ভাগ্যটা আমাদের ভালই বলতে হবে। আজকে বিষ্যুদবার। হাফ স্কুল। দুপুরে খেয়েই মেলার দিকে রওনা হতে পারব। খায়রুল, রবিদাস আর কালিদাস খালপাড়ে অপেক্ষা করে থাকবে, আমি যেন খাওয়া শেষ করে দেরি না করি। প্লেটে হাত ধুয়ে স্কুলের শার্ট প্যান্টেই খালপাড়ে ব্রিজের ঢালে দৌড়ে যাই। দুপুরে খেয়েই কুত্তার মতো দৌড় দিয়েছি দেখে পেছন থেকে আম্মার গজগজানি শুনতে পাই। এবড়োখেবড়ো কাঁচা রাস্তায় মহিষের গাড়িতে যাওয়ার চাইতে হেঁটে গেলেই বরং তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে। তবে মহিষের গাড়ির সুরেলা ক্যা কু আওয়াজ শুনতে শুনতে পেছনে পা দুলিয়ে হেলেদুলে যেতে পারলেও মন্দ হয় না। কিন্তু দুই টাকা করে খরচ করতে কেউ রাজি নয়।
বেতুলিয়া ব্রিজের ঢাল দিয়ে নেমে চকের ভেতর দিয়ে শর্টকাট যাওয়ার একটা রাস্তা আছে। এই রাস্তা দিয়ে জোর কদমে হেঁটে গেলে মহিষের গাড়ির অনেক আগেই মেলায় পৌছানো যাবে। কিছুদিন আগে ব্রিজের ওই ঢালের জঙ্গল থেকে মানুষের একটা কাটা মাথা পাওয়া না গেলে আমাদের কেউই দুনোমুনো করত না। দলেদলে মানুষ মেলায় যাচ্ছে। অনেকেই চকের ভেতর দিয়ে যাবে, এক দলের সাথে মিশে হেঁটে গেলে ভয়ের কিছু নাই।
বৈশাখ মাস। ব্রিজের ঠ্যাংগুলো লিকলিক করছে। নদীর এখানে সেখানে ধানের সবুজ চারা নাচানাচি করছে। কোমর পানিতে অনেকেই নাইতে নেমেছে। মেলা থেকে ফেরার সময় এই ঢাল দিয়ে আর আসা যাবে না। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। পূর্নিমা রাত তো তাতে কি ! বড় রাস্তা দিয়ে হেঁটে কিংবা মহিষের গাড়িতেই ফিরতে হবে। বেশি দেরি হলে আব্বা সাটুরিয়ার হাট থেকে বাড়িতে চলে আসবে। এসে যদি দেখে বাড়িতে ফিরি নাই তাহলে জুলফি ধরে টেনে কান লাল করে ফেলবে।
পাগলা বাড়ির মেলা প্রতি বছর বৈশাখী পূর্নিমাতে বসে। বুদ্ধ পূর্নিমা। নানা রকমের জিনিসপত্র নিয়ে শত শত দোকান বসে। ঘাগরা গ্রামের পালেরা মাটির সরা, পাতিল, কুপিদানি, ছাই ফেলার বেলচা এসব তো আনেই, আরও নিয়ে আসে খেলনা ঘোড়া আর হাতি। কিন্তু যে জিনিসটা মেলার মানুষ সবচেয়ে বেশি কিনে সেটা হল মানুষের হাত, পা আর মাথা। মাটি দিয়ে ছোট ছোট করে বানানো মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। মাথা ব্যথায় মাথা আর পা ব্যাথায় পা কিনে মাজারে মানত দেয় পাগলা পীরের ভক্ত আর আশেকানরা। রবিদাসের মা রবিদাসকে একটা মাথা কিনে মাজারে মানত করতে বলে দিয়েছে। অংক ইংরেজি সাবজেক্টে পাশ তো দূরের কথা, গোল আলু পায়। মাথা মানসী করে রবিদাসের মাথার গোবরে যদি একটু সার হয়।
রবিদাসের সাথে প্রথমেই তাই আমরা পালদের দোকানে যাই। রবিদাস ভেবেছে, এই মাথা যে ওর মাথা সেটা আমরা কিছুই বুঝি নাই। ও যতোই বুলবুলি আর তুলুর কথা বলুক আমরা ঠিকই বুঝে গেছি মাথা মানত রবিদাসের মাথার উন্নতির জন্যেই। বুলবুলি আর তুলু রবিদাসের বড় দুই বোন।
পাগলা পীরের মাজার একটা পুরনো বটগাছের নিচে। টিনের মরিচা পড়া ঘরে কবরটি। সবুজ কাপড় দিয়ে ঢাকা। খাদেমেরা গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির মতো গোলাপ জল ছিটাচ্ছে। বটগাছের গোঁড়ায় মানত করা হাত পা মাথার উঁচু ঢিবি দেখে রবিদাস চোখ বন্ধ করে কি একটা বিড়বিড় করে মাথাটা ছুঁড়ে দিল। হাজার হাজার মাথার ভেতরে রবিদাসের মাথাটাও হারিয়ে গেল।
ভিউকার্ড আর পোস্টারের একটা দোকান চোখে পড়তেই আমরা ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলাম। যে যার প্রিয় নায়ক নায়িকাদের চেহারা নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলাম। আমার প্রিয় নায়ক ভারতের অজয় দেবগান। কে যেন একবার বলেছিল আমার চেহারার সাথে নায়কের মিল আছে। তারপর থেকেই অজয়ের ভক্ত হয়ে গেলাম। কয়েক বছর পরে বিপ্লব মামা বলেছিল আমার ফেস কাটিং হৃত্বিক রোশনের মতো। পরের বছর পাগলা বাড়ির মেলা থেকে হৃত্বিকের মানিব্যাগে রাখা যায় এরকম সাইজের একটা ভিউকার্ড কিনেছিলাম। ভিউকার্ড হাতে ধরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারা মিলিয়ে দেখতাম৷ কিন্তু তারপর থেকে কেউ আর আমার চেহারা নায়কদের মতো বলেনি। সে দুঃখ আমার আজও ঘুচেনি। তাই বলে পাগলা বাড়ির মেলায় যাওয়া বন্ধ করে দেই নি। তবে ভিউ কার্ড কেনা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।
মানত, ভক্তি আর নায়কদের ভক্তগিরি শেষ হলে আমরা পেঁয়াজু আর গুঁড়ের জিলাপি কিনে মাঠের কোণায় গিয়ে বসি। সূর্য ঠান্ডা হয়ে এসেছে। একটু পরেই ধলেশ্বরী নদীতে অস্ত যাবে। এক গ্রাম পরেই নদী।
মেলা ভাঙতে শুরু করেছে। মহিষের গাড়িতে জায়গা পাওয়া যাবে না মনে হয়। খেত খামারের ভেতর দিয়ে শর্টকাট রাস্তায় যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। যে করেই হউক মহিষের গাড়িতে সিট পেতে হবে। হেঁটে গেলে পরের বছর পা ব্যথার জন্য পা মানত করতে হতে পারে। আপ ডাউন হাঁটা সম্ভব না। দেরি হলে বাড়িতে গিয়ে জুলফির চুল পাতলা হয়ে যাবে।