প্রথম পাতা » গল্প » সোশ্যাল মিডিয়া

সোশ্যাল মিডিয়া

Facebook Policy

আমি যখন নিতুদের বিল্ডিং এর নিচে তখন নিতু ফোন দিলো। “ কিরে জয়া এত দেরি কেন? সবার পড়ে এসে ঘর পরিষ্কার করবি নাকি?” এই নিয়ে নিতু বারো বার ফোন দিলো। আজ ওর ছেলে নিহালের জন্মদিন। আর আমি নিতুর সব চেয়ে কাছের বন্ধু। আমার আসার কথা ছিল অনেক আগে। কিন্তু অফিস শেষ করে বাসায় যেয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে আসতে আসতে দেরি হয়ে গেলো। আর এর মাঝেই নিতুর বারো বার ফোন। ওদের বাসা আট তলা না হলে আর আমি শাড়ী পড়া না থাকলে আজ  সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে  ওপরে উঠতাম। তাহলে নিতু যদি একটু শান্ত হত।

লিফট আসতেই পড়িমরি করে উঠলাম। শাড়ীতে পা আটকে প্রায় উলটে পড়ে যাচ্ছিলাম পাশের মহিলার উপর। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। যখন সব খারাপ যায় সবই খারাপ যায়। আমি উনাকে সরি বলতে উনি হাসলেন। হাসিটা খুব সুন্দর, তবে তার চেয়ে বড় হল হাসিটা আমার খুব চেনা। আরে কোথায় দেখেছি? খুব খুব চেনা। হঠাৎ মনে পড়লো উনি তো একজন ভ্লগার। ফেসবুকে উনার অনেক ভিডিও আমি দেখেছি। ভ্লগার মানে একটা সময় করতেন তারপর হঠাৎ করেই হারিয়ে যান। নিয়মিত তাকে ফলো করতাম বলে তার ভিডিও না দেখে অনেক খুঁজেছি কিন্তু পড়ে দেখলাম উনার আইডিটাও  উনি ডিএক্টিভ  করে দিয়েছেন।

“ আপনি সেঁজুতি রহমান না? ফেসবুকের “সেঁজুতির প্রতিদিন” নামে আপনার পেইজ ছিলো।

মহিলা এবার হাসল তবে আগের মত না। আর কোন কথা হল না, উনি সাত তলায় নেমে গেলেন। অথচ আমার অনেক কৌতূহল, অনেক কথা ছিল উনাকে জিজ্ঞাসা করবার।

সোশ্যাল মিডিয়া অনেকটা টেলিভিশনের মত। এখানে দুই দল লোক থাকে। একদল দেখায় অন্য দল দেখে। এই দেখায় দলের লোক খুব এক্টিভ তারা তাদের নানা রকম  এক্টিভিটিস  সবার সামনে তুলে আনে আর অন্য দল সেটা উপভোগ করে। এই জন্য বললাম সোশ্যাল মিডিয়া টেলিভিশনের মত। আগে যেমন আমরা টেলিভিশনের  অনুষ্ঠান উপভোগ করতাম, এখন সময় কাটে ফেসবুক দেখে। তো আমি ওই দর্শক দলের লোক। সময় কাটে ফেসবুক দেখে। 

সেঁজুতি রহমান নামের এই মহিলাটি ফেসবুকে একটা সময় খুব পরিচিত ছিলেন। প্রতিদিন তার নিম্নে দুইটা নতুন ভিডিও আসতো। প্রচুর ফ্যান ফলোয়ারস ছিল তার। মাঝে উনার ছেলেটা ডেঙ্গুতে মারা যান, তারপরই উনি একদম হাওয়া হয়ে যান। আসলে যাকে প্রতিদিন দেখতাম ফেসবুকে, তার প্রাত্যহিক জীবনের সবটাই ফেসবুকে আসতো ভিডিও আকারে সেই মানুষ যদি হঠাৎ হারিয়ে যান কিছু প্রশ্ন কিছু কৌতূহল তো থেকেই যায় তাই না?

“ কিরে একে তো দেরি করে আসলি তার উপর এত কি ভাবছিস? তোর সব কিছু ঠিক চলছে তো?”

নিতুর কথায় বাস্তবে ফিরে এলাম। মেহমানরা সবাই খেয়ে চলে গেছে। আমি নিতু আর আরিফ ভাই মানে নিতুর বর এখনো বাকি।

“হ্যাঁ ভাল আসলে একটা কথা ভাবছি”

“ কি কথা?” নিতুর একটু চিন্তিত ভাবে বলল।

“ না মানে তোদের নিচতলায় একজন থাকেন না “ সেঁজুতি নাম উনার, ওই যে অনেক ভিডিও দিতেন ফেসবুকে, “সেঁজুতির প্রতিদিন” নামে উনার একটা পেইজ ছিলো”।

আরিফ ভাই হা হা  করে হেসে উঠলেন। খাবারের টেবিলে উনি অপেক্ষা করছেন আমাদের জন্য। একসাথে খাবেন বলে। হাসতে হাসতে বললেন “ তোমাদের এই ফেসবুক প্রীতি আর গেলো না। আগে দেখেছি মা খালারা এক সাথে হলে সংসার, রান্না, বাচ্চা এই সব নিয়ে গল্প করতেন, আর এখন তো অবসরে কেউ গল্পই করে না, নিজের মোবাইলে বুঁদ মেরে থাকে, যদিও করে তাও সেটা হয় সেই ফেসবুক নিয়ে। কে কি ভিডিও দিলো, কি ছবি দিলো, এই জয়া নিতু নাকি আলু ভর্তা বানাবার রেসিপি দিয়ে ভিডিও উপলোড করেছে সেদিন আর তুমি সেখানে লিখেছ অসাধারণ? ভাই তুমি কি এই প্রথম আলু ভর্তা দেখলে? ”

আমি একটু লজ্জা পেলাম। নিতু কটমট করে আরিফ ভাইয়ের দিকে তাকাল। দোষটা আমার! আজ নিহালের জন্মদিন। একে তো আমি এসে নিতুকে কোন সাহায্য করতে পারিনি তার ওপর আবার কি সব উলট পালট বিষয়ে কথা বলছি। নিতুকে কথা দিয়েছি আজ রাতে ওর বাসায় থাকবো, কাল বাসা পরিষ্কার করতে ওকে সাহায্য করবো। প্রায় ত্রিশ জন মেহমান এসেছিলো বাচ্চা-কাচ্চা সহ, ঘর তো এলোমেলো হবেই।  

তবে নিতু কিন্তু আমার মুখ দেখে বেশ বুঝতে পারলো আমি মনে মনে অন্য কিছু ভাবছি। ও বলল “ আচ্ছা তোর মনে আছে বলে ফেল তো জয়া।”

নিতুর আস্কারা পেয়ে বলেই ফেললাম “ নিতু চল না সেঁজুতি আপার বাসায় যাই। আসলে আমার অনেক জানার ইচ্ছা উনি এমন হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেলেন কেন?”

“ কি বলিস  এখন? রাত নয়টা বাজে আর তুই এই সব জেনে কি করবি?”

“ আর চল না, নিহালের বার্থ ডের কেক নিয়ে যাই। “

“ হ্যাঁ এটা ভালো বলেছিস, উনাদের তো আরিফ দাওয়াত করে এসেছিলো কিন্তু উনারা আসলেন না। উনারা নাকি কোথাও খুব একটা যান না। সেটা যাওয়া যেতে পারে কিন্তু তুই খাবি না? খাবার তো ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।“

“ আরে এসে গরম করে নেব, চল প্লিজ আর দেরি না করি।“

আরিফ ভাই আমাদের কথা শুনেই বুঝতে পেরেছেন আজ আর তার আমাদের সাথে খাওয়া হবে না। উনি খেতে খেতে বললেন “ ভাই তোমরা পারো, আমি খেয়ে নিলাম। তারপর আমরা বাপ বেটা কিন্তু ঘুমিয়ে পড়বো। নিতু তুমি চাবি নিয়ে যাও”

যদিও এমন সময় কারো বাসায় যাওয়াটা ঠিক না তবে প্রতিবেশী বলে কথা আর জন্মদিনের কেক দিতে যাওয়া যায়। দুই বার বেল বাজার পর একজন ভদ্রলোক দরজা খুললেন। উনি সেঁজুতির বর সজীব। উনার অনেক ভিডিও আমি দেখেছি তাই তাকে চিন্তে আমার অসুবিধা হয়নি। নিতুকে দেখে হাসলেন।

“ ভাই আপনারা তো গেলেন না নিহালের বার্থ ডে তে, আমিই আসলাম। এখন এসে সমস্যা করলাম না তো?”

“ আরে না ভাবি সমস্যা আর কি আমরা জেগেই আছি। কাল শুক্রবার। আমারও অফিস নাই। আসে ভেতরে আসেন। আমি সেঁজুতিকে ডেকে দিচ্ছি”।

বসার ঘরটা খুব ছিমছাম। এক সেট সোফা। আর পাশে একটা ডিভান রাখা। কর্নারে একটা টবে পাতাবাহার টাইপের একটা গাছ। এমন গাছ প্রায় সকলের বাসায় দেখা যায় যদিও আমি তার নাম জানি না। নিতুর বারান্দাতে একটা দেখেছি। ওকে জিজ্ঞাসা করতে যাবো গাছটার নাম কি, তখনি সেঁজুতি আসলেন। আমাদের দেখে সেই সন্ধ্যার মত সুন্দর একটা হাসি দিলেন।

“ আপা বিরক্ত করলাম না তো?” নিতু বলল।

“ না না বিরক্ত কেন করবেন? আমিই দুঃখিত নিহালের জন্মদিনে যাই নি”

“ আপা ও আমার বান্ধবী জয়া…”

“ হ্যাঁ উনার সাথে আজ সন্ধ্যায় দেখা হয়েছে লিফটে। “ নিতুকে থামিয়ে দিয়ে বললেন সেঁজুতি।

তারপর বললেন “ আমরা এখনো রাতের খাবার খাইনি আমাদের সাথে খান, তেমন কিছু না, আজ শুধু গরুর মাংস করেছি”

“ না না আপা আমরা বাসায় যেয়ে খাব, কেক দিতে এসেছিলাম। আজ যাই আপা দেখা হবে”

নিতু আমাকে তারা দিতেই আমি বলে ফেললাম “ সেঁজুতি আপা আপনি ভ্লগ করা একেবারে বন্ধ করে দিলেন কেন?”

হুট করে এমন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করাতে নিতু যেমন অপ্রস্তুত হল সেঁজুতি ও কেমন যেন হচকচিয়ে গেলেন। সেটা বুঝতে পেরেই আমি আবার বললাম

“ আসলে আমি আপনাকে ফলো করতাম তাই অনেক কৌতূহল আমার, সরি কিছু মনে করবেন না। “

সেঁজুতি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন “ জয়া আপনার মত অনেকেরই এমন আগ্রহ আমি কেন ভ্লগ করা বন্ধ করে দিলাম। দেখা হলেই জিজ্ঞাসা করে তাই এখন অনেক দাওয়াতে আমি যাই না। ভালো লাগে না। নিজের মত থাকি। তবে জয়া আমার কিন্তু ফেসবুকে প্রথমে সেঁজুতির প্রতিদিন নামে পেইজ ছিল না, ছিল সেঁজুতির রান্নাঘর নামে। তখন আমাকে কেউ চিনতো না। সে অনেক লম্বা গল্প।“

“ আপনি বলতে পারেন আমাদের হাতে সময় আছে” আবারও মনে হল বোকার মত কথা বললাম নিতুর দিকে তাকিয়ে তা বুঝলাম। ওর দৃষ্টি বলছে এই মহিলার জীবন কাহিনী শুনে তুই কি করবি? এত আগ্রহ কিসের?  আসলে কেন যে আগ্রহ তা আমি নিজেও বলতে পারব না। তবে এইটুকু বলতে পারি তার কথা গুলো শোনার জন্য আমি এখানে আর কিছুক্ষণ বসতে রাজি।

সজীব ভাই সবার জন্য চা নিয়ে এসেছেন। শীতের এই রাতে চা  মনে হয় জরুরী ছিল।

“ আমি প্রথম ভ্লগ বানাতে শুরু করি করনা শুরু হবার ঠিক এক বছর আগে থেকে। আমি রান্নার ভিডিও বানাতাম। অনেকটা শখের বসে। রান্না এবং তার ডেকোরেশন আমার খুব শখের একটা জায়গা। ফেসবুক ইউটিউবে আমার হাতে গোনা কিছু ফলোয়ার ছিল। এটা নিয়ে আমার কোন খারাপ লাগা ছিল না তবে ফেসবুকে দেখতাম  কেউ কেউ হয়তো বসে খাবার খাচ্ছে বা কোথাও যাচ্ছে এই সব ভিডিও প্রচুর ভিউ হত। অথচ আমি অনেক পরিশ্রম দিয়ে  একটা রান্না করছি সেটা মাত্র দশ থেকে বিশ জন দেখছে। তবে আগেই বলেছি এটা নিয়ে আমার কোন আফসোস ছিল না।

এরপর শুরু হল করনা। আমাদের অফিস থেকে লোক ছাটাই হল ওই সময়। দুর্ভাগ্য বসত সেই ছাটাই তালিকায় আমি পড়লাম। আমাদের ছেলে দীপ্ত তখন মাত্র চার বছর। আর আমার স্বামী সজীব ওর অফিস থেকে ওকে বিনা বেতনে ছুটি দেয়া হল। আমরা দুইজন যেন অথৈ সমুদ্রে পড়লাম। জমা টাকা খরচ করে সংসার চালাচ্ছি, তবে নিজেরা যাই খাই, ছেলেটাকে তো কিছু ভাল খেতে দিতে হয়! করনা শেষ হলে সজীব হয়তো আবার জয়েন করতে পারবে কিন্তু আমাকে চাকরি খুঁজতে হবে। এই বাজারে চাকরি পাওয়া তো আর মুখের কথা না! এভাবে এক মাস গেলো। একদিন মনে হল আচ্ছা ফেসবুক থেকে তো মানুষ ইনকাম করছে, তাহলে আমি কেন চেষ্টা করছি না? তবে এতদিনে আমি বুঝে গেছি রান্নার ভিডিও দিয়ে আমার ভিউ বাড়বে না। আমাকে আসলে চলতে হবে সময়ের সাথে। সেদিন থেকে শুরু “সেঁজুতির  প্রতিদিন”।“

একটু থেমে আবার শুরু করলো  সেঁজুতি “ প্রথম প্রথম একটু সংকোচ হলেও আসতে আসতে আমি আমার প্রতিদিনের কর্মকাণ্ড ভিডিও বানিয়ে ফেসবুকে আপলোড করতে শুরু করলাম, এই যেমন আজ নাস্তায় কি বানালাম। দুপুরের খাবারে কি ছিলো? কখন কখন ভিডিও করতাম আমি কিভাবে ঘর ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার রাখছি।“ এই টুকু বলে সেঁজুতি আবার থামল। একটু হাসল। বোকা বোকা একটা হাসি।

“ এমন ভিডিও বানাতে বানাতেই একদিন আমার ছেলে দীপ্ত চলে আসলো ভিডিও তে। ও বোধহয় খেলা করছিল। আমি ভিডিও বানাচ্ছিলাম, এর মাঝে ও দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে আর ভিডিওতে সেটা চলে আসে। এরপর থেকে সবাই খুব দীপ্ত কে দেখতে চাইতো। আমার ছেলেটার চেহারাটা অনেক মায়াবী ছিলো। সবাই ওকে খুব পছন্দ করতো। আমিও ওকে নিয়ে ভিডিও বানাতে শুরু করলাম। ওকে কিভাবে খাওয়াচ্ছি, ওর কথা, ওর গান গাওয়া, সব। প্রচুর ভিউ বাড়তে লাগল। আমার ইনকাম ও বাড়তে লাগল। এর মাঝে করনার মহামারি কমে আসলে সজীবের অফিস ওকে ডাকল, জয়েন করতে। কিন্তু আমি আর চাকরীর খোঁজ করলাম না। কারণ আমি ঘরে বসেই ফেসবুকে ভাল আয় করছি। সমস্যা শুধু একটাই আমাকে সারাদিন মোবাইল ফোন নিয়ে থাকতে হয়। আর্থিক অবস্থা ভালো হওয়াতে আমরা এদিক সেদিক বেড়াতে যেতাম সেসব ভিডিও করে দিতাম ফেসবুকে। কিছুই না কথায় যাচ্ছি, কি খাচ্ছি, নতুন কোন পোশাক কিনলে সেটা আন প্যাক করতাম লাইভে এসে, দীপ্তকে নিয়ে শপিং এ যেতাম, এই সব ভিডিও। অনেকে কমেন্ট করতো “ আপু আপনি অনেক লাকি, এত সুন্দর ঘুরতে পারছেন, “ এই সব আর কি।

দীপ্তর পঞ্চম জন্মদিনটা আমি বেশ বড় করে করলাম। পুরো অনুষ্ঠানে লাইভে ছিলাম। প্রচুর মানুষ দেখছিল সেই লাইভ। আমার সেদিন নিজকে সেলিব্রেটি টাইপ কিছু মনে হচ্ছিল। সজীব প্রথম প্রথম আমাকে কিছু না বললেও পড়ে খুব বিরক্ত হত। দৈনন্দিন জীবনের সবটা সোশ্যাল মিডিয়াতে আনাটা তার একেবারেই পছন্দ ছিলো না। কিন্তু আমি তখন অন্য দুনিয়াতে বাস করছি। এই সব নিয়ে দীপ্তর জন্মদিনের পর আমাদের মাঝে এক দিন অনেক বড় ঝগড়া হল।“

আমার মনে পড়লো সেঁজুতি একবার একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিল ফেসবুকে তার স্বামীর সাথে তার থাকা উচিত কি না? কারণ স্বামী নাকি তার স্বাধীনতায় বাঁধা দিচ্ছে। অনেকে কমেন্ট করেছিলো, এমন স্বামীর সাথে না থাকার জন্য। অনেকে লিখেছিলও “ যদি থাকে কামাই, লাগেনা কোন জামাই”।

“ সেদিন ফেসবুকে সবার কমেন্ট পড়ে আমার মনে হয়েছিলো তাই তো, সজীবের কি দরকার আমার! আমি তো নিজেই ভাল ইনকাম করছি! সজীবের চেয়ে সংসারে বেশি টাকা দিচ্ছি, এরপরও এত কথা! ওর তো আমাকে নিয়ে গর্ব করার কথা, এতো ছোট মনের মানুষের সাথে থাকা আসলেই অসম্ভব। আমি দীপ্তকে নিয়ে আমার মায়ের বাসায় চলে গেলাম।

সেখানে সব কিছু ভালই চলছিলো। আমি এখন সবটা সময় ভিডিও বানাতে দিতে পারি। দীপ্তর নানীই ওকে দেখা শোনা করে। শুধু একটাই সমস্যা আম্মা বার বার একটা কথাই বলেন “এত কিছু সোশ্যাল মিডিয়াতে দিস না। মানুষের নজর লেগে যায়”, বিশেষ করে দীপ্তকে নিয়ে কোন ভিডিও বানানো আম্মা একদম পছন্দ করতো না। আমি এই সবে বিশেষ পাত্তা দিতাম না। আম্মা পুরানো যুগের মানুষ।

এর মাঝে অনেকটা সময় পার হল। সজীবের সাথে আমার ডিভোর্স  পুরো ফাইনাল। সজীব আমার সাথে অনেক বার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও আমি করি নাই। দীপ্ত কেও আমি ওর সাথে কথা বলতে দেই না। এটাও আসলে আমার ফ্যান ফলোয়ারদের বুদ্ধি ছিলো। তারা বলেছিল ছেলের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন, এমন মিন লোকের সংস্পর্শে ছেলেকে যেতে দিয়েন না।

একদিন স্কুল থেকে দীপ্ত জ্বর নিয়ে ফিরলো। রাতে তার অনেক জ্বর উঠলো। জ্বর যেনো কমে না। পরদিন ডাক্তারের কাছে নেবার পর টেস্ট করে জানতে পারলাম ডেঙ্গু হয়েছে। ওকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। দুপুরে সজীব উদ্ভ্রান্তের মত হাসপাতালে এসে হাজির হল। হয়ত আমার ফেসবুক পোষ্ট থেকে জেনেছে। ওকে আমি ব্লক করে রেখেছিলাম। অন্য সময় হলে আমাকে স্টক করবার জন্য প্রচণ্ড বিরক্ত হতাম হয়ত, কিন্তু আজকে ওকে দেখে যেন আমার একটু স্বস্তি হল।

দীপ্ত দুই দিন হাসপাতালে ছিলো, এই দুই দিন প্রতিটি মুহূর্ত আমি লাইভে বা ভিডিও করে ফেসবুকে পোষ্ট দিয়েছি। ওই মুহূর্তে আমার ছেলেটার পাশে বসে ওর মাথায় হাত রাখা নাকি লাইভে যেয়ে সব ফ্যান ফলোয়ারসদের আমার ছেলে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে এটা দেখানো জরুরী ছিলো আমি জানি না। আর এরপর তো…।“

সেঁজুতির চোখে পানি। তার গলা ধরে এসেছে। সজীব ভাই উনার হাত ধরলেন। এতক্ষণ ধরে একটা কথাও উনি বলেন নি। হয়তবা চাইছেন সেঁজুতি নিজেই পুরোটুকু বলুক। চোখের পানি মুছে  সেঁজুতির বলল “ জানেন জয়া এযাবতকালে আমার কোন ফেসবুক পোষ্ট সবচেয়ে বেশি ভিউ পেয়েছে এবং সবচেয়ে বেশি আয় করেছে? দীপ্তর মৃত্যুর সংবাদ! আমার ছেলের মৃত্যু আমাকে মিলিয়ন ভিউ, ফলোয়ারস আর সবচেয়ে বেশি ফেসবুক ইনকাম এনে দিয়েছিল।“

সেঁজুতি অঝরে কাঁদছে। ফ্যান ফলোয়ারসদের কাছে সেই “ মিন” লোকটা সজীব ভাইও সেঁজুতিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মত কাঁদছে।

আমি আর নিতু মাথা নিচু করে বসে আছি, সন্তান হারা বাবা-মাকে ফেসবুক পোষ্টে এত সুন্দর করে সান্ত্বনা দিতে পারলেও সেঁজুতি আর সজীব ভাইকে কেনও আমি কোন সান্ত্বনা দিতে পারছি না, আমি জানি না।

ডানা মির্জা ২৩/১২/২০২৪

গল্প থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Dana Mirza
ডানা মির্জা
লিখতে ভালবাসি, এপর্যন্ত তিনটি বই বের হয়েছে, " দ্যাট ফিফটিন মিনিটস" একুশে বই মেলায়, "জাতিস্মর" ই-বুক বইটই অ্যাপ এ এবং কবিতার ই-বুক " বইঘর" অ্যাপ এ। এছাড়া ফেসবুকে তো লেখা হয়।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *