প্রথম পাতা » মতামত » যদ্যপি আমার গুরু

যদ্যপি আমার গুরু

MOHAMMAD AZAM

২০০৫ সাল। ঢাবির বাংলা বিভাগে ভর্তি সংক্রান্ত কাজে লাইনে দাঁড়িয়েছি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছেলেমেয়েরা এসেছে। ছেলেদের লাইনে সবার মুখে খই ফুটছে। বেলা তখন তিনটা প্রায়। কিছুই চিনি না। দুপুরে খেতেও পারিনি। আমরা হৈ হৈ বলে স্লোগান দিচ্ছি। কাগজ নিতে দেরি কেন, প্রশাসন জবাব চাই- এমন মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। আমাদের চিৎকার শুনে একজন বেরিয়ে এলেন। গায়ে হাওয়াই শার্ট, গেবার্টি প্যান্ট, পায়ে কিটো স্যান্ডেল। গম্ভীর গলায় বললেন : তোমরা জানো, আমিও দুপুরে খাইনি? তোমাদের সকলের কাগজ নিয়েই আমি খেতে যাব। একটু ধৈর্য ধরো।

এই লোক আমাদের তুমি করে বলছে কেন? পোশাকে তো মনে হয় পিওন টিওন হবে! একজন বললো স্যার মনে হয়। আরেকজন মন্তব্য করলো : আরে না! এই লোক স্যার হয় কেমনে? ঢাবির শিক্ষক অন্য জিনিস! অফিসের কেরানি হইতে পারে! আমারও সন্দেহ হলো। ঢাবির একজন শিক্ষক কিটো স্যান্ডেল পরে থাকবে?

ক্লাস শুরু হলো। অনেকদিন তাঁকে করিডোর দিয়ে হেঁটে যেতে দেখতাম। একদিন দেখলাম বগলে বইখাতা নিয়ে আমাদের ক্লাসে ঢুকছেন কিটোপরা সেই লোকটি! তারপর ইতিহাস। তাঁর পড়ানোর স্টাইল, বচনামৃত সবই আকর্ষণীয় কিন্তু তাঁর প্রায় অনেক কথাই আমরা বুঝি না! তাঁর ক্লাস করতে আমাদের বাড়তি পড়াশোনার প্রয়োজন হলো। তাঁকে বুঝতে প্রয়োজন হলো অবারিত জ্ঞানচর্চার।

এই মানুষটি এতোটাই বাংলাপ্রেমী যে বুয়েটে চান্স পেয়েও ঢাবির বাংলাতে ভর্তি হয়েছিলেন। বৈষয়িক ত্যাগ ছোট করে দেখার বিষয় নয়। বিশেষত অর্থসংক্রান্ত নিশ্চয়তা তো আরো ভাবনার বিষয়। তিনি হয়তো দুবার ভাবেননি। চলে এসেছিলেন বাংলা বিভাগে। স্যারের দুর্দান্ত রেজাল্ট হলেও বিভাগ তাঁকে নিয়োগদানে গড়িমসি করেছে। যতদূর শুনেছি তাঁর নাম গোলাম আজমের নামের সাথে হুবহু মিলে যাওয়ায় এ জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল। পরে অবশ্য স্যার তাঁর স্বনামে মহিমান্বিত হয়ে উঠেন। তিনি হয়ে উঠেন মোহাম্মদ আজম- বাংলার ডিরোজিও। তাঁর পিছে পিছে আমরা ঘুরে বেড়াতাম।

স্যার একসময় ঢাকা কমার্স কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। সেখানে আমারও চাকরি হয়েছিল। কিন্তু পরে ভিন্ন কারণে জয়েন করিনি। এ সংক্রান্ত একটি কাজে আমি স্যারের শরণাপন্ন হয়েছিলাম। স্যার মন দিয়ে আমার কথা শুনেছেন। এরপর অনেকদিন ডিপার্টমেন্টে গিয়েছি। তাঁর রূপের পরিবর্তন হয়েছে। কখনো বড় চুলের বাউল মনে হয়, কখনো উঁকুনের যন্ত্রণায় (?) কেটে ফেলেন। এটি তাঁর স্ত্রী, আমাদের বড়আপা জিনাত জাহান সেঁজুতি ভালো বলতে পারবেন! আমি তখন এম.ফিল. করছি। একদিন মলচত্বরে দেখা। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে জানতে চাইলেন : কী খবর? গবেষণা কতদূর? তারপর অনেকক্ষণ কথা হলো। পরামর্শ দিলেন। একটা লিংকও দিলেন যেখান থেকে স্যারের লেখা পাওয়া যাবে। আমি বিদায় নিলাম।

বাংলা ভাষার সবচেয়ে যোগ্য এবং নিবেদিত মানুষ প্রফেসর আজম স্যার। তিনি লেজুড়বৃত্তি পছন্দ করেন না। কোনো দলের হয়েও কখনো বাতচিত করেন নি। তিনি ডুবে থাকেন অনন্ত গবেষণার জগতে। তাঁর জ্ঞানের গভীরতা ব্যাপক। বাংলা ভাষার উপনিবেশায়ন নিয়ে গবেষণা করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বর্তমানে সবচেয়ে সক্রিয় আলাপ তাঁর কাছে পাওয়া যায়। শিক্ষার দুর্দিনে তিনি সদাজাগ্রত এক আলাপী বিবেক।

বাংলা একাডেমি বাংলা ভাষার জন্য এক অনন্য প্রতিষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দলীয় নিয়োগে বঙ্গীয় নট-নটিদের আশ্রয় হয়ে উঠেছিল এই প্রতিষ্ঠানটি। আমার মনে হয় একজন যোগ্য লোককে এবার একাডেমিতে পাঠানো হলো। বাংলা একাডেমির আনন্দ হওয়া উচিত যে, একজন যোগ্য লোক তারা পেয়েছে। বাংলা একাডেমিকে অভিনন্দন।

স্যারের প্রতি আমার বিশ্বাস আছে। প্রতিষ্ঠানটি কেবল বইমেলার আয়োজন করবে না, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে উঠবে এই প্রত্যাশায় অপেক্ষা করে থাকবো। আমার গুরু ড. আজমের জন্য নিরন্তর শুভকামনা।

মতামত থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *