প্রথম পাতা » গল্প » নানী গাঙের পানি ও পিঠাপুলি

নানী গাঙের পানি ও পিঠাপুলি

পৌষ মাস চলে গিয়ে এখন মাঘ মাস চলে । মাঘে বাঘ কাঁপতে শুরু না করলেও কিছুদিন পরপর বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। আর শীতকালে বৃষ্টির পর ঠান্ডা বেড়ে যায়। সেই ঠান্ডায় বাঘ কাঁপাকাঁপি শুরু হয়। কিছুদিন আগে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় দিনে আর রাতে গুঁড়িগুড়ি বৃষ্টি হয়েছে। সেই বৃষ্টির পর ঠান্ডা তেমন না বাড়লেও ওমিক্রনের সংক্রমণ অনেক বেড়ে গেছে। বৃষ্টিপাতের সাথে করোনা বাড়ার কোন সম্পর্ক নাই। কিন্তু এই করোনা বেড়ে যাওয়ার কারনে আমার শীতের পিঠা খাওয়া আর হচ্ছে না। অনেকেই আমাকে পিঠা খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছিল। করোনার ভয়ে আর যাচ্ছিনা। আমার ভয়টা একটু বেশিই। তাই এখন পর্যন্ত এবার আর কারও বাড়ির পিঠা খাওয়া হয় নাই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে আমাদের এক বন্ধু কিছু ভাপা পিঠা আর চিতই পিঠা নিয়ে এসেছিল বাসায়। আর টাংগাইলে সন্তোষ বাজারে মাটির চুলায় একজন মহিলা চিতই পিঠা আর ভাপা পিঠা বানায়। চিতই পিঠার সাথে থাকে নানা রকমের ভর্তা। সরিষার ভর্তা, ধনে পাতা ভর্তা, মরিচ ভর্তা আরো নানা রকমের ভর্তা। এই দোকানের পিঠা আর ভর্তায় কিছুটা হলেও বাড়ি বাড়ি একটা ব্যাপার আছে। এই দোকানি মহিলা আর তার স্বামী অতো ব্যবসায়ী ধরনের না। গ্রামের সহজ সরল দম্পতি। বাজারের পাশেই চারাবাড়ি গ্রামে তাদের বাড়ি। শাহজামান দিঘীর পাড়ের এই দোকানের কাঠের বেঞ্চে বসে একদিন কয়েকটা চিতই পিঠা খেয়েছিলাম। এই হলো এবারকার শীতে আমার পিঠা খাওয়ার হিসাব নিকাশ।

ছোটবেলায় আমি আমার নানীর সাথে সাথে যেতাম গ্রামের যে বাড়িতে ঢেঁকি আছে সেই বাড়িতে। আগে ঢেঁকি ছাড়া চাল গুঁড়া করার আর অন্য কোন উপায় ছিলনা। গ্রামের দুই চারটা বাড়িতে ঢেঁকি পাওয়া যেতো। সেসব বাড়ির মহিলাদের ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলে ঢেঁকি ব্যবহার করার অনুমতি পাওয়া যেতো। আগে থেকেই বলে রাখতে হতো, অমুক দিনে আমাদের একটু ঢেঁকিটা ব্যবহার করতে দিয়োও। আর তো কারও বাড়ি যাইনা, তোমাদের বাড়িতেই আসি। আমার নানী আরও নানারকম কথা বলে রাজি করাতো। পিঠা বানানোর পরে সকাল বেলা ঐ বাড়িতে কয়েকটা পিঠা পাঠিয়ে দিত নানী৷ একবার কারও বাড়িতেই ঢেঁকির টিকেট পাওয়া গেল না। আমার আব্বা তার পরের দিনই একটা ঢেঁকি নিয়ে হাজির। কিন্তু ঢেঁকি কোথায় পাতা হবে তা নিয়ে দরবার শুরু হয়ে গেলো রীতিমতো। রান্নাঘরের ভেতর ঢেঁকি পাতার মতো জায়গা নাই। যাই হউক পরে জায়গা বের করে ঢেঁকি পাতা হলো। ঢেঁকি যেহেতু স্বর্গে গেলেও ধান ভানতে চায় তাই রান্নাঘরের এক সাইডে কোনমতে একটু জায়গা পেলেও ঢেঁকির ধান ভানায় কোন আপত্তি হওয়ার কথা না।

একজন ঢেঁকিতে পাড়া দিত আর একজন চাল আওলিয়ে দিত। ঢেঁকিতে পাড়া দেয়ার চাইতে চাল হাত দিয়ে নেড়ে দেয়া বেশি কঠিন। পায়ের সাথে হাতের তাল না মিললে ঢেঁকির লোহা দিয়ে বাধাঁনো মাথাটা এসে পড়বে হাতের উপর। হাত যাবে থেঁতলে। আমার নানীর হাতের উপর একবার পড়েছিল। নিচে চালের গুঁড়া বেশি থাকায় তেমন কিছু হয়েছিল না। হাতের কব্জিটা মচকে গিয়েছিল। ঢেঁকিতে পাড় দিচ্ছিল আমার নানীর দুই মেয়ে। মেয়েদের অনেক কথা শুনিয়ে দিয়েছিল নানী। দুই মেয়ের এক মেয়ে আমার মা। বড় মেয়ে। দোষটা বেশি ছোট মেয়ের, এই ভেবে নানী আমার খালাকে অনেক গালমন্দ করে দিল। কিন্তু আসল মজাটা নষ্ট হলো আমাদের। আমরা আজকে আর নানীর হাতের বানানো ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, হাতেকাটা সেমাই আরও অনেক কিছু খেতে পারব না। মচকানো হাত নিয়ে নানী পিঠা বানাতে পারবে না।

নানীর হাত ভালো হয়ে গিয়েছিল কিছুদিন পরে। তারপর অনেক বছর নানীর হাতের পিঠা খেয়েছি। কিন্তু বিগত দুই আড়াই বছর ধরে আর খেতে পারিনা। আমার “নানী গাঙের পানি” ২০১৯ সালে মারা গেলেন। “নানী গাঙের পানি” এই কথাটা আমার নানী প্রায়শই বলতো। “নানী গাঙের পানি, দাদি ব্যাকখানি”। দাদিই সব, নানি কিছুই না। এই হলো এই কথার সারবস্তু৷ কিন্তু আমাদের জন্য নানীই ছিল সব। নানী যা করেছে তা আর কেউ করেনি। তাইতো লোকে বলে, দুই মায়ের সমান হয় নানী। নানী দুই মা মানি।এখন আর পিঠা খেতে অতো ইচ্ছা হয়না। বাড়িতে গেলেও পিঠা খেতে মন চায় না। পিঠা খেতে ইচ্ছা না হলেও মনের মধ্যে ভেসে উঠে শৈশব আর বাল্যকালের পিঠা খাওয়ার স্মৃতি। এই স্মৃতিতে আমার নানী সব জায়গা দখল করে আছে। আমার মা খালারা পিঠা বানানোর বেলায় আর মুড়ি ভাজার সময় ছিল একদম অচল নানীকে ছাড়া । মুড়ি ভাজার স্মৃতি আরেকদিন বলা যাবে। গ্রামের ভাষায় যাকে বলে জাঞ্জর ছাবনী, সেই জাঞ্জর ছাবনী ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মুড়ি ভাজায় আমার নানী ছিল ওস্তাদ মহিলা ৷ নানীর মতো ওরকম সুচারুভাবে কাজটা আর কাউকে করতে দেখিনি আমি৷ এসব স্মৃতি আমার মতো প্রায় সবারই আছে। স্মৃতিগুলো জীবন থেকে অনেক দূরের কিছু মনে হয় এখন। দূরের সেসব স্মৃতিকে কাছে টানার ইচ্ছায় এসব নিয়ে লেখালেখি। তুচ্ছ জিনিসও অনেক দামী মনে হতে থাকে বয়স বাড়ার সাথে সাথে। আমার বয়স যে অনেক বেড়েছে তা নয়। কিন্তু স্মৃতিকাতরতা অনেক বেড়েছে। স্মৃতিকাতরতার কোন বয়স হয়না।

পিঠাপুলি খাওয়া আনন্দের ব্যাপার। এই ব্যাপারটিতে কষ্টের বিষয় না আনাই ভালো। কিন্তু আনন্দের সাথে কষ্ট থাকবেই আর কষ্টের সাথে আনন্দ। দার্শনিক ব্যাপার স্যাপার। যাই হউক, আমাদের রান্নাঘর ছিল বাড়ির সামনে ডানপাশে। সামনে উঠান। উঠানের তিনপাশে বাতাবিলেবু, কাগজি লেবুর গাছ। রান্নাঘরের পেছনে সারি করে কাঠাঁল গাছ। এসব কাঠাঁল গাছের নিচেই আমাদের রান্নাঘর ছিল। উঠানের একবারে পশ্চিম পাশে ছিল গোয়ালঘর। গোয়ালঘরের চালে শিম গাছের ঝোঁপ। এখন এসবের আর কিছুই অবশিষ্ট নাই। আছে শুধু আমাদের বাড়ি আর সামনে উঠান। নাই সেই কাঁঠাল গাছ, নাই সেই লেবু গাছ, নাই গরু, নাই গোয়াল। এখন আমাদের বাড়ি হয়ে গিয়েছে বাসা। শহুরে ভাবসাব৷

শৈশবের সেই কাঁঠাল গাছ ঘেরা রান্নাঘরে চলছে পিঠা বানানো। আমার আম্মা চালের গুঁড়া আর গুঁড় ভরে দিচ্ছে আর আমার নানী ভেজা কাপড় দিয়ে ঢেকে সেই পিঠা বসিয়ে দিচ্ছে পিতলের কলসি দিয়ে বানানো ভাপা পিঠা তৈরীর পানি ভরা হাঁড়িতে। পিঠা হলে প্রথম পিঠাটা নানী আমাকে দিত। বেত দিয়ে বানানো ছোট টুলিতে করে পিঠা খেতাম। আমার আব্বা আমাদের তিন ভাই বোনের জন্য তিনটা বেতের টুলি কিনে দিয়েছিল পাশের গ্রাম কেদারপুরের পাগলা বাড়ির মেলা থেকে। বেতের টুলি বাটির মতো একটা জিনিস৷ আমরা এই বেতের টুলিতে করে পিঠা নিয়ে খেতেখেতে সাদাকালো ন্যাশনাল টিভিতে বিটিভি দেখতাম। একটা ভাপা পিঠা খেলেই পেট ভরে যেত। একেকটা পিঠার সাইজ ছিল বলা যায় এক কেজি ওজনের একেকটা খেঁজুরের গোল পাটালি গুঁড়ের সমান।

সকালে উঠে রোদে বসে খাব দুধ চিতই আর আমার নানীর হাতেকাটা সেমাই। দুধ চিতই আর সেমাই দুই একদিনেই শেষ হয়ে গেলেও ভাপা পিঠা খাওয়া চলতো বেশ অনেকদিন। বড় ডেকচিতে রেখে দেয়া হতো পিঠা। সেখান থেকে বের করে বের করে পিঠা খাওয়া চলতে থাকতো। একদিন পর ভাপা পিঠা কিছুটা শক্ত হয়ে যেত কিন্তু নষ্ট হতো না। আরো বেশি মজা লাগতো। শক্ত ভাপা পিঠা অনেক সময় চাকু দিয়ে কেটে অর্ধেক করে খেতাম আমরা ভাই বোনেরা। অতো বড় পাটালি গুঁড়ের সাইজের ভাপা পিঠা একা খেয়ে শেষ করাটা বেশ দুরূহ ব্যাপার ছিল। মিষ্টি জিনিসটা আমার খুব প্রিয় ছোটবেলা থেকেই। চালের গুঁড়া রেখে আমি শুধু ভাপা পিঠার গুঁড় দেয়া মাঝখানের অংশটা খেতাম। বাকিটা টুলিতে রেখে দিতাম। আম্মা বা নানী খেত। আমরা যা খাইনা বা খেতে পারিনা তাই খায় বাবা মা নানা নানীরা। হৃদয় খুঁড়ে আনন্দ বের করার চেষ্টায় এসব লিখতে বসেছিলাম। কিন্তু জায়গায় জায়গায় বের হয়ে আসলো কষ্ট। নানীর মুখটা বারবার ভেসে আসছে। ধোঁয়া উঠা মাটির চুলার সামনে কাঠের পিঁড়িতে বসে জ্বাল দিচ্ছে চুলায়৷ মাথায় কাপড় দেয়া, পায়ে পুরাতন এক জোড়া রুপসা জুতা আর গালে পান৷ কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

গল্প থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *