাদের বেঁচে থাকার ঠিকানা, শেষ ভরসা। আমাদের সন্তানেরা এদেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজে পাঠগ্রহণ করে মানুষ হওয়ার দীক্ষা নেয়। এদেশের সত্তর হাজার গ্রামের মানুষ অসুস্থ হলে ছুটে যায় উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। আরো জটিল সমস্যা হলে তারা ছুটে যায় সদর হাসপাতালে। এদেশের জেলাসদরের হাসপাতালগুলোর ওয়ার্ড, বারান্দা, সিঁড়িতে পড়ে থাকে মুমূর্ষুরা, কাঁতরাতে থাকে মৃত্যুরা। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথে আমাদের যাওয়ার সুযোগ নেই। ব্যাংকক, ইন্ডিয়া, আমেরিকার বেডে শুয়ে শুয়ে বাংলাদেশের সংবাদ দেখার স্বাদ আমাদের কোনোকালেই পূরণ হবে না। আমরা সেসব দেশে যেতেও চাই না। ‘জন্মেছি মাগো তোমার কোলেতে মরি যেন এই দেশে।’ ডাক্তাররা নিঃসন্দেহে এদেশের শ্রেষ্ঠ মেধাবী। বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারে তাদের নিয়োগ হয়। কিন্তু নানা কারণে প্রমোশনে, সুযোগে, সুবিধা দানে রাষ্ট্র বরাবরই তাদের মেধার অবমূল্যায়ন করে আসছে। এই ক্যাডারকে আরো গতিশীল, চৌকস এবং আধুনিকায়নের মাধ্যমে দেশের স্বাস্থ্যখাতকে ব্যাপক উন্নত করা সম্ভব। আমরা মুখে ভারত-বিরোধিতার কথা বলি। অথচ ভারত নির্ভরশীলতা কাটিয়ে তুলতে আমাদের শুরুতেই প্রয়োজন আধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে মানুষের বিশ্বাসের জায়গাটি মজবুত করা। দেশের স্বাস্থ্যখাত বিশ্বমানের হলে ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে আমাদের প্রথম বিজয় সূচিত হবে। এই খাতটিকে কার্যকর উন্নয়ন না ঘটিয়ে একটি অকার্যকর, অথর্ব, অর্বাচীন কমিটির মাধ্যমে সংস্কারের নামে এই ক্যাডারকে বিলুপ্তির একটি হাস্যকর, অগ্রহণযোগ্য, অনভিপ্রেত এবং বাতুলের প্রলাপ বকানো হলো যা জুলাই বিপ্লবের চেতনার সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। তাদের সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। কোনো পেশাজীবীকে অবমূল্যায়ন কিংবা নির্মূলের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। এক ছাত্র সদস্য তো সাংবাদিকদের রীতিমতো কটাক্ষ করে তোপের মুখে পড়েছে। এমন গুরুত্বপূর্ণ কমিটিতে আরো প্রখর ধীশক্তিসম্পন্ন সদস্য নিযুক্ত করা প্রয়োজন।
১৬ হাজার সদস্যের বৃহৎ ক্যাডার শিক্ষা ক্যাডার। এখনো দেশের প্রতিটি উপজেলার এবং জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুরনো সরকারি কলেজগুলোয় এই ক্যাডারের শিক্ষকগণ নিরলস শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। বিসিএস পরীক্ষায় পাস করে ক্যাডারে যোগদান করতে হয়েছে। কারো নির্বাহী আদেশে একদিনে ১৬ হাজার ক্যাডার তৈরি হয়নি। এই ক্যাডারের আছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যতটুকু অর্জন তার সিংহভাগ এসেছে শিক্ষা ক্যাডারের হাত ধরে। একথা আজ ভুলে গেলে চলবে না।
দেশের বড় দুটি ক্যাডার যারা নিজেদের সুপ্রিম মনে করে তাদের ইন্ধনে, পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশে কালে কালে স্বৈরাচার তৈরি হয়েছে, ফ্যাসিবাদের হয়েছে বাম্পার ফলন। কয়েকটি নির্বাচনে প্রিজাইডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে দেখেছি কারা রাতের ভোটের কুশীলব। অথচ তারা বহাল তবিয়তে আর নিজেদের অপরাধ আড়াল করতে বলি দিতে চায় স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্যাডারকে। তারা আজ জেনে গেছে এই দুটি ক্যাডার বিলুপ্ত হলে নিজেদের মোড়লগিরি আরো বাড়াতে পারবে। নিজেদের কোনো কাজই নেই, পদও নেই। দেশের সব সেক্টর দখলের জন্য বিলুপ্তির এই নীল নকশা তারা একেছে। সংস্কার কমিটিতে শিক্ষা বা স্বাস্থ্য ক্যাডারের কোনো লোক না রেখে, কারো সাথে আলোচনা না করে সাবেক সচিব এনআই খানের উত্তরসূরিরা আজ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডার বিলুপ্তির প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করতে নেমেছে। এসব চক্রান্ত সম্পর্কে সবাই সজাগ হোন।
শিক্ষা বা স্বাস্থ্য ক্যাডার কারো দানে পাওয়া নয়। যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে এই দুই ক্যাডারে প্রায় ত্রিশ হাজার কর্মকর্তা কর্মরত রয়েছেন। কোনো কোনো ডাক্তারের পেশাদারিত্বের অভাব থাকতে পারে, শিক্ষাতেও কোনো কোনো শিক্ষকের শিক্ষক না হওয়ার গল্প থাকতে পারে এবং ব্যর্থতা আছে বলেই তো সংস্কারের বিষয়টি এসেছে। সংস্কার করুন, আধুনিকায়ন করুন, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন, পেশাদারিত্ব বাড়ান, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করুন। বিলুপ্তির কথা বলে আগুনে ঘি ঢালবেন না।
আমাদের হারানোর কিছু নেই। বছরের পর বছর এই দুটি ক্যাডারকে বনসাই করে রেখেছেন আপনারা।
‘দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা
শুধিতে হইবে ঋণ!’
মনে রাখবেন, মহাপ্লাবনের সামনে টিকে না কিছুই। সুরম্য প্রাসাদও ভেঙে পড়ে। বেতন বাড়ানোর কুপ্রস্তাব দিয়ে আমাদের লোভ দেখাবেন না। টাকার লোভ থাকলে এখানে না এসে আলু পেঁয়াজের আড়তদারি করতাম। আমাদের প্রাপ্যটুকু বুঝিয়ে দিন। সময় এখন আমাদের, সব বুঝে নেবো কড়ায় গণ্ডায়।