প্রথম পাতা » মতামত » জাগ্রত হোক বইকেন্দ্রিক সামাজিকতা

জাগ্রত হোক বইকেন্দ্রিক সামাজিকতা

Book

আমাদের সাহিত্য—সংস্কৃতি চর্চার সর্বোত্তম জায়গা পরিবার। সেখান থেকেই তৈরি হওয়ার কথা বইপড়ুয়া প্রজন্ম। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয় সময়ের সঙ্গে আমরা যেন সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। আর এই সুযোগে অপসংস্কৃতির ভর আমাদের মননে ভাঙ্গন শুরু করেছে। ফলশ্রম্নতিতে সমাজে ফুলে—ফেঁপে উঠছে অস্থিরতা। শূন্যতা, হাহাকার ধ্বংস করতে বসেছে আমাদের সৃজনী—ক্ষমতা আর মানবিক মূল্যবোধকে।

আমাদের শরীরের যেমন ব্যয়াম লাগে তেমনি মন কিংবা ব্রেনেরও ব্যায়াম লাগে। আর মন ও ব্রেনের সঠিক ব্যায়াম হলো বই পড়া। মগজকে কাজে লাগানো আর মনের পেশীগুলোকে শক্তিশালী করার শ্রেষ্ঠ উপায় বই পড়া। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা—গবেষক ও অধ্যাপক এনি ই কামিংস তার ‘হোয়াট রিডিং ডাস ফর দ্য মাইন্ড’ নামক গবেষণাপত্রে প্রমাণ করেছেন, বই পড়া স্বাভাবিকভাবেই মানুষকে আধুনিক মানসকামী করে তাঁর বয়স কমিয়ে দেয়। বই পড়ার অনেক উপকার। বই পড়লে শব্দ ভান্ডার বাড়বে, স্মরণ শক্তি বাড়বে, ভাবনা আর কল্পনার জগৎ বড় হবে, সৃষ্টিশীলতার বিকাশ ঘটবে।

বই মানুষের মধ্যে দয়া, বিনয় ও সৃজনশীলতার বিকাশে সাহায্য করে। এসব কারণে বই পড়া খুব জরুরি। সন্তানদের হাতে বই তুলে দেওয়া আরো বেশি জরুরি। কিন্তু আমরা বাবা মায়েরা সন্তানদেরকে সহজে বই কিনে দিতে চাই না। মনে করি এই টাকাটাই বুঝি গচ্চা গেল। অথচ এই বাবা ময়েরাই পরিশীলিত ও মানবীয় সুসন্তান প্রত্যাশা করি। কিন্তু আমরা আগে ভাবিনা যে— সন্তানের মানবীয় বিকাশে বইয়ের গুরুত্ব ও অবদান সবচেয়ে বেশি। আমরা এই বাবা মায়েরাই নির্ধিদ্বায় চায়নিজ রেস্টুরেন্টে বা অভিজাত হোটেলে বসে এক—দুই হাজার টাকা অবলীলায় খরচ করতে কাপর্ণ্য করিনা। অথচ বইমেলায় এসে বই কেনার জন্য দুই হাজার টাকার বাজেট থাকে না। এইভাবে মানুষ দিনকে দিন বই পড়া থেকে দুরে সরিয়ে দিচ্ছে শিশুদেরকে। অথচ বই হচ্ছে মানুষের বিনোদনের অন্যতম বড় উৎস।

আমাদের বইমেলা ঘুরে এমনও দেখা গেছে যে, শিশু কিশোরেরা তাদের ইচ্ছেমতো বা পছন্দমতো বই কিনতে পারছে না। এর পিছনে কারণ দুটি— ১) বাবা মার অনিহা, ২) বাজেট কম। এমনও দেখা যায় শিশু—কিশোরদের ইচ্ছা ও আগ্রহকে তুচ্ছ করে, তাদেরকে ভুলিয়ে—ভালিয়ে মেলা থেকে ফিরিয়ে নেয়া হয়। তারাই আবার বাইরে গিয়ে ফুচকা, আইসক্রীম, বার্গার বা পিৎজা খাইয়ে বই না কিনতে পারার দুঃখটি ভুলিয়ে দেয়া হয়। এটিকে সৃজনশীলতা বিকাশের বিপক্ষে প্রতারণা বললে কি ভুল হবে?

আমরা অনেকভাবেই নিজেদের পরিবারের মাঝে বই পড়া, সংগ্রহ করা এবং বই উপহার দেয়ার রীতি চালু করতে পারি। কিভাবে হবে সেটাই বলছি। সামাজিক কোনো প্রতিক্রিয়ার দিকে না তাকিয়ে আমরা ঘর থেকেই শুরু করবো বই পড়া আন্দোলনটি। প্রথমে পরিবারের সদস্যদের বিয়ে, জন্মদিন, বিশেষ সাফল্য অর্জন, বিদেশযাত্রা, বিশেষ দিবসে অন্য গিফটের পরিবর্তে বই কিনে দিতে পারি। সামাজিক কারণে আমরা বিয়ে বা জন্মদিনে দাওয়াতে বিশেষ কিছু উপহার দিয়ে থাকি। আমরা যদি এসবক্ষেত্রে বই উপহারকে বেছে নিই তাহলে অনেক ধরণের অনেকগুলো বই উপহার দেয়া যায়।

ছোটবেলায় আমরা বই চুরি করে নিয়ে পড়তাম। বই বদল করে পড়তাম। বই উপহার পেতাম এবং দিতাম। এখন কেন জানি এই অভ্যাসে ভাটা পড়েছে। এটি খুবই ভয়ানক ব্যাপার। বিয়ে, জন্মদিন, সাংস্কৃতিক উৎসবে এখন আর বই উপহার দিতে দেখা যায় না। আজকালকার বিয়ের অনুষ্ঠানে এক হাজার টাকার নিচে কিছু উপহার দেয়া যায় না। অথচ এক হাজার টাকায় ৫/৭টি বই উপহার দেয়া সম্ভব। ধরা যাক একটি বিয়েতে আপ্যায়িত হয়ে থাকেন ২০০ থেকে ৩০০ জন। এদের মধ্যে ৫০ জন যদি এক হাজার টাকার বই দেন তাহলে ৫০ হাজার টাকার বই উপহারে সেই পরিবারটিতে একটি পাঠাগার তৈরি হতে পারত। আমাদের সমাজে অদ্ভুত আরেকটি রীতি দুঃখজনকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে— এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এমনকি শিল্প বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক বনভোজনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতায় পুরষ্কার হিসেবে এখন বই উপহারের বদলে গৃহসামগ্রী দেয়া হয়। অথচ এসব আয়োজনে বইকে প্রাধান্য দিলে এই সিজনে কোটি কোটি টাকার বই বিক্রি হতে পারত।

আমাদের সমাজের একটি পরিবারের বইমেলায় বই কেনার জন্য ২ হাজার টাকাও বাজেট থাকেনা। দেখা গেছে শিশুরা বই কিনতে চাইলেও মা—বাবার অনাগ্রহের কারণে তাদের বইয়ের চাহিদা মিটছেনা। অথচ এই বাবা মায়েরাই একদিন একবেলা পেটপুড়ে চায়নিজ খেয়ে ২/৩ হাজার অবলীলায় শেষ করেও যে আনন্দ প্রকাশ করেন সন্তানকে সেই পরিমাণ টাকার বই কিনে দিয়েও গর্বিত হতে দেখা যায়না। দুঃখের বিষয় হলো— এমন বাবা মায়েরাই আবার মননশীল সুসন্তান হিসেবে নিজের সন্তানকে দেখতে চান! আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গী বদলাতে হবে।

বইমেলায় বছরে একবার পরিবার প্রতি যদি ২ হাজার টাকার বই কেনার বাজেট থাকে তাতেও অনেক বই বিক্রি হওয়ার কথা। ভেবে দেখুন, আমাদের পিএসসি, জেএসসি পরীক্ষার্থীও সংখ্যা কত কোটি। আমাদের সরকারি বেসরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সৃজনশীল বই কিনে পাঠাগার স্থাপন করা বাধ্যতামূলক হলে শত কোটি টাকার বই বিক্রি হওয়ার কথা। বই শিল্প বিকাশে সরকারের বড় ধরণের পৃষ্ঠপোষকতা অতি আবশ্যক। সৃজনশীল প্রকাশনার প্রথম ক্রেতা হতে হবে সরকারকে। সরকার ক্রেতা হয়ে বই পঠনকে জনপ্রিয় করে তুললে প্রজন্মের মাঝে সৃষ্টিশীল নেতৃত্ব তৈরি হবে। সামাজিক অসঙ্গতি ও সংঘাত কমবে। এ কাজে সরকারেরই লাভ বেশি। সরকার তার পাঁচ বছর ক্ষমতার মেয়াদে ২০ কোটি করে ১০০ কোটি টাকার বই কিনলে পাল্টে যাবে প্রকাশনা শিল্পের অবয়ব। লেখক, পাঠক তৈরি হবে। এগিয়ে যাবে দেশ এবং জাতি। তবে সরকারের ক্রয়নীতিতে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করতে হবে। তা না হলে প্রকাশনার মান ধরে রাখা সম্ভব হবে না। সরকার পৃষ্ঠপোষক হলে দ্রুততম সময়ে বিকশিত হবে এই সম্ভাবনাময় শিল্পটি। প্রতিষ্ঠিত হবেন লেখক এবং বাড়বে বইয়ের বাজার। আমরা একটি সৃজন ও মননশীল প্রজন্ম গড়তে পারবো।

সমাজে এই প্রচলন ছড়িয়ে দিলে সারাদেশব্যাপী বই পড়া আন্দোলন জোড়দার হবে এতে সন্দেহ নেই। ঘড়ে ঘরে প্রতিষ্ঠিত হবে পারিবারিক পাঠাগার। আর এর মাধ্যমে মেধায়, মননে ও সৃজনশীলতায় আমাদের প্রজন্ম গড়ে উঠবে পরিশীলিত ও মানবীয় গুণে। আমরা যত বই পড়বো, মনের চক্ষু ততই খুলবে। আজকের দিনের অস্থির সমাজের অহমিকার ব্যারিকেড ভেঙ্গে দিতে পারে বইপড়া আন্দোলন। আপনার সন্তানকে মোবাইল, ইন্টারনেট আর ফেসবুকের নেশা কাটিয়ে দিতে পারে বইয়ের নেশা। কিন্তু সে নেশাটি ধরাতে হবে অভিভাবকদের প্রাণান্তকর চেষ্টায়। সন্তানদেরকে মাদক আর জঙ্গীবাদ এমনসব বিপথগামিতার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে বই পড়া। তাই আমাদের সন্তানদের হাতে বই কিনে দিতে হবে। একটি সুন্দর জামার চেয়ে, দামি মোবাইলের চেয়ে কিংবা রেস্তুরায় বসে হাজার টাকার উদূরপূর্তি করার চেয়ে বইয়ের মূল্য অনেক অনেক বেশি। বই চিরকালের মননশীলতার সঙ্গী। আসুন বইকে আকড়ে ধরি। বই পড়ি— জীবন গড়ি।

মতামত থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

S M Mukul
এস এম মুকুল
লেখক-কলামিস্ট, হাওর ও কৃষি অর্থনীতি বিশ্লেষক

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *