প্রথম পাতা » গল্প » সম্পর্ক

সম্পর্ক

Goddess of love

একটি চকলেটের জন্য জীবন দেওয়ার কাল সবার জীবনেই এসেছে কম-বেশি। কেউ আবার একটি গোলাপের জন্যও জীবনকে বিসর্জন দিতে চেয়েছেন, হয়তো দিয়েছেনও কেউ কেউ। আমি গোলাপকে অবশ্য ছুঁতেও পারিনি। একবার ত্রিশ মিনিটের জন্য একটি গোলাপ এসেছিল! একগুচ্ছ প্রেম নিয়ে! ঘটনা সত্য।

তার সাথে শাহবাগে শেষ দেখা করে ঐ দিনের জন্য বাসায় ফিরছিলাম। বাসে ওঠার আগে আগে সে বলল- আই লাভ ইউ। আমি মোটামুটি কাইত হয়ে গেলাম। আমার জীবনে প্রেম পুরা ধাক্কা দিয়ে এলো। তিন নম্বর বাসে উঠলাম। হেলপারের সকল অপরাধ সেদিন মাফ করে দিলাম। এয়ারপোর্ট নামব। বাসে বসে তাকে নিয়ে সেন্টমার্টিন চলে গেলাম। সমুদ্রের ভয়ানক গর্জন। হুমায়ূন আহমেদ এর নামই সম্ভবত দিয়েছিলেন ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’! সেই সৌন্দর্যে আলো আঁধারি জোছনা। উদ্ভ্রান্ত বাতাস। সেই ভয়াবহ সময়ে একটি মায়াবী মুখের দুটি ঠোঁট…! হঠাৎ মোবাইলে মেসেজ এলো! আর সময় পেলো না। থাক, পরেই পড়ি। নতুন প্রেম, নতুন ফিলিংস। কী জানি আছে বলার, শোনার কিংবা অনুভূতির। সেন্টমার্টিনে আরেকটু থাকলেই হতো! মিছা এই দুনিয়াদারি! প্রযুক্তির বিড়ম্বনা! ভাবতে ভাবতেই গন্তব্যে চলে এসেছি। নামলাম। একটা জটিল সময় পার করছি। মোবাইলে প্রেমিকার মেসেজ। সিগারেট খেতে খেতে মেসেজটা পড়া যায়। এতো তাড়াহুড়োর কিছু নেই। হৃদয়ঘটিত ব্যাপার স্যাপারে একটু ধীরে চলো নীতিতে চলতে হয়। রেললাইনের এক পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। হাতে আগুন জ্বলছে, হৃদয় নাচছে। কাঁপা কাঁপা হাতে মোবাইলটা বের করলাম। বাটনে ক্লিক করতেই মেসেজ পড়ার জন্য প্রস্তুত। সিগারেটে সুখটান দিয়ে মোবাইলে চোখ রাখতেই মুহূর্তেই সব ঝাপসা হয়ে উঠল। সিগারেট দ্রুত ওঠানামা করছে। কাম সাইরালাইছে।

সেদিন রাতের রাস্তা ফাঁকাই ছিল। তাই ত্রিশ মিনিটের মধ্যেই চলে এসেছি। অথচ ত্রিশ মিনিট আগেও পৃথিবীটা কতো সুন্দর ছিল। এখন সব ম্যারম্যারা লাগছে। জীবনের চ্যাতভেদ সব যেন কলস উল্টানো পানির মতো গড়িয়ে গেলো। সিগারেট নেতিয়ে পড়েছে। জোরে টানি, কিন্তু ধোঁয়া যেন হারিয়ে গেছে। ওপরে হয়তো ওঠে শরমে আর নিচে নামে না। অটোতে ওঠে আরেকটা বিড়ি ধরাইলাম। গান বাজছে : দূরে কোথাও আছি বসে…! বসে থাকো। তাতে আমার কী? অটোওয়ালার সাথে কিঞ্চিত হাতাহাতি করে ঘরে ফিরলাম।

আমি আজো বুঝতে পারি নাই – ত্রিশ মিনিট পর মানুষের মনের ঠিকানা কোথায় যাবে তা-ও অনেকে বুঝতে পারে না কেন? তারপর সেই যে তার সাথে শেষ দেখা, শেষ কথা! কত বছর? এক যুগ তো হবেই! মানুষ পারেও!!! মানুষই পারে।

চ্যাংড়াকালে একটা সার্কেল ছিল। এদের ছাড়া একটি দিন কল্পনা করাও ছিল দুঃসাধ্য। প্রায় সারাদিন একসাথে। কতো রাতও একসাথে কাটিয়েছি। জীবন মানে ওরাই ছিল সবটাজুড়ে। এদের কারো সাথেই এখন আর দেখা হয় না। কারো কারো সাথে তো পনের বছর কোনো রকম যোগাযোগই নেই। মানুষের পক্ষেই এগুলো সম্ভব।

আরেকটু পরিণত কালে আরেকটা সার্কেল হলো। নাটক-সিনেমা- আড্ডাবাজি! কতো সকাল, দুপুর, রাত পার করেছি গল্পে গানে তর্কে। আজ তারা কেউ কাছে নেই। যাদের একদিন না দেখলে পেটের ভাত হজম হতো না তারা আজ কোথায়? আট বছর তারা আমার কাছে নেই! আমি কীভাবে বেঁচে আছি? থিয়েটার মহলা, নাট্যরথ, আমিন মামার দোকান, গার্লস স্কুল রোড… এগুলো কি এখন পোড়োজমি? এগুলো কি আর্তনাদ করে মানুষের ফসিলে? হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস!

বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা? ওদের না দেখলে একটি দিনকে মনে হতো এক মহাকাল! অথচ একসাথে নাই আজ দশ বছর! কীভাবে দিন কাটে সবার? মানুষ এমনই। আসলে মানুষ সব পারে! কিন্তু কেমনে পারে?

বড় ছেলেটা ছোটবেলায় বুক ছাড়া ঘুমাতো না। এখন তার বয়স আট। সে এখন আর তেমনটা বায়না ধরে না। কাছেও আসে না প্রয়োজন ছাড়া। ছোটটা কোলেই থাকে। বুকে ঘুমায়। একদিন সে-ও দূরে থাকবে। ডাকলেও আসবে না। এদের ছাড়া এক মুহূর্তও বাঁচি না। একসময় বাঁচব। ছেলেরা চলে যাবে দূরে। পড়তে, জীবিকার তাগিদে। আজ তারা একদিন না দেখলে বাঁচে না অথচ এমনও দিন আসবে দিনের পর দিন খোঁজ নেওয়ার সময়ও পাবে না। আমার বুকটা সেদিন শূন্য পড়ে থাকবে।

আব্বা মাঝে মধ্যেই অভিযোগের স্বরে বলে- বাড়িতে এখন কম যাই। ফোন কম দেই। আব্বার বুক ছাড়া একদিন আমিও হয়তো ঘুমাতে পারি নাই। আজ আব্বার বুক শূন্য বালুচর। প্রতিদিন সকালে ছেলেদের আসার পথে শীতের তীব্র কুয়াশায় তাঁর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।

সবার পালেই একদিন হাওয়া লাগে। পৃথিবীতে আসলেই কে কাহার? সাতশ কোটি মানুষের এই গ্রহে মানুষই প্রতিনিয়ত নিঃসঙ্গ, এই ভুবনে প্রচণ্ড একা সে !

গল্প থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *