খাটের ক্যাচক্যাচ শব্দে ঘুম ভাঙলে খুবই বিরক্ত লাগে সোনাফরের। অথচ প্রায় প্রতিদিনই তার সাথে এ ঘটনাটি ঘটে। চোখে মুখে বালিশ চাপা দিলেও শব্দ দূর হয় না। বরং আরো ঘনীভূত হয়। মিস্ত্রি ডেকে খাটটা ঠিক করাবে তা-ও মন চায় না। এই খাটে না ঘুমাতে পারলেই ভালো হতো। কিন্তু সম্ভব না। স্ত্রীকে ছাড়া থাকা যাবে না। বৌকে যে সে খুব ভালোবাসে তা নয়। রাতে তার স্ত্রী একা থাকতে ভয় পায়। তাই বাধ্য হয়েই থাকতে হয়। এ বয়সে একা থাকতে পারলেই বরং ভালো লাগে। বয়স যদিও তেমন নয়। কতই আর হবে? পঞ্চাশের একটু এদিক সেদিক। তবু বৌ এর গলা জড়িয়ে থাকতে এখন বিরক্ত লাগে। অথচ এভাবেই ঘুমের শুরুটা হয় প্রতিরাতে। তার স্ত্রী মাজেদা বেগমের বয়স চল্লিশ। কিন্তু বয়সের তুলনায় অনেক বেশি বার্ধক্য তাকে ভর করেছে। শরীরের মেদ ঝুলে গেছে। মোটা হওয়ার সাথে সাথে গায়ের চামড়া আরো কালচে হয়েছে। ল্যাদল্যাদা একজন যখন তার গলা শক্ত করে ধরে রাখে তখন সহসা তার ঘুম আসে না। স্ত্রী ঘুমিয়ে গেলে আলগোছে সে উঠে যায়। পানি খায়। মোবাইল টেপে। পরিচিত কয়েকটি নাম্বারে কল দিতে গিয়েও কেটে দেয়। ম্যাসেঞ্জারে এর-ওর খোঁজখবর নেয় :
– ভাবি ঘুমান নাকি?
ভাবিদের কাছ থেকে রিপ্লাই আসে না। হতাশ হয়ে আরেক ভাবির খোঁজ নিতে মেসেজ পাঠায় :
– ভাই কি দেশে না বিদেশে?
উত্তর নাই। সোনাফর মনে মনে গালি দেয়। ‘মাগি’! তারপর রাত আরো গভীর হলে পার্সোনাল জায়গায় ফোন করে। নিচু স্বরে কথা বলতে থাকে সাবধানে। কথাতেই এখন সব হয়। সোনাফরের সব তাকদ এখন মাথায়। টুনটুনিটা এতো সুন্দর করে কথা বলে! আহ! সোনাপাখি নীলময়না! চটাং চটাং করে যখন বলে শরীরটায় কারেন্টের শক লাগে। তারপর ঠাণ্ডা হয় দেহমন। মাজেদা বেগমের পাশে শুয়ে শুয়ে ভাবে : এই জলহস্তিটারে বিয়ে করা বিরাট বোকামি হইছে! খাটের একেবারে কিনারে একটু জায়গায় তাকে শুতে হয়। পুরাতন ডিজাইনের এই খাটটা মাজেদা বেগমের বাপের বাড়ির দেওয়া। খাটের বয়স বিশ বছর। বিয়ের সময় এই খাট আর কয়েকটা কমদামি ফার্নিচার দিয়েছিল তার শ্বশুর। শালা হারামজাদা। সোনাফর তার শ্বশুরকে গালি দিয়ে মজা পায়। শ্বশুরকে শালা-হারামজাদা বলে গালি দেয় কোন যুক্তিতে তা সে জানে না। শুধু জানে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে ঠকিয়েছে। জোর করে মাজেদা বেগমকে তার সাথে বিয়ে দিয়েছে। এখনো তার মনে পড়ে সেসব দিনের কথা। সুখে দুখে মেশানো তার দিনগুলো।
মফস্বল থেকে সোনাফর ঢাকার অদূরে একটি এলাকায় আসে পড়ালেখার জন্য। সেখানে নিকটাত্মীয় কেউ না থাকায় একটি লজিং খুঁজতে হয় তাকে। একসময় পেয়েও যায়। বাড়িতে সোনাফরদের অবস্থা ভালো না। কিছু ধানি জমি আছে। কিন্তু ঐটুকু দিয়েই সারা বছরের সবটা খরচ চালাতে হয়। টিউশনি বা লজিং ছাড়া সোনাফরের উপায় নেই। যে বাড়িতে লজিং ঠিক হলো সে বাড়িতে থাকবে, খাবে সে। বাড়িওয়ালার দুটো মেয়ে আছে। তাদের পড়াবে দুইবেলা। মেয়েদের পড়াতে হবে একথা শুনেই সোনাফরের ভিতরটা কেমন করে ওঠে। মেয়েদের সাথে কোনোদিন সে মেশে নাই। স্কুল কলেজে সোনাফরের বন্ধু বান্ধব বলতে কেউ ছিল না। কারো সাথে মিশতে তার ভালো লাগতো না। তাই তার বন্ধুও হয়নি। বান্ধবিও হয়নি। সে কথাও তেমন বলতে পারে না। একবার পাড়াতো এক ভাবিকে এক কথা বলে বিপদে পড়েছিল। বিচারও হয়েছে। কথা তেমন কিছু না। সন্ধ্যার পর সে পাশের বাড়িতে গেছে। ঐ বাড়ির পুরুষ মানুষটি গেছে বাজারে। ছোট একটা পিচ্চি আছে তাদের। পিচ্চির মা ছেলেটিকে অ আ ক খ পড়াচ্ছে। সোনাফর হঠাৎ সেখানে উপস্থিত। কী বলবে না বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। ঠাট্টার ছলে সে বলে বসল :
– ভাবি, পিচ্চি কি পড়ে না খালি মায়ের দুধই চাটে?
একথা শুনে মহিলা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। মুহূর্তেই বিরাট কাণ্ড। চিৎকার, চেঁচামেচিতে লোক জড়ো হলো। পাছে বৌটির মান যায় ভেবে ঐ বাড়ির লোকজন নানা হুমকি ধামকি দিয়ে সেরাতে সোনাফরকে বিদায় করলো।
মেয়েদের পড়াতে হবে ভেবে একবার ভাবলো না নিক লজিং। কিন্তু যাবে কোথায় সে? তাই আর অন্য চিন্তা না করে উঠে পড়লো সোনাফর। বড় মেয়েটি ক্লাস নাইনে পড়ে। ছোটোটি সেভেনে। বড়টি হাবাগোবা। চেদভেদ নাই। মোটা আর কালো। কিন্তু ছোটোটার দিকে তাকালে হঠাৎ মন খারাপ হয়। এতো সুন্দর যেন টিয়া পাখি। সারাক্ষণ ফট ফট করে কথা বলে। কী মিষ্টি চেহারা। সোনাফরের খুব ইচ্ছে হয় সেভেনে পড়ুয়া এই মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে একদিন খুব কাঁদুক সে। জীবনের সব দুঃখ হাহাকারের কথা তার বুকে মাথা রেখে উজাড় করে বলুক সে। মাঝে মাঝে সোনাফর সারারাত জেগে থাকে। তার ঘুম হয় না। টিয়াপাখিটা পাশের ঘরেই ঘুমাচ্ছে। একদিন কি এমন হতে পারে না যে টিয়াপাখিটা তার গলা জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। এই চাওয়াটা কি খুব অন্যায় আর খুব কি বেশি তার জন্য? সে-ও তো মানুষ। তারও তো টিয়াপাখি পুষতে মন চায়।
একদিন আচমকা এক ঘটনা ঘটে। বাড়িওয়ালা বড় মেয়েকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছে। বাড়িতে ছোট মেয়েটি আর সোনাফর। সোনাফর প্রথমে বুঝতে পারেনি। মেয়েটি কী একটা খাচ্ছিল। সোনাফর আর সময়ের অপচয় করতে চায় না। সে সময়কে কাজে লাগাতে চায়। সে তার লোভ সংবরণ করলো না। বলল:
– কী খাও, টুনি?
– আমভর্তা। খাবেন স্যার?
– খাওয়াই দিলে খামু। দিবা খাওয়াইয়া?
টুনি কিছুটা লজ্জা পেলো হয়তো। পাক। লজ্জা নারীর ভূষণ। সোনাফরের শরীর কাঁপতে লাগলো। তার চেয়ে বারো বছরের ছোট একটি মেয়ের কাছে যেন অতলে হারিয়ে যাচ্ছে সে।
– দিবা? একটু আমভর্তা? খাওয়াই দিবা?
টুনি হুঁ বলে হাত বাড়িয়ে দিল। সোনাফর হা করে মুখ সামনে আনতেই গালাগালির আওয়াজ দ্রুত কান বরাবর ছিদ্র করতে লাগলো :
: চুতমারানির পুতেরা বাড়িত পার্ক বানায়া লইছো। বারহা চুদাও নডির পুত!
রাতেই বিয়ের আয়োজন সম্পন্ন হলো। সোনাফর একদিকে খুবই উৎফুল্ল। আরেকদিকে আতঙ্কিত। ভুলের মধ্য দিয়েই জীবনের চরম পাওয়া হয়ে যায় কখনো কখনো। রাত এগারোটায় সোনাফর সংবাদ পেলো বিয়ে হচ্ছে বড় মেয়ে মাজেদা বেগমের সাথে। আমের টক তার দাঁতে লেগে আছে। ঐদিক থেকে মুরগির রোস্টের ঘ্রাণ আসছে। টকদাঁতে সে কি পারবে আস্ত মুরগির রোস্ট চাবাইতে?
শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে আড়ালে তাই গালি দিয়ে জুত পায় সে। বাটপারের দল তাকে ঠকিয়েছে। তার ছিপছিপে এলিয়নটা আরেকজনকে দিয়ে তাকে দিয়েছে পাঁচটনি মালগাড়ি! মাজেদা বেগম যখন নড়েচড়ে তখনই খাট ক্যাচক্যাচ শব্দ করে। এ শব্দেই সোনাফরের ঘুম ভেঙে যায় প্রতিদিন। মাজেদা বেগম দেখতে সুন্দরী না হলেও তার ভাগ্য ভালো। এই বিশ বছরে সোনাফর তরতর করে ব্যবসায় লাভবান হয়েছে। মাজেদা ডেইরি ফার্ম, মাজেদা ফ্যাশন হাউজ, মাজেদা-সোনাফর কাটল ফিল্ডসহ নানামুখী ব্যবসায় সে রাতারাতি টাকা বানিয়েছে। চারিদিকে তার নামজশ খ্যাতি। সে এখন নব্য বুদ্ধিজীবী। মসজিদ, মাদ্রাসার সভাপতি, চ্যারিটি ফাউন্ডেশনের প্রধান অতিথি, সব জায়গায় তার ডাক পড়ে। সেসব জায়গায় মোটা অঙ্কের ডোনেশন দিতে হয় তাকে। সে এখন সম্মানিত বোধ করে। আগে নাম ছিল সোনাফর আলী। এ নামে ভারিক্কি আসে না বলে দেওয়ান লাগিয়েছে। তার এক ঠগচাচা এখনো বেঁচে আছে। মাজেদা ডেইরি ফার্মের দেখাশোনা করে। সে একদিন বড় রকমের এক সংবাদ দিল:
– বুজলা ভাইস্তা, তুমি তো জদুমদুকদুর নাতি না। তুমি দেওয়ান মতলু খার নাতি। তুমি তো মিয়া সোনাফর আলী না। সোনাফর দেওয়ান তুমি। নামের বড়াই করি না বইলাই আমরা লাগাই না। বড় গাঙের চরও বড় থাকে। আজকা থেইকা তুমি সোনাফর দেওয়ান।
নামটির এখন ইজ্জত ফিরে আসছে। তার খুব ভালো লাগে। সোনাফর মোবাইল হাতে নিল। সকাল ৭.৩০ বাজে। নয়টায় প্রোগ্রাম আছে৷ মে দিবসের একটা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি সে। এরপর দুপুরে শ্রমিক ফেডারেশনে যেতে হবে। এবার ফেডারেশন তাকে পুরস্কৃত করবে। টাকা অবশ্য গেছে মোটা দাগে। যাক, টাকাইতো জীবনের সব না। একটা লজিং মাস্টার থেকে আজ কতদূর। সামনে ইলেকশন। এখন পুরস্কারের দরকার আছে। নমিনেশনটা কোনো মতো নিতে পারলে কেল্লাফতে! সোনাফররে আর পায় কে? আফসোস শুধু এক জায়গায়! শালা, হারামজাদা!
সন্ধ্যায় যেতে হবে টুুনটুনির কাছে। অনেক কাজ! হাতে আছে দেড় ঘণ্টা। জলহস্তি উঠবে না। খালি মোচড়াবে। কাজের লোক নাস্তা বানাচ্ছে। বানাক। ফেসবুকের খবর কী?
রাত বারোটায় মে দিবস নিয়ে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছে সোনাফর :
“মে দিবস দিচ্ছে ডাক
বাটপাররা নিপাত যাক।”
সাড়ে সাত ঘণ্টায় নিজেরটা সহ চারটা লাইক, তিনটা হাহা রিএ্যাক্ট! কোনো কমেন্টই নাই! লোকজন সব ভুয়া। এগো কোনো চেদভেদ নাই। মেন্দামার্কা সব। দ্রুত ফেসবুক লগ আউট করে সে উঠে পড়লো। এক ঘণ্টার মধ্যে রওয়ানা করতে হবে।
গোসল সেরে সোনাফর টেবিলে এসে বসল। কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না। টেবিলে কতো আয়োজন! অথচ একসময় সবই খেতে ভালো লাগতো তার। এখন তার শাশুড়ি, মাজেদা বেগমের মা একসময় খাওয়ার খোটা দিতো। আড়ালে সে কয়েকবার শুনেছে। তার ভাত খাওয়া নিয়ে মাজেদা বেগমের মা কতো কথাই না বলতো। গারল বলে গালিও দিতো। শুধু লবণ দিয়েও দুই তিন প্লেট ভাত খাওয়া ছিল মামুলি ব্যাপার। এখন হয়েছে অজীর্ণ রোগ। কিছুই হজম হতে চায় না। না, আজ কিছুই খেতে মন চাচ্ছে না। দুই টুকরো শশা খেয়ে সে উঠে পড়লো। মাজেদা বেগম উঠে এসেছে :
– খাইলা না ক্যা? ঢং!
– তুমি খাও। তোমারতো আর সমস্যা নাই। খাও। বেশি কইরা খাও। খাইয়া খাইয়া ঢোল হও।
– বাজাইতে তো পারো না। ঢোল – খরতাল হইয়া লাভ কী? যেখানেই যাও, তাড়াতাড়ি ফিরবা। কালবৈশাখীর দিন। হুটহাট ঝড় আসে। ডর লাগে।
– ডর লাগলে ময়নার মারে জড়ায়া শুয়া থাকবা। আমার দেরি হবে।
– ময়নার মায়েরে জড়ায়ে থাকতে হইলে ব্যবস্থা কর। আমার তো কলাগাছ দরকার নাই। একটা কলাগাছের লগে ঘর করি।
একটা কঠিন কথা বলতে গিয়েও সোনাফর বললো না। বিশ বছরে একটা সন্তান সে দিতে পারেনি মাজেদাকে। কলাগাছও তো জীবনে একবার ফল দেয়। সে তো তা-ও পারেনি। সে কথা না বাড়িয়ে বরং পা বাড়ালো। প্রোগ্রাম মনে হয় শুরু হয়ে গেছে।
গাড়িতে বসার সাথে সাথেই ডেইরি ফার্ম থেকে ফোন এলো একটা। তার সেই চাচা ফোন করেছে। ধুরন্ধরটা টাকা কামানোর নানা কায়দা কানুন শিখে ফেলেছে। যখন তখন ফোন দিয়ে নানা উছিলায় টাকা হাতিয়ে নেয়। আপন চাচা বলে জোড় দিয়ে কিছু বলাও যায় না।
– চাচা, কও
– বিরাট ঝামেলা হইছে।
– বিরাট ঝামেলা পরে শুনব। এখন একটা প্রোগ্রামে যাচ্ছি।
– বাদ দেও প্রোগ্রাম। জীবন মরণ সমস্যা। তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসো। একটা…
সোনাফর ফোন কেটে দিল। আজাইরা প্যাঁচাল শোনার মানে হয় না। বরং টুনটুনিকে ফোন দেওয়া যায়:
– কী হইছে জান
– কিছু হয় নাই টুনটুন। ভালো আছো?
– আমার ভালো তো তুমি। তুমি ভালো থাকলেই আমি ফুরফুরা। আসবা না আজ?
– বিকালে আসব একবার। টুনটুন ঝুনঝুন, এখন রাখি
– আচ্ছা, গুনগুন পাখি।
সোনাফর ফোনেই চুমুর শব্দ পেলো। এই মেয়েটার সঙ্গে তার আগে দেখা হইলে জীবনটা আরো আনন্দময় হতো। এতো ঢং ঢাং জানে সে! আহ!!!
ডেইরি ফার্মে কাজ করতে আসার পরই মেয়েটি তার নজরে পড়ে। সোনাফরের জীবনে আনন্দ নাই। টাকা আছে। তার আনন্দ দরকার। মেয়েটিও অভাবী। তার দরকার টাকা। সোনাফর একরকম রক্ষিতা করেই তাকে রেখেছে। জগতে যার যা দরকার সেটাই সে হাতপেতে নিক না! এক জীবনে এতো হাহাকারের অর্থ কী? তবে খুব সাবধানে সোনাফর টুনটুনির সাথে দেখা করে। এই পৃথিবীর আর তৃতীয় কোনো ব্যক্তি এ খবরটি জানে না। অবশ্য বেশিদিন হয়নি। মাস দুয়েক কেবল হলো। তাকে আরো সাবধানী হতে হবে। মাজেদা বেগম কোনোকালে এ ঘটনা জানলে তার জীবনে রোজকেয়ামত নেমে আসবে। তার চাচা আবার ফোন করেছে। সে ফোনটি কেটে দিয়ে মোবাইল বন্ধ করে রাখলো। প্রোগ্রামে এসে পড়েছে সে।
প্রোগ্রামে লোক সমাগম কম। আয়োজকরা লাল রঙের পাঞ্জাবি পরে আছে। সবার মুখ হাসি হাসি। কোনো শ্রমিক তার চোখে পড়লো না। এরা সবাই বাবুসাব হয়ে ঘুরছে, বিড়ি খাচ্ছে, গল্প করছে। আয়োজকদের একজন এসে তার সাথে হাত মিলালো।
– স্যার, আপনি এসেছেন আমরা খুব খুশি হয়েছি। বসেন স্যার। সভাপতি মহোদয় এলেই আলোচনা অনুষ্ঠান শুরু হবে। এখন হবে গণসঙ্গীত। অনেক টাকা দিয়ে শিল্পী আনা হয়েছে। বসেন স্যার।
সোনাফর বসে বসে বিরস মুখে বসে রইলো। গান শুরু করার আগে হাবিজাবি ঠিকঠাক করতেই লাগলো আধা ঘণ্টা। গায়কের মনমতো সাউন্ডই আসে না। গিটারিস্ট গিটার নিয়ে ভংচং শুরু করেছে। মাথায় লালকাপড় পরে ভড়ং সেজেছে। সাউন্ডের এক পিচ্চিকে গালি দেওয়ায় একবার প্রায় হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম। সবাই মিলে পরিস্থিতি শান্ত করলো। এবার গান শুরু হবে। তবলচি ঠোকা দেওয়ার সাথে সাথেই কারেন্ট চলে গেলো।
উপস্থাপক নানা বিশেষণে সোনাফর দেওয়ানকে পরিচিত করে দিচ্ছে। এবার তার বক্তৃতা দেওয়ার পালা। তুমুল করতালির মাধ্যমে তার বক্তৃতা শুরু হলো :
‘সকলের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। আজ পহেলা মে। ছুটির দিন। বাড়িতে আরাম না করে যারা এখানে এসেছেন তাদের সকলকে লাল সালাম। শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দিন। তাদের সাথে খারাপ আচরণ করবেন না।…’
আট মিনিটের মতো বক্তৃতা দিলেন তিনি। আবারো তুমুল করতালি দিয়ে তাকে অভিনন্দিত করা হলো। অনুষ্ঠানের শেষে তাকে নিয়ে আয়োজকরা ছবি তুললেন। খানাপিনা হলো। মাওয়া থেকে বড় বড় ইলিশ, দেশি মুরগি, দেশি ষাঁড়ের সামনের রানের গোশত, টক দই, কয়েক প্রকারের পিঠা দিয়ে দুপুরের খাবার শেষ হলো। শ্রমিক তো শ্রমিক, ওদের বাপ দাদাও এমন খাওয়া খায় না মনে হয় পাঁচ বছর। কিন্তু সোনাফর একটা দেশি মুরগির রান হাতে বসে রইলেন। মনটা তার টুনটুনির কাছে।
দুইটার দিকে শ্রমিক ফেডারেশনের পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তা, শ্রমিকবান্ধব হিসেবে সোনাফর দেওয়ানকে পুরস্কৃত করা হলো। একটা ক্রেস্ট, একটা সোনার মেডেল, আর কিছু উপহার সামগ্রী। অথচ এ ব্যাপারে সোনাফর আয়োজক কমিটিকে দিয়েছেন তিন লাখ টাকা! টাকা যাক। তার দরকার পজিশন। বিকেল সাড়ে তিনটা নাগাদ অনুষ্ঠান শেষ হলো। সোনাফর এবার যাবেন আসল জায়গায়। ফোনটা এবার খোলা যায়। ফোন খুলেই দেখলেন একশ পঁচিশটি মিসড কল। মাজেদা বেগমও ফোন দিয়েছে তিয়াত্তর বার! বাকিগুলো ডেইরি ফার্ম থেকে! কী সর্বনাশ! তিনি ফোন ব্যাক করলেন।
মাথাটা ঝিম ধরে গেলো। এতোবড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে! তার মান সম্মান ইজ্জত পুরস্কার কোথায় গিয়ে ঠেকবে। তিনি খুব দ্রুত চললেন ডেইরি ফার্মের দিকে। টিনটুনি ফোন দিচ্ছে। ‘ধূর মাগি’ বলে ফোন কেটে দিয়ে আবার বন্ধ করলো।
ঘটনা এই : ডেইরি ফার্মের পুরাতন কর্মী জাকিয়া। দশ বছর ধরে সে এই ফার্মে চাকরি করছে। হঠাৎ আজ সকালে ফার্মের পাশেই তার মৃতদেহ পাওয়া গেছে। কে বা কারা তাকে মেরে ফেলে গেছে। গতরাতে ঝড় থাকায় বিদ্যুৎ ছিল না। অন্ধকারে হত্যাকারীরা এই সুযোগটি নিয়েছে। শরীরে আঘাতের চিহ্ন আছে। সম্ভবত রেপ করাও হয়েছে। ফার্মে আরো চারজন কর্মচারী আছে। সবার তদারকি করে সোনাফরের চাচা দওয়ান লতু। গতরাতে একজন নারী শ্রমিক, দুইজন পুরুষকে ছুটি দেওয়া হয়েছিল। ফার্মে ছিল লতু চাচা, একজন পুরুষ এবং জাকিয়া। জাকিয়ার আজ সকালে বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল।
পুলিশ এসে লতু দেওয়ানকে ধরে নিয়ে গেছে। পুরুষ কর্মচারীটি পলাতক। লাশ ময়না তদন্তের জন্য নেওয়া হয়েছে। সোনাফর দেওয়ান খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। যে করেই হোক হত্যাকারী যেন হাতছাড়া না হয়। জাকিয়ার মাবাবাকে সে সান্ত্বনা দিলো। নগদ টাকা দিলো একলাখ। তাদের হাত ধরে কাঁদলো অনেকক্ষণ। জাকিয়া তার মেয়ে। মেয়েহত্যার প্রতিশোধ সে নিবেই।
নানা দেনদরবার করে, অনেক জায়গায় ঘুরে ফিরে গভীর রাতে বাড়ি ফিরলো সোনাফর দেওয়ান। হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল করলো। মাজেদা এখনো জেগেই আছে। কোনো কথা হলো না। দুজনেই শুয়ে পড়লো।
খাটের ক্যাচক্যাচ শব্দে ঘুম ভাঙে সোনাফরের। মোবাইলটা হাতে নেয়। দশটা বেজে গেছে। ফার্মের দিকে যেতে হবে একবার। ফেসবুকটা দেখা দরকার। গতকাল কতো ছবি তোলা হলো! কেমন হইছে কে জানে?
একজন পোস্ট করেছে তার পুরস্কার নেওয়ার একটা ছবিসহ। ছবির ক্যামেরা ভালো বলতে হবে। তাকে তো সুন্দরই লাগে! শালা, হারামজাদা! কয়েকজন পুরস্কার তুলে দিচ্ছে। সে হাসিমুখে গ্রহণ করছে। ক্যাপশনে লেখা : কাহার আগে কে প্রাণ করিবেক দান, তাহার লাগি কাড়াকাড়ি!
এই ছবির এই ক্যাপশন! শালারা লেখাপড়াও জানে না। সে এবার অনলাইন নিউজে গেলো। ডেইরি ফার্ম নিয়ে একটা নিউজ হয়েছে : গতকাল পহেলা মে সাভারের মাজেদা ডেইরি ফার্মে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে। জাকিয়া নামের এক নারী শ্রমিক প্রতিদিনের মতো ফার্মে থাকা দশটি বিশালাকার ষাঁড়কে খাবার দিচ্ছিল। এক পর্যায়ে ফার্মের সবচেয়ে বড় ষাঁড় যাকে ‘নবাব’ বলে অভিহিত করা হয় তার বাঁধন খুলে যায়। সে জাকিয়াকে আক্রমণ করে বসে। একটা পর্যায়ে ‘নবাব’ তার বড় শিং দিয়ে জাকিয়ার তলপেটে আঘাত করলে ঘটনাস্থলেই সে মারা যায়। ‘নবাব’কে একনজর দেখতে আশেপাশের শত শত মানুষ ভিড় করে। আগামি কোরবানির ইদে নবাবের দাম কত হবে এই নিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা। ফার্মের স্বত্বাধিকারী সোনাফর দেওয়ান নিহতের পরিবারকে নগদ আশি হাজার টাকা প্রদান করেন।
খবরটি পড়ে সোনাফর মর্মাহত হলেন। ভুল নিউজ। সবার সামনে একলাখ টাকা দেওয়া হলো। অথচ! সোনাফরের তলপেটে হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠল। আজ মনে হয় কাজ হবে। দরজায় পত্রিকা দেখা যাচ্ছে। পত্রিকাগুলো ভালো করে পড়তে হবে। কে কী লিখল জানা দরকার। পত্রিকাগুলো নিয়ে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো সোনাফর দেওয়ান।