গ্রামের পথ ধরে ৩০ কিলোমিটার গতিতে বাইক চালিয়ে কর্মস্থলে আসা যাওয়া করি। দেশের কিংবা বিদেশের রাজনীতি নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। মাসের প্রথম সপ্তাহে ব্যাপক কেনাকাটা করি। পোলাপানরে এটা সেটা কিনে দেই। মনে হয়, জীবনটা খারাপ না। তখন ফরফুরা মেজাজে হাছনরাজার গান শুনি- বাউলা কে বানাইল রে…! তারপর ১০ তারিখ থেকে টাকা ফুরিয়ে যায়। এসময় কারবালার মর্সিয়াগীতি শুরু হয়! রাজনীতি নিয়ে ভাবব কখন? আর তাছাড়া আমার আদা আসে কুষা (ছোট নৌকা) দিয়া। জাহাজের খবর নিয়া আমি কী করিব? অবশ্য আদার যা ঝাঁঝ তাতে কুষা কেন কলাগাছের ভেলা দিয়ে এলেও উজানিনগরের চাঁদ সদাগর বনে যেতাম এতেদিনে ! আদার দাম বাড়লেও গাধার কোনো উন্নতি নাই!
বাংলা সিনেমার নিয়মিত সংগ্রামী দর্শক ছিলাম এককালে। এখনো সময় ও সুযোগ পেলে বাংলা সিনেমা মজা করে দেখি। বাংলা ভাষা যে অতি মধুর আর এ ভাষায় লেখা গানগুলো যে অতিমিষ্ট তা বাংলা গান না শুনলে বুঝা যাবে না। আমেরিকার ভিসানীতি যেদিন ঘোষিত হলো সেদিনই বাংলা সিনেমার একটা চমৎকার গান ভাইরাল হলো- ‘আর যাব না আমেরিকা/ পেলাম যখন তোমার দেখা/ তোমার বাড়ির পাশে বাড়ি ভাড়া করে থেকে যাব ঢাকা!’ আহা! মধুর স্বরেও তো ঘৃণা ছড়ানো যায়! ক্লেদ, ক্লান্তি, অবসাদ, অসহায়ত্বের এমন সারেগাম কোথায় পাব? এজন্যই কবি বলেছেন- মধুতেই যে মরে তাকে বিষ দিয়ে মারতে নেই!
আমেরিকার ভিসা স্যাংশান নিয়ে বাঙালির যে এতো দুশ্চিন্তা হতে পারে তা দেখে আমি ভিড়মি খেয়েছি। দেশের এতো মানুষ আমেরিকা নিয়ে চিন্তিত কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে আপনিও রীতিমতো চমকে উঠবেন। দেশের বিরাট একটি অংশ রাজনৈতিক আশ্রয়ে আমেরিকায় থাকে। দেশে আকাম কুকাম করে যারা প্রচুর সম্পত্তির মালিক হয়েছেন তাদের বাড়িগাড়ীনারীরা সব আমেরিকায় থাকে। কয়েকজন অতি ক্ষমতাধর অফিসার আছেন যারা আমেরিকায় বসে বাংলাদেশে অফিস করেন। সেখানে ‘বেগমপাড়া’ বলে একটা এলাকা আছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রজাতির চোরেরা সেখানে নিজেদের বেগমের নামে বাড়ি, ফ্লাট কিনেছেন। এসব লোক নিজেরা অতি দরিদ্র। ফকিরের গোষ্ঠী। কিন্তু শ্বশুরের বিশাল সম্পত্তি ছিল! কেউ কেউ ছিলেন চম্পকনগরের রাজা! রাজারা মেয়েদের ভালোবেসে আমেরিকায় ফ্লাট দান করেছেন, বাড়ি কিনে দিয়েছেন! অবসর প্রাপ্ত লোকটির ইহকালে পরকালে কিছুই নেই। আছে কেবল ডায়েবেটিকস! এখন তিনি কাশি দিলেও মুতে দেন! সারাজীবন নিজে সৎ থেকে কিছু মূত্র ছাড়া কিছুই জমাতে পারেন নি। এখন সময়ে অসময়ে এগুলোই বেরিয়ে আসে। আফসোস!!!
আমার মেজো পোলা কাগজ কেটে প্রায়ই প্লেন বানায়। একটা করে প্লেন বানানো হলে কিছুক্ষণ উড়ায়। তারপর আমাকে বলে, আব্বু প্লেনে কবে উঠাবা? আমি আশা দিয়ে রাখি- খুব শীঘ্রই আমরা প্লেনে চড়ব বাবা। আমার পোলা বুঝে গেছে ‘খুব শীঘ্রই’ মানে দুই তিন বছরের মামলা না। অ নে ক দিন…! দেশেই পরিবার পরিজন নিয়ে একবার প্লেনে উঠতে পারলাম না। বিয়ের এগারো বছর চলল। বৌ পোলাপান নিয়ে দেশটাও ঘুরে দেখলাম না। আমেরিকার ভিসা দিয়ে আমি কী করব? গতকাল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানালেন তাঁর আক্ষেপের কথা! ২১ ঘণ্টা জার্নি করে আমেরিকায় যাওয়ার দরকার নেই বললেন। সাথে সাথে এদেশের বিরাট একটি অংশ চলে গেলো আমেরিকার পক্ষে! আমেরিকার ভিসানীতির সারমর্ম যা বুঝলাম তা হলো গণতন্ত্রের প্রশ্নে কিছু জটিলতা। একদল লোক ভাবল এবার আমেরিকা এসে গেছে! আর চিন্তা নাই। একটা সুন্দর নির্বাচন হবে। তারপর পোয়াবারো! আমেরিকার কান্দে সওয়ার হওয়ার মতো ভয়াবহ পুলসিরাত এ জাতির জন্য আর কী হতে পারে?
পুরো পৃথিবীর দিকে তাকালে কী দেখবেন? ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ফিলিস্তিনে তাদের কৃতকর্মের ফিরিস্তিটা একবার পড়েন। পৃথিবীতে মুসলমান জঙ্গি তৈরিতে তাদের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। ওসামা বিন লাদেনকে কারা বানিয়েছে? কুরআন শরীফের নানা হিসাব দেখেছি টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর। স্বয়ং আল্লাহ নাকি লাদেনকে পাঠিয়েছেন! এরকম ধ্বংসের ইঙ্গিতও নাকি কোরানে ছিল! সেদিন এদেশের অনেকেই টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পক্ষে ছিল। কিন্তু আমি মনে করেছি ধ্বংস দিয়ে ভালোবাসার উদাহরণ সৃষ্টি করা যায় না। তারা ইরাককে ধ্বংস করেছে। সাদ্দামের মুক্তির দাবিতে এদেশে ব্যাপক মিছিল, সংঘর্ষ হয়েছে। আমেরিকা যেন ধ্বংস হয় সেজন্য কতজনইতো রোজা রেখেছিলেন! আজ আমেরিকাকে এতো ভালো লাগার কারণ কী?
শত্রু-মিত্র বহু প্রকার। শত্রুর বন্ধুও শত্রু। শত্রুর শত্রু আবার বন্ধু। বাংলাদেশ সরকার যখন ভারতমুখী হয় তখন ভারত আমজনতার শত্রু হয়। বাংলাদেশ এখন আমেরিকা বিমুখ হওয়ার প্রাক্কালে আমজনতার কাছে তারা রঙিলা নায়ের মাঝি হয়ে গেলো। অবশ্য নায়ের মাঝি বলে তারা স্বীকার করবে না। তারা বলবে বোররাক! আমেরিকা এখন বোররাকের ভূমিকায় আছে।
বর্তমান সরকারের কিছু দুর্বলতা আছে। যেমন বিদ্যুৎ পরিস্থিতি। আছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। গতকাল একজন খবর দিলেন- শীঘ্রই বন্ধ হবে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। তাঁর কাছে আমরা বন্ধের খবর চাইনি। এটি বন্ধ করার জন্য তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। তিনি বরং বলতে পারতেন- পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধের দায় নিয়ে আমি পদত্যাগ করলাম। বাণিজ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত ছিল আরো আগেই। আমাদের রাজনীতিতে এই প্রাক্টিসটি নেই বলে এমনটি ভাবাও অন্যায়। আশা করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়গুলো দেখবেন। বাংলাদেশে চাপপ্রয়োগকারী কোনো সংগঠন নানা কারণে সফলতা আনতে পারেনি। ফলে রাজনীতিতে কারো কারো দ্বারা এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা তৈরি হয়েছে। আখেরে এর ফল খারাপের দিকেই যাবে। এরপর যখন বেড়ায় খেত খাওয়া শুরু করবে তখন আফসোসের অন্ত থাকবে না। বৈদেশি বন্ধুরা প্রথমে বেড়া হয়ে আসবে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকা সরাসরি বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছে। কূটনীতি, রাজনীতি, সমরনীতি সব দিক থেকেই তারা বাংলাদেশকে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল। একটি দেশের মুক্তির পক্ষে, স্বাধীনতার পক্ষে তারা সেসময় সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেছিল। জাতিসংঘকে পর্যন্ত দীর্ঘসময় তারা কৌশলে নিবৃত্ত করেছিল যেন বাংলাদেশ প্রশ্নে সংগঠনটি নিষ্ক্রিয় থাকে। পাকিস্তানকে সহায়তা করার জন্য তারা বঙ্গোপসাগরের অভিমুখে প্রেরণ করেছিল সপ্তম নৌবহর! রাশিয়ার প্রচণ্ড প্রতাপে সেদিন সপ্তম নৌবহর পিছু হটেছিল। ভারতের কার্যকর অনড় অবস্থান, বিশ্বরাজনীতিতে রাশিয়ার দুর্দান্ত প্রভাব, বঙ্গবন্ধুর বিশ্বপরিচিতি, মুক্তিযোদ্ধাদের অকুতোভয় সম্মুখসংগ্রামে হেনরি কিসিঞ্জারদের সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা করে নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ যখন নানা সূচকে এগিয়ে চলছে বিশ্বচ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি ‘বিরাট ভুল’ করলেন! তিনি যেদিন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টকে পদ্মাসেতুর ছবি উপহার দিলেন সেদিনই আমার সন্দেহ হয়েছিল! তারা অনেক কিছু পছন্দ করে। উন্নয়নশীল দেশের স্পর্ধা বরদাশত করে না! স্বাধীন বাংলার স্বনির্ভরতার একটি ‘স্বেচ্ছাচারী স্পর্ধা’র নাম পদ্মাসেতু নির্মাণ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার অন্যতম একটি কারণ ছিল বিশ্বমোড়লদের সামনে যখনতখন পা তুলে বসে তাঁর সিগারেট ধরানোর স্পর্ধা। তিনি যদি আঙুল উঁচিয়ে কথা না বলতেন তবে হয়তো দুনিয়ার আলোবাতাস আরো কিছুদিন ভোগ করতেন! তারা সব সহ্য করে কিন্তু ‘সন্ত্রাসের রাজনীতি’ সহ্য করে না! বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল!
আমেরিকা মূলত সস্তায় মলমবিক্রেতা। তাদের মলম তেমন চলে না বলে একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে কিলঘুষির একটি ব্যবস্থা করে দেয়। লাঠালাঠির এক পর্যায়ে তারা দুদলের কাছেই মলম বিক্রি করে। কথায় বলে, আমেরিকা যার বন্ধু তার শত্রুর প্রয়োজন হয় না।
আমেরিকার পক্ষটা বড় বিষয় নয়। বিষয় হলো এদেশে এখনো বিরাট একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কাজ করে। শেখ হাসিনার শত্রুই হলো সুবিধাভোগী বাঙালির বন্ধু। ভারতের ‘মালু’ যদি আজই শেখ হাসিনার শত্রু হয় কাল সে হবে বাঙালির জানপছানের ‘খালু’!
পুরো পৃথিবীজুড়ে শান্তিকামী মানুষদের ভূখণ্ডকে যারা বানিয়েছে ‘ঘাতকের অশুভ আস্তানা’ তারাই বাঙালির কাছে হঠাৎ হয়ে উঠল অতি আপনজন!