প্রথম পাতা » মতামত » ঐতিহাসিক ৭ মার্চ : কথার পরিমিতিবোধ

ঐতিহাসিক ৭ মার্চ : কথার পরিমিতিবোধ

7 March poster

প্রকৃতিতে বসন্ত এসেছে। ফুলে ফুলে ভরেছে মন। পলাশ, শিমুলে লেগেছে আগুন। এইসব দিনরাত্রি খুব ভালো লাগে। সামনে রমজান। এক ধরনের শুভ্রতার অনুভূতিও জেগে উঠছে। সব মিলে একটা শান্তি শান্তি ভাব। না শীত, না গরম এমন আবহাওয়ায় যখন মৃদু বাতাসের ভিড়ে কৃষ্ণচূড়ার ডালের ফাঁকে উঁকি দেয় চাঁদ তখন দেশকে ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়। আরো গভীর থেকে বলতে ইচ্ছে হয় : ‘তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও, আমি এই বাংলার প’রে রয়ে যাবো।’

১৯৭১ সালের ৬ মার্চ যে পোস্টারটি বেরিয়েছিল ৭ মার্চ উপলক্ষে সেটি উপলব্ধি করেই একটু লিখতে ইচ্ছে হলো। ৭ মার্চ নিয়ে নাতিদীর্ঘ একটি লেখা ২০২১ এ লিখেছিলাম। ২০২৩ এর ৬ মার্চ অনলাইন লিটল ম্যাগ ‘ইতল-বিতল’ সেটি প্রকাশ করেছে। সেখানে বঙ্গবন্ধুর ভাষিক নৈপুণ্য, শাব্দিক দৃঢ়তা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ইত্যাদি বিষয়ে লিখেছিলাম। আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন: ৭ মার্চের ভাষণ : বীররসের মহাকাব্য

আজ এই ভাষণে বঙ্গবন্ধুর কথার পরিমিতিবোধ সম্পর্কে একটু বলতে ইচ্ছে করছে। চারিদিকে শুধু কথা, কথা আর কথা। বেশি কথা বললে যে বিপদ বাড়ে তা মনে হয় একালের নব্য ব্যবসায়ী কাম আমলা কাম রাজনীতিবিদগণ জানেন না। এ বিষয়ে একটু বলা প্রয়োজন মনে করছি।

বলছিলাম পোস্টারটির কথা। এতো বড় গুরুত্বপূর্ণ একটি পোস্টারে মাত্র কয়েকটি শব্দ। বঙ্গবন্ধুর নামের আগে পরে তেমন কোনো বিশেষণ প্রয়োগও করতে হয়নি। সভায় নেই সভাপতি, নেই প্রধান অতিথি কিংবা ডজন খানেক বিশেষ, আমন্ত্রিত, নিমন্ত্রিত, নিবন্ধিত অতিথি। আজকের দিনে অতি সাধারণ একটি পোস্টারেও দেখা যায় অতিথির বন্যা, শ খানেক ছবি, নামীয় বিশেষণ আর কীর্তিনাশা কর্ম-ফিরিস্তি।

যদিও আজকের দিন আর সেদিনের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। একটি অস্থির সময় ছিল সেদিন। মাথার ওপরে শত্রুর হেলিকপ্টার। নিচে হাজার গোয়েন্দার তীক্ষ্ণ নজরদারি। এসবের ভিড়ে সেদিনের মহা-ভাষণটি যে রেকর্ড করা হয়েছিল সেটিই আশ্চর্য মনে হয়। প্রযুক্তির এতো উৎকর্ষ সেদিন ছিল না তবু ভাষণটির অডিয়ো, ভিডিয়ো ধারণ করাটাও ছিল এক মহা কর্মযজ্ঞ।

মাত্র ১৮ মিনিটে বঙ্গবন্ধু সেদিন সব বলেছিলেন। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত- সব বলেছিলেন তিনি। ফলে ভাষণটি হয়ে উঠেছিল বাংলার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের এক মহাকাব্য। বঙ্গবন্ধু এ ভাষণটির জন্য বৃটিশ পত্রিকা নিউজউইক কর্তৃক পেয়েছেন ‘রাজনীতির কবি’ উপাধি। রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় ও মানুষকে ভালোবাসার কারণে তিনি হয়েছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। হয়েছেন জাতির পিতা, স্বাধীন বাংলার মহান কারিগর।

৭ মার্চের মহান এ ভাষণে বঙ্গবন্ধু একটি শব্দও অকারণে উচ্চারণ করেননি। শুধু সেদিনই নয়, কোনো সময়ই তিনি ফালতু কোনো কথা বলে জাতির কাছে হাসির পাত্রে পরিণত হননি। কোনো সময় কোনো রেসিপি দেননি। লাউ-কুমড়া, বরই, তরমুজ, ডিমডাম নিয়ে কোনো কথা তিনি বলেননি। দুঃখী বাঙালির দুঃখ নিয়ে হাসি তামাশা করাটা অন্যায়। শুধু মুখে বললেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হওয়া যায় না। মুজিবকোট পড়লেই সবাইকে মুজীবীয় মনে হয় না। বাংলাদেশে বহু রাজনৈতিক নেতা আছে যাদের মুজিবকোট পরলে মনে হয় পেঙ্গুইন পাখি। বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারণ করতে হয়।

একবার এক মঞ্চে সরকার দলীয় এক সাংসদ এসেছিলেন। ৭ মার্চের বিষয়ে তিনি কথা বলছিলেন। তিনি শুধু বলেছিলেন : ‘৭ মার্চের ভাষণে কী আছে তা তোমাদের জানতে হবে।’ তিনি দশ মিনিটে একটি শব্দও বলতে পারেননি আসলে ভাষণে কী আছে! ‘কী আছে’ সেটি খোঁজার মহান দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের দিয়ে তিনি হাবিজাবি বলে নেমে গিয়েছিলেন। তিনি কর্মজীবনে ছিলেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। হঠাৎ রাজনীতিতে এসে তিনি তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন।

রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকে আলতু ফালতু কথা বলা যায় না। দেশকে আর দেশের মানুষকে ভালোবাসলে তাদের নিয়ে মজা করা যায় না। সামনে রোজা আসছে। রোজায় সংযম রাখতে হয়। আমাদের রাজনীতিবিদেরা আশা করি কথার পরিমিতিবোধ বজায় রেখে মহান রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করবেন। গরিব মানুষকে রেসিপি দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি প্রয়োজনে আবার শুনুন। জানুন, কোনো রেসিপি ছাড়াই মাত্র ১৮ মিনিটে কী করে একটি জাতির ইতিহাস পাল্টে দেওয়া যায়!

মতামত থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *