আজকাল সকল সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নির্বিচারে এই শব্দ ব্যবহার হতে দেখা যাচ্ছে।
‘এডমিনিস্ট্রেশন’ এর বাংলা ‘প্রশাসন’ এবং ‘এডমিনিস্ট্রেটর’ মানে ‘প্রশাসক’ কবে থেকে কীভাবে বাংলাদেশে ব্যবহার শুরু হয়েছে তা জানা নেই। যদিও প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গে এইসব ক্ষেত্রে ‘আধিকারিক’, ‘দপ্তর’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহারের চল দেখা যায়।
অনেকে বলতে পারেন, ইংরেজি হসপিটাল থেকে বাংলায় হাসপাতাল হওয়াতে তো কোন সমস্যা নেই-তাহলে এটিতে সমস্যা কোথায়। বিষয়টি এতো সহজ নয়।
আমাদের মনে রাখতে হবে ভাষার ভেতরে থাকে মনস্তত্ত্ব। বিদ্যায়তনিক পরিসরে “ভাষার মনস্তত্ত্ব” রাজনৈতিক ভাষা পরিকল্পনার বিরাট এক অংশ যা গবেষণার বিষয়। আমজনতাকে মানসিকভাবে অধস্তন করে রাখার কৌশল (ইংরেজিতে যাকে বলে ইন্টেমিডেট) হিসেবে শব্দ নির্বাচন করতো ঔপনিবেশিক শাসকরা। আমরাও তেমনটি করছি কী?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলায় কিছু পরিভাষা তৈরি করে গিয়েছিলেন। যেমন: রেসিডেন্স মানে আবাস। এই আবাস শব্দে ‘ইক’ প্রত্যয় যোগে সহজেই রেসিডেন্সিয়াল এর বাংলা ‘আবাসিক’ পাওয়া যায়। কত সুন্দর না?
‘এডমিনিস্ট্রেশন’ এর শেষ সিলেবল ‘শন’ এর সাথে সাদৃশ্য রেখে ‘প্রশাসন’ করা হয়েছে হয়তো। কিন্তু সে অনুযায়ী ‘এডমিনিস্ট্রেটর’ এর পরিভাষা ‘প্রশাটর’ হওয়ার কথা। হয়েছে কি?
‘প্রশাসক’ শব্দটি উচ্চারণের সাথে সাথে একধরনের ‘otherness’ বা ‘অপরতা’ তৈরি হয় জনমনে। সামজিক উঁচু-নিচু শ্রেণি বিভাজন বা হায়ারআর্কি স্পষ্ট এতে। আমরা যদি সাম্য বা সমতাভিত্তিক সমাজ আশা করি–যেখানে সকল নাগরিক সমান হিসেবে বিবেচ্য হবে–তাহলে এই ধরনের শব্দবন্ধ ব্যবহারে সচেতন হওয়া প্রয়োজন নয় কি?
যেকোন বিদেশি শব্দের বাংলা পরিভাষা তৈরির জন্য আগের দিনে ভাষাপন্ডিতদের দারস্থ হতো সবাই। এখনকার যুগে সবাই নিজ দায়িত্বে পরিভাষা তৈরি করে নিচ্ছে। বিষয়টি প্রশংসনীয় যদি না এতে রাজনৈতিক অভিলাষ থাকে।
আমরা ইউরোপীয়দের ‘সাদা’, ‘কালো’ বিভাজনের চিন্তাকে সমর্থন করি না ঠিকই–কিন্তু ‘এলিটিজম’ প্রকাশের জন্য নানা তরিকায় নিজেদের উচ্চাসনে বসানোর কায়দা ছাড়ি না। এটা দ্বিমুখী আচরণ বৈকি!
বাংলায় ‘প্রবন্ধ’ মানে হলো ‘প্রকৃষ্ট রূপে বন্ধন’; এই সংগা অনুসারে ‘প্রশাসন’ এর অর্থ দাঁড়ায় ‘প্রকৃষ্ট রূপে শাসন’। ‘শাসন’, ‘শাসক’ মধ্যযুগীয় প্রপঞ্চ, কারণ এগুলো ‘শোষক’ এর সাথে জড়িত–ফলে এগুলো পরিত্যাগ করা হয়েছে আধুনিক যুগে। অবশ্য সাম্রাজ্যবাদীদের খুব প্রিয় এই শব্দগুলো।
বর্তমানেও এই বিষয়গুলো যে নেই, তাই নয়–আছে–তবে তা সুভাষণের ভেতর দিয়ে প্রকাশ করা হয়। শব্দের পরিবর্তনে যে এর কার্যক্রমে বিঘ্ন বা বন্ধ হয়ে যাবে–সেটি নয়; তবে ‘রুচি’ ও ‘সভ্যতা’র বিষয় এখানে জড়িত।
‘সভ্য’ সমাজের বৈশিষ্ট্যই এমন–আবর্জনা-ময়লাকে ‘ডাস্টবিনে’ ঢাকনাবন্দি রাখতে হয়। পরে তা দূরে নিয়ে ফেলতে হয়। তেমনি মানবভাষায় যেসব শব্দ মানুষকে “পরাধীন” ভাবায়, “স্বাধীন” সত্তায় আঘাত করে সেসব শব্দ যথেচ্ছ ব্যবহার উচিত নয়।
পশ্চিমা সভ্যতায় ‘বাঁ/ন/র’, ‘ক/লা’ ইত্যাদি শব্দ উচ্চারণ বা অঙ্গভঙ্গি নিষিদ্ধ। কারণ, এইগুলো আফ্রিকার মানুষদের দাসত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। বর্ণবাদীরা এইসব শব্দের মাধ্যমে নিজেদের সুপিরিয়র বা উঁচু এবং কৃষ্ণাঙ্গদের নিচু জাতের হিসেবে প্রকাশ করতে চায়। তাই পশ্চিমে কঠোরভাবে বর্ণবাদী আচরণ বা শব্দকে অপরাধ হিসেবে দেখা হয়।
যাইহোক, ঔপনিবেশবাদ বাদামি চামড়ায় সাদা মুখোশ পরে শাসন করে যাচ্ছে কিনা ভেবে দেখা দরকার।
ভাষার মনস্তাত্ত্বিক রাজনীতি বোঝা তাই এতো সহজ নয়।