প্রথম পাতা » গল্প » বকের ঠ্যাং, দাবড়ানি আর জমিদার বাড়ির দুঃখ

বকের ঠ্যাং, দাবড়ানি আর জমিদার বাড়ির দুঃখ

লেখাটা একটা টিপ্পনী দিয়ে শুরু করলাম।

বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক বন্ধুর টিপ্পনীঃ কি ব্যাপার! জমিদার বাড়ি নিয়ে লেখা বন্ধ কেন! নতুন নতুন লেখক হওয়ার রসদ কি শেষ? কাছের বন্ধুদের মুখে কিছু আটকায় না। আমি বললাম ফেসবুক এ পোস্ট করে লাইক কমেন্ট গুনতে গুনতে আমার রসদ শেষ। কয়টা লাইক পাব তার উপর আমার লেখার রসদ দাঁড়ায়ে আছে কিনা! লিখি আর ছটফট করি কখন ফেসবুক এ দেব আর বসে বসে নামতা গুনবো। নামতা অবশ্য বেশিদূর গুনতে হয় না। তিন এর ঘরেই শেষ। ৩ দশে তিরিশ টার বেশি লাইক পড়ে না। বন্ধু সংখ্যা নয়শো। সবাই লাইক দিলে বিপদ হতো। অতোর ঘরের নামতা আমি পড়তে পারতাম না। “you think this is funny?” Yes, this is funny. Cause Corona is no fun. ট্রাম্প সাহেব আর জয়নাল হাজারী সাহেবের বিশেষজ্ঞ পরামর্শের ব্যাপারটা বাদে অবশ্য। যাই হউক ছোটবেলা নিয়ে লেখা তাই ছোটবেলাতে ফিরে যাই।

সিমেন্টের বস্তার বাদামী মোটা কাগজ দিয়ে বইয়ের মলাট লাগাতাম। মলাটের উপর সুন্দর করে নাম ,শ্রেণি রোল নাম্বার, শাখা লিখতে হতো। আমার বড়ভাই এর হাতের লেখা বরাবরই ভালো ছিল। তাকে দিয়েই লেখাতাম। অনেকে ভাবত আমার হাতের লেখা। আমি মনেমনে খুশি হতাম। অষ্টম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষা। নাগরপুরের যদুনাথ স্কুলে পরীক্ষা দিতে হতো। ফুপুর বাড়ি কলমাইদ গ্রাম থেকে সাইকেল চালিয়ে পরীক্ষা দিতে যেতাম। নিজের সাইকেল না। ফুপাতো ভাইয়ের সাইকেল। আব্বা সাইকেল নিয়ে আগে আগে যেতেন। আর আমি পেছনে পেছনে চালাতাম। একটা পরীক্ষা তাড়াতাড়ি শেষ করে বের হয়েছিলাম সাইকেল বেশি সময় চালানোর জন্য। ফনিক্স সাইকেল। আমাদের সময় ঘণ্টা হিসেবে সাইকেল ভাড়া করা যেত পাকুটিয়া বাজারে।ছোট নিচু সাইকেল।টাকার সংস্থান না হওয়ার কারণে ভাড়া করা হতো না প্রায় সময়।

লাস্ট পরীক্ষা শেষে বের হলাম ব্যাজার চেহারা করে। আমার কাদুকাদু চেহারা দেখে আব্বা হতাশ। এবার মনে হয় সম্মানটা আর থাকলো না। ছেলের রোল নাম্বার এক। বৃত্তি পেলনা। আমি আব্বা কে বললাম আমার খাতা স্যাররা দেখবেন না। ছুঁড়ে ফেলে দিবে। হাতের লেখা যথারীতি খারাপ ;”কাইয়াঁর ঠ্যাং বগের ঠ্যাং” বলতে যা বুঝায় আর কি। আমাদের ওইদিকে এবং আরও অনেক দিকেই, খারাপ হাতের লেখার মেটাফর ছিল এই নিরীহ কাক এবং বকের হাত পা। তার উপর হাতের লেখা পরীক্ষায় আরও খারাপ হয়েছে। ল্যাপটপ এ না লিখে হাতে লিখলে আমার লেখা ভিনদেশী কোন লেখা ভেবে অনেকে গুগল অনুবাদ ব্যবহার করতে যেতেন। যাই হউক ঐবার ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে নাগরপুর থানায় প্রথম হয়েছিলাম। সুযোগে আমি কতো ভালো ছাত্র তা জাহির করে দিলাম। আব্বার সম্মান ঠিকতো ছিলই বরং উপচে পড়েছিল। থানায় প্রথম। চাট্টিখানি কথা না। এরকম থানা ৪৯২ টা। এতো আল্লাদ করার কিছু নাই। ওই সময় খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী। তার দস্তখত করা দুইটা বই আমাকে দেয়া হয়েছিল স্কুলের মারফত। আরও অনেককেই দিয়েছে। টাঙ্গাইলে তো থানা একটা না, বারোটা।। খারাপ হাতের লেখা নিয়ে মন খারাপ হয় নাই আর। তাই হাতের লেখা আগের মতোই “কাইয়াঁর ঠ্যাং বগের ঠ্যাং” আছে।

জমিদার বাড়ির পুকুরে গোসল করতে যেতাম। ক্লাস থ্রী কি ফোর এ পড়ি। এক লম্বা লোক ছিল। নাম মনে আছে। কিন্তু বলা যাবে না।  চাকরী বাকরি চলে যাওয়ার ব্যাপার না। তাকে নলঠিঙ্গা বলে ডাকলে ভয়ানক ক্ষেপে যেত। আমি জানতাম না। আমার এক বাল্যবন্ধু আমাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল-  আমি নলঠিঙ্গা বলে চিৎকার করতে পারলে ওদের বাড়ির লক্ষ্মী পুজার নাড়ু দেবে। আমার বন্ধুটি হিন্দু ধর্মের। আমি নাড়ুর লোভে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিলাম। ওই লোক গোসল করা বাদ দিয়ে আমাকে দাবড়ানি দিতে লাগলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই ভোঁ দৌড় দিলাম। ওইদিন রক্ষা পেয়েছিলাম। কিন্তু নলঠিঙ্গার গল্প এখানেই শেষ না।

ক্লাস নাইনে উঠলাম। আমাদের উচ্চতর গণিত প্রাইভেট পড়তে হয়েছিল নলঠিঙ্গার কাছে । গণিতে এমএসসি করে ফেলেছে নলঠিঙ্গা ইতোমধ্যে। আমাকে চিনতে পারার কথা না তার। অনেকেই তাকে নলঠিঙ্গা বলে ডাকতো। কয়জনের কথা আর মনে থাকবে। সাত আট বছর পর আপনি আমাদের প্রাইভেট শিক্ষক হবেন জানলে নিশ্চয়ই লক্ষ্মী পূজার নাড়ুর লোভে ভবিষ্যৎ শিক্ষক ক্ষেপে যাবে এমন কিছু বলতাম না। পরবর্তীতে ভালো ছাত্র হিসেবে আমি আত্মপ্রকাশ করবো জানলেও এটা করার প্রশ্ন উঠত না। আরেকটা বিষয় হলো, আমাকে তো ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছিল ,তাই না? স্মৃতি কাতরতা আর হিউমার (রসিকতা) এর বিষয়টা মাথায় রেখে ব্যাপারটা মার্জনীয় হবে বলে ধরে নিচ্ছি। এই লেখাটা স্যার এর পড়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এতো কথা বলা। আগে থেকেই ল্যাঠা চুকানো ভালো। ল্যাঠা শব্দটা নিয়ে না আবার গোলমাল বেঁধে যায়। শব্দটায় শালীনতার পরিপন্থী কিছু আছে বলে ইঙ্গিত পাচ্ছি। আবার নাও থাকতে পারে। আমি ভাষাবিজ্ঞানী নই। এটাও মার্জনা পাবে আশা করছি।

পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি দেখতে দেশি পর্যটক তো আসতোই আবার বিদেশি পর্যটক ও আসতো। এখন বলা চলে কেউ আসে না। পুরাতন জিনিসে মানুষের আকর্ষণ কমে গেছে। এতো নতুন নতুন বিনোদনের ব্যবস্থা যে জমিদার বাড়ি এদের সাথে আর পেরে উঠে না। আগে পারত।

আমি তখন ক্লাস ফোর কি ফাইভে পড়ি। তিন চার জনের এক বিদেশি পর্যটক দল আসলো। আমার প্রথম দেখা বিদেশি মানুষ তারা। আমরা টিফিন এর ফাঁকে তাদের পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়ালাম। উদ্দেশ্য বিদেশি মানুষ কাছ থেকে দেখা আর যদি তারা আমাদের কিছু ছবি তুলে দেয়। সাথে তাদের দামিদামি ক্যামেরা। মুখ দিয়ে তো আর বলা যায় না, এই যে আপনারা আমাদের জমিদার বাড়ি দেখতে আসলেন এখন ভদ্রতা করে তো এই ফাইভ পড়ুয়া ছেলেপেলেদের কিছু ছবিও তুল দিতে পারেন। প্রাইমারী পড়ুয়া ছেলেদের দিকে কেউ ভদ্রতা দেখাবে তা আমরা আশা করি নাই। ক্ষীণ আশা ছিল তবুও। ছবি তুলে নাই তারা। তারা জমিদার বাড়ির ছবি তুলতে বেশি আগ্রহী। এটা দেখেও আমাদের ভালো লাগলো। এইগুলার আশেপাশে আমরা হাগু মুতু করি আর আপনারা ছবি তুলতেছেন! আমার শব্দের অশালীনতা মাফ করবেন। পুরাতন জমিদার মন্দিরের ভেতরের চিত্র আর অন্যান্য চিত্র দেখলে এটা আপনিও বলবেন। সত্যি কথা বলতে আমিও ছোটবেলায় করেছি। না বুঝে। অনেকে এখনো করে কিন্তু বুঝেও এসব বন্ধ করার ক্ষমতা নাই। পাকুটিয়ার মানুষদের পায়খানা নাই তা না। ঐ যে বিপদে আপদে কাজ সারার ব্যাপার আর কি।

এই হাগু মুতু করা মানুষদের পাত্তা দিল না বিদেশিরা। তাদের বিচারশক্তি ভালো। যেসবের উপর এসব করা সেসবের দিকেই নজর। জমিদার বাড়ি। জমিদার বাড়িগুলোর যত্ন আত্তি যে করা হয় না এটা স্পষ্ট। এসব জিনিসের কদর করতে হয়। কদর কেন করে না? প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কি করে? এসবের উত্তর আমার জানা আছে। কিন্তু এখানে বলার ফুরসৎ নাই। ইলিয়াস চৌধূরী নামে এক লোক এই ব্যাপারে মোটামুটি বেশ ভালো একটা লেখা লিখেছিলেন ২০১২ সালের দিকে। লিঙ্কটা নিচে দিয়ে দিলাম।

এসব কথা শুনে মনে হতে পারে জমিদার বাড়ি নিয়ে লেখার রসদ শেষ। এসব কথা সাধারণত কোন কিছু শেষের দিকে আসলে বলে সবাই। কিন্তু শেষ না। চলবে।

গল্প থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *