বাংলাদেশে তাঁর সমকালে জনপ্রিয় লেখক ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। এদেশের বইমেলায় বহুদিন পর্যন্ত হুমায়ূন আহমেদ বেস্টসেলার তালিকার শীর্ষে অবস্থান করেছেন। একসময় এদেশে কলকাতার সমরেশ, শীর্ষেন্দু, সুনীলের বই বিক্রি হতো একচেটিয়া। হুমায়ূন বাংলার বইমেলা দখল করেছিলেন একাই অনেকদিন। এককভাবে বেশ কয়েকটি প্রকাশনাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তিনি । বাংলা সাহিত্যে তাঁর মতো লেখকভাগ্য নিয়ে কোনো সাহিত্যিক জন্মাননি।
লিখে যে এতো টাকা আয় করা যায় তা মনে হয় আগে বাংলার কোনো লেখক জানতেন না! জীবনানন্দ দাশ প্রকাশকদের সাথে দেনদরবার করতেন টাকার বিষয়ে। বিশেষ কোনো লাভ হতো না। লিখে সম্ভবত তাঁর জীবনের চাকা সচল হয়নি। কলকাতার ট্রামগাড়ি সে ইতিহাস জানে। মানিক লিখতেন টাকার জন্য। সংসার চলতো লেখার পারিশ্রমিকে। কিন্তু তাঁর বাড়িতে কি কখনো কোনো প্রকাশক একটা পাণ্ডুলিপির জন্য দশ লাখ টাকা বাজারের ব্যাগে করে নিয়ে গেছে? মানিক-গবেষকরা সেটা বলতে পারবেন। আমি জানি না। বাংলা সাহিত্যে ‘রাজ’ করে গেছেন হুমায়ূন। এটা হতে পারে বাঙালি খুব বোকা ছিল অথবা হতে পারে হুমায়ূন অনেক চতুর ছিলেন। হয়তোবা তিনি নিজেও ঠকেননি বরং আমাদের ঠকিয়ে গেছেন!
বাঙালির বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নাই। এরা যে কিছু না পেয়েই ফিবৎসর বইমেলায় হুমায়ূনের বইয়ের জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা করেছে এমনটা মনে করার কারণ নেই। এখন হয়তো তারা হুমায়ূনের সাহিত্যে কিছু খুঁজে পায়না কিন্তু তখন না পেলে কিনেছে কেন? বাঙালি বিনা কারণে পয়সা খরচা করার লোক না। তাহলে যে বলা হয়, হুমায়ূন জাদুকর ছিলেন! এটা কি তবে সত্য! এতো লোককে বশীকরণের মন্ত্র ছিল তাঁর!
হুমায়ূন বিজ্ঞানের ছাত্র এবং মাস্টার ছিলেন। জনগণের পালস বুঝেছিলেন কি? কিন্তু জনগণের পালস রাজনীতিবিদরা ছাড়া এদেশে কবে কে বুঝেছে? আর এতো লোকের পালস একা তিনি কীভাবে বুঝলেন? তিনি অবশ্য এর উত্তরে বলেছিলেন : ‘আমি পাঠকের পালস বুঝিনি, পাঠকই আমার পালস বুঝেছে।’ এটাই বরং যৌক্তিক মনে হয় আমার কাছে।
একজন সাহিত্যিক মরে গেলে তাঁর সৃষ্টি বাঁচল কী মরল এটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। রবীন্দ্রনাথের মতো : ‘আমি যতদিন আছি, তুমিও থাকিও প্রিয়।’ হুমায়ূনও এটা বিশ্বাস করতেন। চিরায়ত কিংবা কালোত্তীর্ণ শিল্পলোক বলে কিছুতে তাঁর বিশ্বাস ছিল না। তিনি বর্তমানকে দেখেছিলেন এবং সেখানে তিনি ছিলেন সত্যিকারের বাদশাহ নামদার!
হুমায়ূন কারো কারো দুপুরকে করে তুলেছিলেন আনন্দময়, বিকেলকে করে তুলেছিলেন স্নিগ্ধ। মধ্যবিত্ত জীবনের একটা গড়ন তিনি হৃদয় দিয়ে আঁকতে পেরেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের আলাদা একটা চিত্র তিনি একেছিলেন। আর কতগুলো মানুষকে তিনি সাহিত্যে এনেছিলেন যারা আছে আমাদের চারপাশজুড়ে। মুনা, বাকের, মিসির, শুভ্র, আনিস, নবনী, মীরা, বাদল, হিমু এদের সাথে যাদের আত্মীয়তা হয়েছে তারা এদের স্রষ্টাকে ভুলে থাকবে কেমনে?
হুমায়ূনের সাহিত্যের গভীরতা নিয়ে এখনো কত কথা শুনি! বাংলা সাহিত্যের গভীর সাহিত্যগুলো প্রতিদিন কতজন পড়ে? গভীরতাসঞ্চারী সাহিত্যিক আমাদের রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, মানিক, তারাশঙ্কর, শরৎচন্দ্রকে আমরা কতটা পাঠ করি কিংবা কতটা আমাদের জীবনে তাঁরা প্রভাব খাটাতে পেরেছেন? জীবনানন্দের শুদ্ধ কবিতাসমগ্র আমাদের কতটা করেছে বিশুদ্ধ, রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনাই বা আমরা কতটা নিতে পেরেছি? আমাদের জীবনে কতটা আলোকের ঝরনাধারা তাঁরা আনতে পেরেছেন? আমার কাছে সেটা নেহায়েতই অপ্রতুল মনে হয়। বাঙালি অন্যেরটা দেখে শিখবে, অনুপ্রাণিত হবে এতটা ভাড়েও ভবানী তারা নন! বিশেষ করে, সাহিত্য বাঙালির মনকে গড়ে দিতে পারলে হুমায়ূনের অগ্রজরা ব্যর্থ হতেন না। মি. আজাদ কোপ খেতেন না। জীবনানন্দ আত্মহত্যা করতেন না।
লেখাটার শিরোনাম দিয়েছিলাম ‘বাংলাদেশে হুমায়ূনের ভবিষ্যত’! এটা আমি নির্ধারণ করার কেউ না। এদেশে এখনো বঙ্গবন্ধুর মতো একজন মহান ও বিশ্বনেতাকে ‘গেলানো’ লাগে! রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-শরৎরা নীলক্ষেতের মোড়ে মোড়ে উল্টে আছে! দাদা-ব্রাদার কেউ এখানে ভাত পায়না বলা যায়!
আমাদের বই গেছে ফুটপাতে, জুতো গেছে এসিতে!
এখানে আবার লেখকের ভবিষ্যত কী? এখানে কোনো প্রাণিরই ভবিষ্যত নাই। সব বর্তমান। হুমায়ূন বর্তমানকে জয় করা একজন রাজা-বাদশা পর্যায়ের লেখক। এখন যদি আপনাদের মনে হয় হুমায়ূনের লেখায় গভীরতা নাই তাহলে নিজেদের পশ্চাদদেশ চাপড়ানো ছাড়া বাঙালির উপায় নাই! হুমায়ূন আহমেদ সবাইরে বশীকরণ তাবিজ লাগায়া চউক্ষে ‘নিশা’ ধরায় দিছিলো!!! এখন আফসোস করেন মিয়ারা!