“আপনার ছেলেবেলা নিয়ে কে জানতে চায়? আপনি বিখ্যাত নন। বিখ্যাত মানুষরা ছেলেবেলা নিয়ে লিখলে সবাই পড়ে। আপনি তো মাঠে মারা যাবেন ভাই! ভেবেছিলাম শুধু জমিদার বাড়ি নিয়ে লিখবেন। জমিদার বাড়ির নুপুর পড়া, মাঝরাতে হাটা , অন্যায়ভাবে হত্যাকৃত অতৃপ্ত নর্তকীর কথা থাকবে একটু, তা না। হতাশ হলাম।”
আমার লেখা কোন হতাশা নিবারক নয়। আমি বস্তা পচা ,সস্তা ও পরিস্থিতির শিকার লেখক। করোনা পরিস্থিতি। ঘরে থাকুন লেখালেখি করুন। সস্তা বস্তাপচা লেখা হলেও চলবে। আপনার লেখার তুয়াক্কা কে করে।?আপনাকে ঘরে রাখতে পারলেই হল। আমার সস্তা বস্তাপচা লেখা আমাকে ঘরে রাখছে সেটাই বা কম কি। সস্তা লেখকেরা কারও হতাশা বা আশার কিংবা সমালোচনার ধাঁর ধাঁরে না। দোকানই নাই তার আবার সাইনবোর্ড। আগে তো লেখক তারপর দামাদামি। সস্তা নাকি বাজারে আগুন? আমার দোকানও নাই সাইনবোর্ডও নাই। আগুন ধরার সুযোগ নাই৷
কেউ কেউ তো বলবে হুমায়ুন আহমেদ কে অনুকরণ করা বন্ধ করেন। আপনি তার নখের সমতুল্যও নন। আমি বলি সহজ কথা সহজে বলতে গেলে সবাই হুমায়ুন আহমেদ হয়ে যায়। আমি তো সালমান মুক্তাদির এর নখে নিজের চেহারা দেখতে পারলেই গদগদ হব। অনেকে বলবে ভাই আপনি এটা কি করলেন! নিজে কে এতো ছোট করলেন? জীবনে একটা লেখাও পাবলিশ করি নাই। মুক্তাদির সাহেব তবুও তো করেছে।
আমি ছোট মানুষ। আমার ছোটবেলা আমার মতোই ছোট, তাই বলে কি ছোটবেলা বড় করে লিখব না? লেখা শুরু।
আপনি যেখানে বড় হয়েছেন এবং বেড়ে উঠেছেন সেটা নিয়ে লেখা যেমন সহজ আবার কঠিনও। আমার জন্য সহজ বা কঠিন না। আমার জন্য কষ্টের। “সতত” যে “কপোতাক্ষ নদ”, তা নিয়ে মাইকেল লিখতে পারতেন না যদি প্যারিসে চলে না যেতেন আর কষ্টে না থাকতেন। জন্মস্থান থেকে দূরে এলে লেখাটা আসে ভালো। আমের পোকা যেমন আম চিনে না তেমনি পাকুটিয়া থেকে চলে না এলে আমি আমের পোকা হয়ে থাকতাম। পাকুটিয়া কে চেনা হত না। চলে আসার পর কতবার গুগল থেকে পাকুটিয়া জমিদার বাড়ির ইতিহাস পড়েছি তার ঠিক নেই। ইতিহাসে কি আছে তা গুগল করলেই জানা যাবে। এখানে আর মুসাবিদা না করলেই শ্রেয়।
তারপরও একটু বলা যায়। ১৯১৫ সালের দিকে পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি তৈরি হয়। আমি যে স্কুলে পড়েছি তা জমিদারদেরই প্রতিষ্ঠা করা। ১৯১৬ সালে। চার বছর আগে শতবার্ষিকী গেলো। যেতে পারি নাই। আফসোস কাজ করে। আমি প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাকুটিয়াতেই পড়েছি। ২০০৫ এ এসএসসি পাস করে ঢাকায় চলে আসি। বেদনার শুরু। যেদিন পরীক্ষা শেষ হল সবাই বুঝতে পারলাম বিদায় নেয়ার সময় আসছে। মনে অনেক মুচড় লেগেছে। সহজ করেই লিখতে হবে এসব কথা। হুমায়ুন আহমেদ এর মত লিখতে পারলে ভালো হতো। আগেই বলেছি সহজ কথা সহজভাবে উনার মতো কম লোকই বলতে পেরেছে। আমি কোন ছাড় যে তার ধারেকাছে যাব।
এদিক সেদিক অনেক কথা বলা হল। ছোটবেলার কিছু স্মৃতি না বললে লেখার শিরোনাম এর সার্থকতা থাকবে না। আগেই বলেছি আমার জন্ম পাকুটিয়াতেই। পাকুটিয়া বাজারে আমাদের বাসা। বিকেলে জমিদার বাড়ির মাঠে জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলা থেকে শুরু করে হাতে বানানো ব্যাট দিয়ে ক্রিকেট খেলা আমরাও খেলেছি। মাঠের পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছ থেকে শিমের মতো দেখতে ওইটার (এটার নাম যে কি আজও জানা হয় নাই। বোটানির কেউ থাকলে জানাতে পারেন) ভেতরের নরম অংশ খেয়েছি মজা করে। জমিদার বাড়ির বাগান এ ছিল অনেক গাছ। আম থেকে শুরু করে লিচু সবই আমাদের পেটে গেছে সবার আগে। অনেক পরিত্যাক্ত কুয়া আর পায়খানা ছিল। এগুলো জমিদারদের সময় বানানো। একবার তো একটা কুয়া থেকে মরা লাশ ভেসে উঠলো। আমরা আগের দিন ওই কুয়ার ঘাটেই বসে ছিলাম। কিছুই টের পাইনি। ঐটা আরেক কাহিনি। এখানে বলার মতো ব্যাপার না। ভালো কিছুর সাথে এটা মেশানো অসমীচীন।
সকালে উঠে হেঁটে হেঁটে জমিদার বাড়ির মাঠ পাড় হয়ে গোসল করতে যেতাম। হ্যাঁ। এটাও জমিদারদের বানানো পুকুর। এই পুকুর নাকি কখনও শুকায়না। আমারা কখনও শুকাতে দেখি নাই। গরমকালে সারা পুকুর হাটা যেত। কিন্তু কখনও একেবারে শুকাত না। পুকুরে চুল প্যাচানী আছে বলে শ্রুতি ছিল। আমার পায়ে কখনও প্যাচ দেয় নাই এতটুকুই জানি। দারা খেতে পানি। জ্বী, গল্প শেষ করে এই দারা খেতে পানি দিয়ে শেষ করতে হতো ছোটবেলায়। দারা মানে ডাঁটা শাক হবে বলে মনে করছি।
তিন ভাই এর তিন জমিদার বাড়ি। তিন তরফ নামেও ডাকা হতো। সব বাড়ীতেই নাকি আন্ধার কোঠা নামে একটা জায়গা আছে। ছোটবেলায় শুনতাম। ক্লাস ফাইভের ছাত্র আমরা। বন্ধুরা ঠিক করেছিলাম আন্ধার কোঠা খুঁজে বের করবো। ভয়ে আর খোঁজা হয় নাই। আন্ধার কোঠা আন্ধারেই রয়ে গেলো। অন্দর মহলই আন্ধার কোঠা। এই জ্ঞান বড়দের জ্ঞান। আমরা ছোট ছিলাম। সেই ছোট জ্ঞানের কথাই এসব।
মাঠে যখন ফুটবল খেলা হতো আমরা জমিদার বাড়ির ছাদে উঠে যেতাম খেলা দেখার জন্য। গ্যালারির প্রথম সারির সিট। একবার এক লোক তিন তলা থেকে নিচে পড়ে গেলো। খেজুর গাছের উপর পড়েছিল। খেলার সময় ছাদে উঠা নিষিদ্ধ হওয়ার উপক্রম। তারপরও দুষ্টু ছেলেরা উঠত। আমি ভালো ছেলে ছিলাম। তাই আমি মনে করি। খেজুর গাছের উপর পড়ার চেয়ে ভালো ছেলে হওয়া ভালো।
অনেক সময় বিকেলে খেলা শেষ করে আমরা অনেক রাত পর্যন্ত মাঠে বসে থাকতাম। চাঁদনী রাতে। গোল হয়ে বসে ভূতের গল্পের আড্ডা। গল্পবাজ হিসেবে আমি ভালই ছিলাম। এখনো মনে হয় তাই আছি। আমার বন্ধুরা এই লেখা পড়লে তাই বলবে।পাশে জমিদার বাড়ি আর ভূতের গল্প। বেশ জমে উঠত। সমস্যার শুরু হতো বাড়ি যাওয়ার সময়। গল্পের সব ভূতেরা পেছন পেছন হাঁটতে থাকতো। মাঝেমাঝে ডাক যে দিতও না তা নয়। মনের ভুল জেনেও ভয় না পেয়ে উপায় আছে?
চলবে—
আফাজল ভাই আন্ধার কোঠার কথা আমরাও শুনেছি কিন্তু এখন বুজি ওটা আন্ধার কোঠার ছিলো না আসলে ওটা হবে অন্ধর মহল যাকে গ্রামের সাধারণ মানুষ আন্ধার কোঠার বলে ডাকতো ।