প্রথম পাতা » মতামত » প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ

প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ

Rabindranath Tagore

ফেসবুকে ইদানিং আসি কম। এতে একটা উপকার হয়েছে আমার। শরীর স্বাস্থ্য বেশ ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। মানসিক যন্ত্রণার কল হলো ফেসবুক। কোনো আশার উপাদান এখানে নেই। কেবলই হতাশা আর হা-হুতাশ! অসামাজিক মানুষ, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, স্বাধীনতাবিরোধীদের এখন পোয়াবারো। এতোদিন মনের কথা বলতে পারেনি। এখন প্রকাশ্যে বলা যায়। সময় এখন বর্ষাকাল, হরিণ খামছায় বাঘের গাল।

রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ড সৃষ্টির ৫৮ বছর আগেই বিশ্বস্বীকৃতি পেয়েছেন। তিনি নোবেল পাওয়ায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিশ্বের দরবারে গৌরবান্বিত হয়েছে। এশিয়দের মধ্যে প্রথম নোবেল লরেট এই মানুষটি পৃথিবী নামক মানচিত্রের তিনটি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের স্রষ্টা। এমন না যে, তিনি কাউকে অনুরোধ করেছেন বা লবিস্ট নিয়োগ করে ভারত, বাংলাদেশ কিংবা শ্রীলঙ্কাকে বলেছেন তাঁর গান এইসব দেশের জাতীয় সঙ্গীত করা হোক। তিনটি দেশই তাঁর মৃত্যুর পর স্বাধীন হয়েছে। তাঁর গান কে শুনবে, কে শুনবে না সেটা নিয়ে তিনি কাতর ছিলেন না। তবে ছিলেন প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী। সাহিত্যের অমরত্ব নিয়ে তাঁর হা-পিত্যেষ ছিল না। তিনি বলেছেন : ‘আমি যতদিন আছি, তুমিও থাকিও প্রিয়।’ এখন কেউ চাইলে তাঁর গল্প কবিতা পড়বে, গান গাইবে, না চাইলে নাই। বাংলাদেশ যদি রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধও করে তাতে তাঁর একটা লোমও ছেঁড়া যাবে না। সম্মানী ব্যক্তিকে সম্মান দিলে নিজের সম্মান বাড়ে। রবীন্দ্রনাথকে সম্মান দিয়ে বাংলাদেশ সম্মানিত হয়েছে, তাঁর গান জাতীয় সঙ্গীত করায় বাংলাদেশের মাথা উঁচু হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের পরিবারের কেউ সে কারণে সংসদে আসন নিতে আসেন না। টিসিবির পণ্যের ভাগও চান না। দলীয় পদপদবিও চান না কেউ।

রবীন্দ্রনাথ এইদেশে বারবার নিষিদ্ধ হয়েছেন। তবে মজার ব্যাপার হলো, তিনি যতবার নিষিদ্ধ হয়েছেন ততবারই জ্বলে উঠেছেন। ড. আজাদ বলেছেন : ‘তাঁর একটি গান নিষিদ্ধ হলে তিনি জাতীয় সঙ্গীত হয়ে উঠেন!’ ষাটের দশকে তাঁকে নিষিদ্ধ করা হলে সত্তরের দশকে তিনি সারা বাংলায় বেজে উঠলেন! তাঁকে থামানো এতো সহজ না।

রবীন্দ্রনাথ ভিনদেশের কবি নন, অন্য ভাষারও নন। তিনি বাঙালি, তিনি বাংলা ভাষার। তাঁর জন্ম-মৃত্যু অখণ্ড ভারতবর্ষে। তিনি সকলের, তিনি সর্বজনীন। রবীন্দ্রনাথকে যারা ভিন্ন ভাষার কবি মনে করেন তাদের আমি কবি আবদুল হাকিমের মতো গালি দিতে চাই না। আবদুল হাকিম বাংলা ভাষা অবজ্ঞাকারীদের জন্ম নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন। আমি তা-ও করছি না।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে তিনি এই গানটি লিখেছেন। বাংলাকে ভাগ করার গভীর প্রতিক্রিয়ায় তিনি আরো কয়েকটি গান রচনা করেন। ১৯১১ সালে ভঙ্গবঙ্গ আবার অখণ্ডতা পায়। ব্রিটিশরা বুঝতে পারে বাংলাকে ভাগ করে তেমন কোনো ফল হয়নি। রবীন্দ্রনাথ জানতেন এর ফল ভালো হবে না। কবিরা শুধু কবিতাই লেখেন না, দেশের ভবিষ্যতও লেখেন। বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়ায় এ গানটি রচনা করলেও এর সুর তিনি নিয়েছেন বাউল সাধক গগন হরকরার একটি গান থেকে। এটি অনুকরণ। সাহিত্যিক অনুকৃতি আর চুরির পার্থক্য আগে বুঝতে হবে। বস্তুত, সাহিত্য চুরির বিষয়ও নয়। আর যদি সেই ঋণ স্বীকার করা হয় তবে তা সাত খুন মাফ। রবীন্দ্রনাথ গগনের ঋণকে স্বীকার করেছিলেন। পুরো পৃথিবী রবীন্দ্রনাথের হাতে ধরা কেবল তিনি ধরা খেয়েছেন একজন বাউলের কাছে! এই ধরায় আত্মমর্যাদা বেড়েছে, কমেনি। বাউয়ালিয়ানা বাঙালির আবহমানকালের জনজীবনের সাথে গভীর সম্পর্কে অবিচ্ছেদ্য। রবীন্দ্রনাথ বাংলার শ্রেষ্ঠ বাউল।

এই গানে নাকি শিরক আছে! শিরকের সংজ্ঞা আমাকে আবার জানতে হবে! ঠুনকো ইমানদারের ইমান কথায় কথায় চলে যায়। সবলচিত্তের ইমান এতো সহজে যায় না। একটি গানে জান্নাত জাহান্নাম নির্ধারিত হয় না। ধর্ম ব্যবসায়ীদের ইমান অবশ্য অন্য জিনিস। এটি সবসময় যায় যায় অবস্থায় থাকে!

এই গান শুনলে নাকি ঘুম আসে! ঘুম তো ভালো জিনিস। ঘুম আসলে ক্ষতি কী? পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষ নিদ্রাহীনতায় ভোগে! এ তো তাহলে ঘুমের মহৌষধ! মাগনা পাইলে বাঙালি আলকাতরা মাখে আর একটি সঙ্গীত যদি আপনাকে ঘুম এনে দেয় তো মন্দ কী? এই গানে যুদ্ধের দামামা নেই তাই অনেকের আফসোস! এখন আর যুদ্ধ কেন? এখন সবাই ঘুমালেই তো বরং ভালো। অনেকের কথা শুনে মনে হয় এই জাতি এখন থেকে শুধু লেফট রাইট করবে? বাঙালি প্রয়োজনে বিদ্রোহ করে তবে চিরকাল তার শান্ত রূপটিই সর্বজনবিদিত। ইতিহাস খুলে দেখেন। এই ঘুমপাড়ানি গান শুনে শুনেওতো কয়েকবার নতুন যাত্রা শুরু হলো। কিন্তু, যাত্রা শুরুর আগেই শেষ হয় কেন জানেন? অসূয়াবিষ! বাঙালির যখন কিছুই আর করার থাকে না তখন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মরে!

জাতীয় সঙ্গীত জনগণের বিষয়। এটি রাজনৈতিক বিষয় নয়। জনগণ চাইলে জাতীয় সঙ্গীত চেঞ্জ হবে। না চাইলে হবে না। তবে এতদবিষয়ে বাংলাদেশের জনগণ কারা হবে, কারা এই ব্যাপারে ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে সেটা একটা বার্নিং কোশ্চেন। যারা একাত্তরের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নয় তারা জাতীয় সঙ্গীতের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করলে স্বাধীনতার স্বপক্ষশক্তি রুখে দাঁড়াবে, এটি একটি সরল অঙ্ক।।

যাদের অনিদ্রা আছে তারা গানটি শুনে শুয়ে পড়েন। এদেশের জাতীয় সঙ্গীত এতো সহজে পরিবর্তন হবে না। অনেকেই এতদবিষয়ে জীবন হাতে নিয়ে বসে আছেন!

মতামত থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *