প্রথম পাতা » গল্প » শুকুম উদ্দিন

শুকুম উদ্দিন

ছহির আলী আর আনাই বিবির অহংকারে ভরা কথাবার্তা শুনে গ্রামের মানুষের কান আর মন তিতা হয়ে গেল। “আমি এহন থিকা সোনার থালে ভাত খামু। আমার গোবরের হাজি টানব বান্দি দাসীরা”। ছহির আলীর বড় ছেলে শুকুম উদ্দিন ঢাকার একটি কলেজ থেকে পাশ করে বিলেত যাওয়ার বৃত্তি পেয়েছে। লেখাপড়া করে জ্ঞানীগুণী মানুষ হবে সেই চিন্তার চেয়ে টাকা পয়সায় ফুলেফেপে ছোটখাটো রাজাগজা হয়ে যাবে এই চিন্তাই ছহির আলী আর আনাই বিবির বেশি। শুকুম উদ্দিনের মনেও একই চিন্তার উথাল পাথাল ঢেউ। ঢাকা থেকে বাড়ি এসে তার হাটার ধরণটাই বদলে গেলো। দুই হাত দুই পা বরাবর সোজা রেখে শুধু শরীর বামে ডানে দুলিয়ে হাঁটা দেখে আনাই বিবি নিজেই বলে ফেলল, “তুই মেলার পুতুলনাচের পুতুলের মতো এরকম কইরা হাটস কেন? ঢাকা থিকা শরীর খারাপ কইরা আইছস নাকি! আয় হাতে পায়ে ভেন্না গাছের তেল দিয়া মালিশ কইরা দেই। বিলেতে গিয়া নিজের খেয়াল রাইখা চলতে অইব তোর।“ মায়ের এই কথা শুনে শুকুম উদ্দিন প্রায় বলেই ফেলেছিল, “তোমার পেটে শিক্ষা দীক্ষা নাই, তুমি এই হাটার কি বুঝবা, পারো তো খালি বইসা বইসা পাটাপোতায় মাশকলাইয়ের ডাল গুড়া করতে আর গোবরের হাজি নিয়া পাগাড়ে যাইতে।“ কিন্তু শুকুম বলল, “মা, বাজানরে কইও চরের জমির কিছু অংশ বিক্রি কইরা আমারে কিছু টাকা দিতে। জামা কাপড় জুতা মোজা কিনতে হইব।“ আনাই বিবি চোখের সামনে সাহেব পোলা কল্পনায় দেখতে শুরু করল। “আর কি কি লাগব আগেই চিন্তা কইরা রাখ, তোর বাপেরে আমি আগেই কইছি টাকা পয়সার কথা।“ আনাই বিবি মনে মনে বলল, “এতো জমিজমা তো তরই। তোর ছোট ভাই মিনার আলী ম্যাট্রিকটাও পাশ দিয়া পারল না। সুন্দর মাইয়া দেইখা ফকিন্নির ঝি বিয়া কইরা নিয়া আইছে। ওরটা ওই বুইঝা খাইক। হাটে হাটে গিয়া চালের ব্যবসা করে, বেপারী হইছে। মন থেইক্কা অরে ধুইয়া মুইছা দিমু। আমি বেপারীর মা না, আমি সাহেবের মা।” আনাই বিবির বুকে তৃপ্তির পানি টলটল করে উঠে।

ছোট ছেলে মিনার আলী সহজ সরল মাটির মানুষ। কারও আগে পিছে নাই। প্রচন্ড পরিশ্রম করে নিজেরটা নিজেই করে খায়। কারও ধার ধারে না৷ এরকম তার মানসিকতা। শিক্ষাদীক্ষা কম থাকলেও মিনার আলী মিনারের মতোই উঁচু। স্কুলে সাইকেল নিয়ে যাওয়া আসার পথে পাশের গ্রামের এই ফকিন্নির ঝির সাথে ভালোবাসা হয়ে যায়। মেয়েটার বাপ মারা গেছে তিন বছর বয়সে। চাচাদের বাড়িতে বড় হয়েছে। দুই বোন। কোন ভাই নাই। ভাই না থাকায় তার মা কোন সহায় সম্পত্তি পায় নাই। আছে বলতে একটা ঘর। আনাই বিবির কাছে মেয়েটা তাই ফকিন্নির মেয়ে আর মেয়েটার মা ফকিন্নি।

ছহির আলীর জমিজমা হিসাব ছাড়া। ছোটখাটো জমিদার বলা যায়। আবার আছে সার আর চিনির ব্যবসা। গোয়ালে দশ বারোটা গরু। আনাই বিবি প্রায়ই মিনার আলীর বউকে বলে আমি যতো দুধ খাইছি তুই ততো পানিও খাস নাই। মিনার আলীর বউ চুপ করে দশ বারো জনের রান্না করতে থাকে। ছহির আলীর আরো তিন মেয়ে আছে। প্যাচানী, দুলুনি আর আসমানি। তিনজন সারাক্ষন ছোট ভাইয়ের বউ এর পেছনে লেগে থাকে। হাতে পায়ে তেল মালিশ করে মিনারের বউকে একটার পর একটা ফরমায়েশ দিয়ে যায়। সাহেবের বোন আর জমিদারের মেয়ে তারা। ফকিন্নির মেয়েটাকে যতোভাবে পারে জ্বালা দিয়ে অঙ্গার করে ফেলে এই তিনজন। একদিনের ঘটনা৷ এতো বেশি জ্বালা আর খোটা দিয়ে কথা সহ্য করতে না পেরে মুখের উপর দুই একটা কথা বলে দেয় বউটি৷ তাতেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে আনাই বিবি আর তার মেয়েরা৷ এক পর্যায়ে চারজন চুলের মুঠি ধরে মারতে শুরু করে৷ অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে বউটি৷ আনাই বিবি আর প্যাচানীরা ভাবে মরেটরে গেছে৷ খবর পেয়ে বউ এর চাচারা আসে, ভ্যানে শুইয়ে ভাতিজিকে নিয়ে যাওয়ার সময় বলে যায় পুলিশে দেবে সবাইকে৷ পুলিশের ভয়ে আনাই বিবি মেয়েদের নিয়ে ঘরের কাড়ে গিয়ে লুকিয়ে থাকে সারাদিন৷

মিনার আলী হাট থেকে চাল বিক্রি করে বাড়িতে এসে বউকে ডাকাডাকি করে আর পায় না। পাশের বাড়ির চাচী সব খুলে বলে মিনারকে৷ মিনার পাগলের মতো ছুটে বউ এর কাছে৷ গিয়ে দেখে তার বউ তখনো অজ্ঞান, স্যালাইন দেয়া হচ্ছে৷ মিনার আলীর দেড় বছরের শিশু ছেলেটি পাশে বসে খেলছে৷ আনাই বিবি তার মেয়েদের নিয়ে দুধভাত খেতেখেতে ভাবে আপদ বিদায় হয়েছে৷ এবার তার ছেলেকে একটা ধনী ঘর দেখে বিয়ে দেবে৷ কিন্তু মিনার আলী আর ফিরে আসলো না৷ একদিন এসে জিনিসপত্র যা ছিল তা নিয়ে গেল৷ অন্যগ্রামে গিয়ে থাকবে৷ এখানে থাকলে এরা তার বউ বাচ্চা মেরে ফেলবে৷

শুকুম উদ্দিন বাসে করে বিমানবন্দরে যাওয়ার সময় এক দুর্ঘটনায় বাম হাতের কব্জি হারায়। ছহির আলী আর আনাই বিবির সোনার থাল ফুটো হয়ে যায়। হাসপাতাল থেকে বাড়ি এসে শুকুম উদ্দিন আর কিছু করে না। হাত পা ছাড়া অনেক মানুষ মনের জোরে আর জেদে অনেক কিছুই করে। কিন্তু শুকুম উদ্দিনের মাথায় বাপের জমিদারি ঘুরে। ছহির আলী আর আনাই বিবিও ছেলেকে আস্কারা দিয়ে দিয়ে ঘরেই বসিয়ে রাখলো সাহেব বানিয়ে। সাহেবের বিয়ে শাদির ব্যাপারে খোঁজ খবর হতে লাগল। প্রায় সাহেব হওয়া ছেলে আর বাপের জমিদারি দেখে অনেকেই মেয়ে দিতে চাইল। বিয়ে হলো।

বছর পাঁচেক কেটে গেল। শুকুম উদ্দিনের মাথায় একটা ধান ভাঙ্গানোর মেশিন বসানোর ইচ্ছা হল। বাজারের পাশেই ছহির আলীর প্রায় ৩৩ শতাংশ জমি। দামী জমি। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে ভাগ ভাটোয়ারা হওয়ার আগেই লিখে নিতে পারলে তাকে আর পায় কে। ছহির আলীর সব জমির মধ্যে এই জমিটাই সবচেয়ে ভালো। শুকুম উদ্দিনের আসল উদ্দেশ্য এই জমি লিখে নেয়া। শুকুম উদ্দিন সেই জমিতে একটা মেশিন ঘর বসালো। কিছুদিন পরপর মেশিন নষ্ট হয়ে যায়। মেশিনের ফিতা ধান ভাংগানোর সময় বারবার পড়ে যায়। শুকুম উদ্দিন মেশিন বসানোর পর বলে বেড়াচ্ছিল এবার সে ছোটখাটো রাজা গজা হবেই। আশেপাশে কয়েক গ্রামে ধান ভাংগানোর মেশিন নাই। সবাই আসবে তার দোকানে। কিন্তু মেশিন তাকে মানল না। কিছুদিন যেতেই মেশিন বিক্রি করে দিতে হল। ছহির আলী জমিও লিখে দিল না। তার এতোগুলো টাকা বড় ছেলে নষ্ট করল।

কয়েক বছর পর শুকুম উদ্দিন ঢাকার নবীনগরে বউ আর ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে গেলো। সেখানে শ্বশুরবাড়ির এক লোকের বাসায় থাকবে আর চাকরি করবে। শুকুম উদ্দিন কোন চাকরি করল না, একটা জুতার ফ্যাক্টরীতে চাকরি শুরু করল শুকুমের বউ। প্রায় দশ বছর ঢাকায় কাটিয়ে টাকা পয়সা জমিয়ে, মেয়ের বিয়ে দিয়ে শুকুম উদ্দিন গ্রামে বাপের বাড়ি চলে আসলো। বাপের জমিজমা ফুসলিয়ে লিখে নিতে হবে। এর মধ্যে আনাই বিবি একদিন গোবরের হাজি নিয়ে বৈশাখ মাসের কাঠফাটা রোদে শুকনো পাগাড়ে নামতে গিয়ে মরে পড়ে রইল। আনাই বিবির পাইপাই আনার হিশাব আগারে পাগাড়ে শেষ হল।

শুকুম উদ্দিন চিন্তায় পড়ে গেল। তার বাবা ছহির আলীও মায়ের মতো এরকম হঠাৎ করে অক্কা পেলে তার আর জমি লিখে নেয়া হবে না। আনাই বিবির মৃত্যুতে ছহির আলী ভেঙ্গে পড়ল। শুকুম উদ্দিন নিজের মতো করে দলিল লিখিয়ে ছহির আলীর কাছ থেকে একের পর এক জমি লিখিয়ে নিতে থাকল। ছহির আলী বিছানায় পড়ল। শুরুর দিকে সেবা যত্ন যা একটু আধটু করত শুকুম উদ্দিন আর তার বউ, জমিজমা সব লিখে নেয়ার পর ছহির আলীর বিছানায় পায়খানা প্রস্রাব জমে পচঁতে শুরু করল। কেউ তার খবর নেয় না। ছোট ছেলে আর তার বউকে তো দুধের ছেলেসহ অনেক আগেই ছহির আলীর মেয়েরা বাড়িছাড়া করেছে। সীমাহীন কষ্ট করে সংসার চালায় মিনার আলী৷ বাপ একটা কানাকড়িও দেয় নাই। ফকিন্নির মেয়ে বিয়ে করার অপরাধ।

ছহির আলীর যেদিন যায় যায় অবস্থা সেদিন ছোটছেলে মিনারকে খবর দেয়া হল। মিনার গিয়ে পায়খানা প্রস্রাব পরিষ্কার করল। মিনারের বউ মুখে পানি দিল। প্যাচানী, দুলুনি আর আসমানীরাও এসেছে ছেলেপুলে আর স্বামী নিয়ে। অনেক বছর কেটে গেছে। প্যাচানী আর দুলুনির স্বামী মারা গেছে। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। ছহির আলী অনেক জমি বিক্রি করে মেয়ের ঘরের নাতি নাত্নিদের দিয়েছে। ছোটছেলের ঘরের নাতি নাত্নিদের খবরও নেয়নি৷ কিছুই পায়নি তারা। না দাদা দাদীর ভালোবাসা, না দুই এক মণ ধান৷

শুকুম উদ্দিনের মাথায় এখন শকুন ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্থাবর অস্থাবর সব জমি লিখে নিয়েছে। এখন আর শুকুমের মাথায় জমি নাই, আছে শুধু শকুন আর ছহির আলীর মৃতদেহ।

গল্প থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *